এবার বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের থিম ‘উই আর নট ওয়েটিং’। দেরি না করে সবাইকে এখুনি এগিয়ে আসতে হবে, কারণ হেপাটাইটিস কারও জন্য অপেক্ষা করে না। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাস রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষা-ব্যবস্থা উন্নতকরণ ও প্রতিষেধক টিকাও আবিষ্কার করেন। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান। চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর এই অনবদ্য অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ২৮ জুলাই তাঁর জন্মদিনে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালন করা হয়।
আরও পড়ুন-বৃষ্টিই জিতে গেল : রোহিত
হেপাটাইটিস কী
হেপাটাইটিস কথাটার অর্থ লিভার কোষের একধরনের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ। হেপাটাইটিস দু’রকমের হতে পারে, ইনফেকটিভ বা জীবাণুঘটিত, অপরটি হল জীবাণুঘটিত নয় বা নন-ইনফেকটিভ। আমরা সাধারণত যে হেপাটাইটিস দেখি সেটা হল জীবাণুঘটিত বা ইনফেকটিভ। সেটা হল হেপাটাইটিস ভাইরাস। এই ভাইরাস পাঁচটা এ, বি, সি, ডি এবং ই। যে পাঁচটা ভাইরাস আমাদের লিভারের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।
আরও পড়ুন-নতুন মরশুমে মেসিই নেতা, জানালেন কোচ
কীভাবে সংক্রমণ হয়
সবচেয়ে কমন হল হেপাটাইটিস ‘এ’। যেটাকে আমরা জন্ডিস বলি সেটা মূলত হেপাটাইটিস ‘এ’ ঘটিত। এটা পুরোপুরি খাবার এবং জলবাহিত। একদম র-ওয়াটার বা অপরিশোধিত জল, যে জলে ক্লোরিন দেওয়া নেই বা অ্যাকোয়াগার্ডের জল নয়, রাস্তার খোলা খাবার, কাটা ফল, রাস্তার ঠান্ডা সিরাপ, আখের রস, স্ট্রিট ফুডের ভাল করে না-ধোয়া থালাতে খাওয়া, এবং হাত ঠিকমতো না ধোয়া, এইসব ক্ষেত্রগুলো হেপাটিইটিস ‘এ’ এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস ‘ই’ হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট করে। তবে হেপাটাইটিস ‘ই’ খুব একটা কমন নয়।
এছাড়া হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ খাবারের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় না। রক্তের মাধ্যমে বা দেহরসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। অর্থাৎ একজন হেপাটাইটিস রোগীর দেহরস বা রক্ত যদি অন্যজনের সংস্পর্শে আসে তাহলে মিউকাস মেমব্রেন বা শ্লেষ্মা ঝিল্লির মধ্যে দিয়ে এই রোগ আসতে পারে।
আরও পড়ুন-ক্রীড়ানুষ্ঠানে কৃতি খেলোয়াড়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিচ্ছে বাংলার সরকার
ব্লাড ব্যাঙ্কের রক্তে হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘ই’, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সিফিলিস জাতীয় পরীক্ষাগুলো হয়ে থাকা আবশ্যিক। সেগুলো যদি কোনও কারণে করা না হয়ে থাকে এবং সেই অপরীক্ষিত রক্তে ওই জার্ম থাকা অবস্থায় কাউকে সেটি দেওয়া হলে তাঁর হতে পারে এই রোগ।
এছাড়া নিডল ইনজুরির কারণেও হেপাটাইটিস সংক্রমণ হয়। অর্থাৎ যে টেকনিশিয়ান রক্ত নিচ্ছেন, তিনি অজান্তে এমন কারও রক্ত নিচ্ছেন যাঁর হয়তো হেপাটাইটিস রয়েছে, সেই সুচ রক্ত টানার সময় হাতে ফুটে গিয়ে তাঁর শরীরে হেপাটাইটিস চলে আসতে পারে। এতে হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মায়ের যদি হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ থাকে, তবে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে সেই ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে। এটা মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমেও শিশুর শরীরে যেতে পারে।
এছাড়া যৌনসংসর্গ হলে অর্থাৎ কারও যদি হেপাটাইটিস পজিটিভ থাকে এবং তিনি যদি অসুরক্ষিতভাবে কারও সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হন, তাহলে তাঁর হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ হতে পারে।
আরও পড়ুন-‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ’ মোদির আক্রমণের জবাব দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
নন ইনফেকটিভ হেপাটাইটিস
