আজ থেকে তিন লক্ষ বছর আগে মানুষের সর্বাধুনিক প্রজন্ম হোমো স্যাপিয়েন্সের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকায়। পরে তাঁরা পৃথিবীর অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় সেই সময় পৃথিবীতে হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়াও নিয়ান্ডারথাল মানুষরাও ছিল। তাঁরা বিলুপ্ত হয় ৪০ হাজার বছর আগে। অবশ্য তার আগে তাঁদের সঙ্গে হোমো স্যাপিয়েন্সের মিশ্রণ ঘটেছিল। তবে আজকের প্রসঙ্গ একটু অন্য।
আরও পড়ুন-‘পাপুয়া – নিউ গিনি আফ্রিকায়’ নতুন করে ভূগোল রচনা করলেন বিরোধী দলনেতা
এহেন মানবকুলের অনেক কাল আগে এক চরম সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল পৃথিবীর বুকে। সে অবস্থার কথা জানবার পর আজ আরও অবাক লাগে, কারণ পৃথিবীতে আমাদের, মানে এই মানুষ-প্রজাতির সংখ্যা আটশো কোটি পেরিয়ে গিয়েছে। অথচ ওই সময়টায় এমন এক পরিস্থিতি হয়েছিল যে এই মানুষ প্রজাতিটাই যাঁদের পোশাকি নাম হোমো স্যাপিয়েন্স তাঁরা টিকবে কি না সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রধান চিন্তার ব্যাপার। একেবারে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গিয়েছে ওই রকম এক সময়কার কথা, যখন গোটা পৃথিবী জুড়েই মানুষের সংখ্যা প্রচণ্ড পরিমাণে কমে গিয়েছিল নানা কারণে। সেই সময়কার কথাই বলব আজ।
আরও পড়ুন-৪ বাঙালি বিজ্ঞানীর ভাটনগর পুরস্কার জয়, শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর
আমরা বলছি আজ থেকে প্রায় ন-লক্ষ বছর আগেকার কথা, যখন পৃথিবীতে সন্তানধারণ করতে সক্ষম এমন মোট মানুষের সংখ্যা নেমে এসেছিল তেরোশোরও কমে। ভাবা যায়, গোটা পৃথিবীতে সব মিলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে দু-হাজারেরও কম সংখ্যক মানুষ! ওই রকম একটা পরিস্থিতি থেকে বহু লক্ষ বছর ধরে লড়াই করে তবে মানুষ একসময় হয়ে উঠল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রজাতিই শুধু নয়, অন্যদের দমিয়ে রেখে সংখ্যার দিক থেকেও হয়ে দাঁড়াল প্রথম সারির এক জীব। ইঁদুর বা পোলট্রি মুরগির সংখ্যা অবশ্য মানুষের চেয়ে বেশি, তবে অন্য কোনও স্তন্যপায়ী প্রাণীই আজ পৃথিবীতে এত সংখ্যায় আছে কি না সন্দেহ। আরও একটি হিসেব বলছে যে একটি প্রজাতির সমস্ত প্রাণীর মোট ভর (যাকে বলে বায়োমাস)-কে বিবেচনা করলে পৃথিবীতে মানুষের মোট যা বায়োমাস, তা অন্য যে কোনও প্রজাতির বায়োমাসের চেয়ে অন্তত একশো গুণ বেশি।
আরও পড়ুন-কাজ অনেক, সবাইকে নিয়ে ঝাঁপাতে চান উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের সভাধিপতি নারায়ণ গোস্বামী
সংকটটা ঠিক কী ধরনের ছিল?