এর মধ্যে পড়ে অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস যেটা নিয়মিত মদ্যপানের জন্য হয়, এবং অপরটি নন-অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস। এটা কিছু কিছু ক্রনিক রোগের জন্য, যেমন ক্রনিক ডায়াবেটিস আর কিছু অটোইমিউন ডিজিজের ক্ষেত্রে দেখা যায়। অর্থাৎ নিজের শরীরের অ্যান্টিবডিগুলোই শরীরের কোনও কোনও কোষকে ড্যামেজ করলে একে অটোইমিউন হেপাটাইটিসও বলে।
এছাড়া রয়েছে ড্রাগ ইনডিউজ হেপাটাইটিস। হাঁটুব্যথা, বয়সজনিত কারণে কোমরে ব্যথা, অস্ট্রিও-আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে অনেকে হয়তো একটানা পেইন কিলার খায়। বিশেষ করে প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ। এই গ্রুপের ওষুধ যদি কেউ নিয়মিত খায় তাহলে তা লিভার ড্যামেজ করতে পারে, যার ফলে হেপাটাইটিস হতে পারে। অর্থাৎ এককথায় ‘নন স্টেরয়ডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ড্রাগ’ গ্রুপের ওষুধ বেশি খাওয়া কখনওই উচিত নয়।
আরও পড়ুন-বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপদ রায়ের প্রয়াণে শোকপ্রকাশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর
উপসর্গ
অ্যাকিউট হেপাটাইটিসের কিছু উপসর্গ তখনই দেখতে পাওয়া যায়। আর ক্রনিক হেপাটাইটিস যা অনেকদিন ধরে থাকে। অ্যাকিউট হেপাটাইটিস ‘এ’ আর ‘ই’ ভাইরাসের কারণে হয়। গা-গোলানো, বমিভাব, হালকা জ্বর, সাদা স্টুল, খাবার দেখলে বমিভাব, এর থেকে চোখ হলদেটে, গা হলদে অর্থাৎ জন্ডিস হয়। হেপাটাইটিস ‘এ’ আর ‘ই’ এক থেকে দেড়মাসের মধ্যে নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়। সেইভাবে ওষুধপত্র দরকার হয় না। শুধু তেলমশলা এবং কম ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়া এবং বিশ্রামই প্রয়োজন।
হেপাটাইটিস ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’র জন্য অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ লাগে। এটা ছ’মাস, একবছর কি তার চেয়েও বেশি সময় ধরে থাকতে পারে। অ্যান্টিভাইরাল ট্রিটমেন্ট করতে হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সহজে ভাল হতে চায় না। এর পরিণতি হিসেবে সিরোসিস অফ লিভার বা লিভার ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
আরও পড়ুন-খোঁজ মিলল সেই তৃণমূলকর্মীর
ফ্যাটি লিভার থেকে যে হেপাটাইটিস হয় তার ক্ষেত্রে পেটের ডানদিকের উপরিভাগে ব্যথা হতে থাকে। ধারাবাহিক অ্যাসিডিটি, গলা-বুক জ্বালা, পেটের উপরিভাগে ভারী ভারী ভাব হয়। গা-গোলানো, বমিভাব, ডায়েরিয়া হয়। এক্ষেত্রে ওষুধ দিতে হবে এবং সঙ্গে ডায়াবেটিস থাকলে সেটা কন্ট্রোল করতে হবে। কিছু ডায়াবেটিসের ওষুধ রয়েছে যা ফ্যাটি লিভার থাকলে দেওয়া যায় না। চিকিৎসা ঠিকমতো না হলে সেখান থেকে সিরোসিস অফ লিভার এবং লিভার ক্যানসার পর্যন্ত গড়াতে পারে। এমনকী লিভার ট্রান্সপ্লান্ট পর্যন্ত করতে হতে পারে।
আরও পড়ুন-প্রয়াত বিজেপি বিধায়ক বিষ্ণুপদ রায়
প্রতিরোধ
হাইজিন বজায় রাখা।
বারবার হাত ধোয়া, স্যানিটাইজেশন-বিধি মেনে চলা।
বাইরের খোলা খাবার, জল না খাওয়া। বাড়ির বিশুদ্ধ জল সঙ্গে রাখতে হবে।
নকল মিনারেল ওয়াটারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে আইএসআই
মার্ক দেওয়া মিনারেল ওয়াটার খেতে হবে।
ক্লোরিন সলিউশন সঙ্গে রাখতে পারেন। একান্ত বাইরের জল খেতে হলে এক লিটার জলে এক থেকে দু’ফোঁটা ক্লোরিন ওয়াটার বা একটা ক্লোরিন ট্যাবলেট ফেলে আধ বা একঘণ্টা পরে সেই জল খাওয়া যেতে পারে।
এছাড়া যদি ব্লাড ট্রান্সফিউশন করতে হয় তাহলে দেখে নিতে হবে যে ব্লাড দেওয়া হচ্ছে সেটা পরীক্ষিত কি না।
যিনি পরীক্ষার জন্য রক্ত সংগ্রহ করছেন, তাঁকে গ্লাভস হাতে পরতে হবে রক্ত নেওয়ার সময়। কোনওভাবে নিডল ইনজুরি হয়ে গেলে হাত ভাল করে ধুয়ে এবং স্যানিটাইজ করে নিতে হবে। এতে সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে।
সুরক্ষিত ভাবে যৌনসংসর্গ করতে হবে।
মা এবং সন্তানের ক্ষেত্রে মাকে হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন দিয়ে দিলে গর্ভস্থ শিশুর সংক্রমণের সম্ভাবনা কমে যায়। আর শিশুর জন্মের পর তাকে হেপাটাইটিস ভ্যাকসিন দেওয়া আবশ্যিক।