গত অগাস্টের শেষের দিকে বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে জানা যাচ্ছে ওই সময়টায় এক লক্ষ বছরেরও বেশি সময়কাল জুড়ে অত সামান্য সংখ্যায় মানুষই মাত্র টিকেছিল এই পৃথিবীতে। একটা হিসেব বলছে যে গোটা মানবজাতির প্রায় ৯৮.৭ শতাংশেরই পূর্বপুরুষ ওই সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল পৃথিবী থেকে। কিন্তু ওই রকম এক সংকটজনক পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াল, নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের সংখ্যা বাড়াল শুধু নয়, অন্য প্রজাতির প্রাণীদেরকে জব্দ করে টিকে গেল এত দিন, সেটা নিয়ে এবার নতুন করে গবেষণা করবার সময় এসেছে বলে মনে করছেন ওই গবেষকেরা।
আরও পড়ুন-জানুয়ারিতে আইএফএ শিল্ড
এটাও খেয়াল করবার যে, ওই সময়কালে পৃথিবীর আবহাওয়াও ছিল যথেষ্ট প্রতিকূল। ওই কয়েকটা মাত্র মানুষ তখন কত প্রতিকূল পরিবেশ, বন্য জন্তুর আক্রমণ, খাবারের সংকট— এতকিছু সামলেও টিকে গিয়েছিল। আর ওরা টিকেছিল বলেই আজ এই পৃথিবী মানুষের কোলাহলে মুখরিত।
আরও একটা ব্যাপার, তখনও মানুষ আগুনের ব্যবহার জানত না। সেটা জেনেছে আরও কয়েক হাজার বছর পর, মোটামুটি সাত লক্ষ আশি হাজার বছর আগে। তখন থেকে মানুষ কাঁচা খাবার ঝলসে খেতে শেখে। ওই সংকটজনক পরিস্থিতির পর মানুষের সংখ্যা যে দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করেছিল, সেটার পেছনে প্রধান একটা কারণ ছিল এই রান্না করে খেতে শেখাটা এবং আগুন দিয়ে বন্য পশুদের ভয় দেখিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারাটা।
আরও পড়ুন-গান্ধী হত্যাকারীদের মুখে নয়া হুমকি
কীভাবে জানা গেল এত কিছু?
এই পুরো ব্যাপারগুলো জানবার কাজে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে কম্পিউটারের মাধ্যমে মানুষের শরীরের জিনোম সিকোয়েন্সিং তৈরি করে সেটাকে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করাটা। বহু হাজার বছর ধরে মানুষের শরীরের বিভিন্ন জিন কীভাবে বদলেছে, বা বলা ভাল রূপান্তরিত হয়েছে, সেটাই ওঁরা বহু দিন ধরে বিশ্লেষণ করেছেন প্রায় তিন হাজার জন মানুষের দেহ থেকে সংগ্রহ করা জিনের কম্পিউটার মডেল বানিয়ে। এই মানুষদের মধ্যে দশ শতাংশ আফ্রিকান, বাকিরা অন্য মহাদেশের। ওঁদের জিনে থাকা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যই এই আবিষ্কারের পেছনে মুখ্য ভূমিকা নেয়।
আরও পড়ুন-লাদাখে বিশ্বের সর্বোচ্চ ফাইটার এয়ারফিল্ড ভারতের
এখানে আর একটা প্রশ্ন অবশ্যই আমাদের মনে আসে, ওই যে অল্প সংখ্যক মানুষ তখন টিকে ছিল, ওরা থাকত ঠিক কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে বিভিন্ন মহাদেশ থেকে পাওয়া জীবাশ্মদেরকে নেড়েচেড়ে দেখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। এখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে এটা বলা যায় যে ওই সময়কালে, মানে ওই আট লক্ষ থেকে ন-লক্ষ বছরের কিছু বেশি আগেকার সময়সীমায় মানুষ ছড়িয়ে ছিল আফ্রিকা এবং চিন, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, ইতালি, স্পেন আর ইউরোপের আরও কয়েকটি জায়গা জুড়ে। তবে এটাও গবেষকেরা খেয়াল করেছেন যে ওই সব এলাকায় পাওয়া জীবাশ্মের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট সময়কালে (যখন মানুষের সংখ্যা নেমে গিয়েছিল প্রচণ্ড) বেঁচে ছিল এমন প্রজাতির মানুষের সংখ্যা একেবারেই কম। যা ওঁদের গবেষণার সফলতাকেই প্রমাণ করে।
আরও পড়ুন-৩০ কোটি টাকার কেলেঙ্কারি, চিটফান্ড খুলে প্রতারণা, ধৃত বিশ্বভারতীর বাংলার ছাত্রী
ঠিক এরকমভাবে মানুষ প্রজাতিটাই আরও একাধিকবার অস্তিত্বের সংকটের মুখে পড়েছে, ইতিহাস আমাদের জানায় তা। সত্তর হাজার বছর আগেও এক প্রকাণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের পর গোটা পৃথিবী জুড়েই নেমে এসেছিল বিপর্যয়, যার প্রভাবে পরে পৃথিবী হয়ে পড়ে অত্যধিক শীতল। আর ওই শীতল পৃথিবীতে মানুষ কমতে শুরু করেছিল মারাত্মকভাবে। পরে অবশ্য সে-সব বিপর্যয়ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে আদিমানবেরা।
কিন্তু ওইসব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে আমরা এতদিন টিকে থাকলেও আগামী দিনে পরিবেশগত বা আমাদের আচরণগত যে-সব সমস্যা আমাদের অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে ফেলছে প্রতিনিয়ত, তাতে এই মানবজাতি আর কতদিন টিকবে, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।