যাঁরা এতদিন ধরে বলছিলেন ‘ইন্ডিয়া’ জোট থেকে কে কে আগে বেরিয়ে যাবে। যারা সব দোষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করেছে। যেটা তারা বরাবর করে এসেছে। কিন্তু এখন দেখা গেল অতীতের যেকোনও সময়ের মতো দেশের চাইতে দলের স্বার্থ দেখে সিপিআই(এম) জোটের বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছে। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সমন্বয় কমিটিতে তাঁরা থাকবেন না ঠিক করেছেন। তাঁদের এটা পার্টির ব্যাপার, তাঁরা তাঁদের মতো সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু তার পরেও কয়েকটি কথা থেকে যায়। উত্তর কিন্তু সিপিআই(এম)কে দিতে হবে। না, আমাদের কাছে বা ইন্ডিয়া জোটের কাছে নয়। দেশের মানুষের কাছে।
আরও পড়ুন-মাঠে ফিরেই ফের চোট পেলেন মেসি
সমন্বয় কমিটি যখন গঠন হয় তখন সিপিআই(এম)-এর প্রতিনিধি থাকবেন সেটা ঠিক হয়েছিল। নামটা দিতে পারেননি সীতারামজি। তিনি বলেছিলেন পার্টির পলিটব্যুরোতে আলোচনা করে দেবেন। সবাই নাম দিয়ে দিল। এমনকী সিপিআইও। কিন্তু সীতারামজি এমন দলের এমন সাধারণ সম্পাদক যে তিনি নিজ ইচ্ছায় একটা নাম পর্যন্ত কোনও কমিটিতে দিতে পারেন না। সারা ভারতে এই দলের ভোট সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ। সাধের পশ্চিমবাংলায় ৫ শতাংশ। এখানে আবার যে আসনে লড়ছেন সেখানে জামানত জব্দ হয়ে যাচ্ছে। কার্যত প্রায় সব আসনে ভোট কাটুয়া হয়ে যাচ্ছেন। জামানত খোয়াচ্ছেন। সাম্প্রতিককালের ধূপগুড়ি বিধানসভার উপর নির্বাচন সে কথা বলছে। ৫০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েও তৃণমূল কংগ্রেসের জয় আটকানো যায়নি।
আরও পড়ুন-ফর্মে ফিরতে সিন্ধুর প্রেরণা কিং কোহলি
দ্বিতীয় কথা হল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র লক্ষ্য বিজেপির পরাজয় ত্বরান্বিত করা এবং দেশকে বাঁচানো। এমনকী নেত্রী একথাও বলেছেন— বিজেপি সরকার আর মাত্র দু’মাস। এটাই তাঁর আত্মবিশ্বাস। আবার ঠিক সেই কারণেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ধূপগুড়ি জনসভায় কংগ্রেস বা সিপিআই(এম) সম্পর্কে প্রায় কিছু বলেননি। সিপিআই(এম)কে যে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তা হল তাঁদের তথাকথিত বিজেপি বিরোধিতার কী হল? তাঁরা এখনও বিজেপিকে ফ্যাসিস্ত দল বলতে চান না। কারণ বহুবছর আগে এক সোভিয়েত তাত্ত্বিক ‘ফ্যাসিস্ত’ শব্দের যে সংজ্ঞা বেঁধে দিয়েছিলেন তা ভারতের সঙ্গে হুবহু মিলছে না। সিপিআই(এম) তো সেই বহু দশক আগের দিনে পড়ে আছে। তারা নাকি তৃণমূল ও বিজেপিকে একসঙ্গে হারাবে। অথবা তৃণমূলকে পরাজিত করে, বিজেপিকে হারাবে। ভোট কিন্তু মাত্র ৫ শতাংশ।
আরও পড়ুন-পুজোয় নজর কাড়বে মির্জাপুরের কপার জরি, স্বর্ণচরি, বালুচরি
তাদের একথা বলার অর্থ নিজের ভোটটা সময়মতো বিজেপিকে দিয়ে দেওয়া। গত লোকসভা নির্বাচনে তাই করেছে। তাদের পার্টির দলিলে একথা লেখা আছে। নামের সঙ্গে কমিউনিস্ট কথাটা লেখা আছে অথচ বিজেপির বন্ধু হয়ে গেল দলটি। এটা মর্মান্তিক অথবা নেতৃত্বের নিষ্ঠুর চালাকি। তাহলে দাঁড়াল তৃণমূলের দোহাই দিয়ে বিজেপিকে সমর্থন। সুতরাং সমন্বয় কমিটিতে থাকলে সেটা ঠিকমতো করা যাবে না। সেই কারণে ‘না’।
তাহলে বিজেপিকে দেশ থেকে উৎখাত করার যে স্লোগান এতদিন দিয়ে আসছিলেন সেটা কতখানি শূন্যগর্জন তা বোঝা যাচ্ছে। দেশের চাইতে দল যে বড় তা সিপিআই(এম) নেতারা প্রমাণ করলেন।
আরও পড়ুন-যানজট ঠেকাতে টোটো নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রশাসনের
কথায় কথায় সিপিআই(এম) নেতারা অতীতের কথা স্মরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেলুলার জেল, নেতাদের বন্দিজীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলি অবশ্যই ভাল এবং শিক্ষণীয় এবং ইতিহাসের অঙ্গ। এগুলি কেবলমাত্র সিপিআই(এম)-এর সম্পদ নয়। দেশের সব মানুষের সম্পদ। কিন্তু এই নেতাদের জীবন থেকে সিপিআই(এম) কোনও শিক্ষা গ্রহণ করল কি? একেবারেই করেনি। কারণ এঁরা সবাই ছিলেন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদে বিশ্বাসী। আজ দেশে বিজেপির হাতে এগুলোই আক্রান্ত। আর সিপিআই(এম) সেই বিজেপিকে ভোট চালান করছে। বিজেপির বিরুদ্ধে যে জোট সেখান থেকে পলায়ন করছে। দেশের মানুষের কাছে তো বটেই, অতীতের লড়াইয়ে যাঁরা আত্মবলিদান করেছেন তাঁদের কাছেও এমন অবিমৃশ্যকারিতার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ এই বীর সেনানীরা দেশের জন্য জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যে পরিণত করেছিলেন। সিপিআই(এম) তাঁদের প্রতি অসম্মান দেখাচ্ছে। যে কোনও এমন কাজে সিপিআই(এম) সবসময় একটা তাত্ত্বিক মোড়ক দিতে ওস্তাদ। যেমন বলছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট নির্বাচনী জোট নয়। তবে সমন্বয় কমিটিতে না থাকার কারণ এ ধরনের কোনও ‘স্ট্রাকচারাল কমিটি’তে তাঁরা থাকবেন না। নিজেদের কৃষক-শ্রমিকের পার্টি বললেও নেতারা সব জেএনইউ পাশ অথবা বিলেত ফেরত। ফলে দেশের মানুষের ভাষা ও দেশের মাটির গন্ধ তাঁরা বুঝতে পারেন না। যেমন আজও বুঝতে পারেন না কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, সাদাসিধা ওই মহিলাকে এত লোকে, দেশে-বিদেশে পছন্দ করে?
আরও পড়ুন-ই-বাস চলবে মালদহ শহরে
সারা দেশে ২ শতাংশ ভোট, পশ্চিমবাংলায় জামানত জব্দ, কেরলে একটা সরকার, স্ট্যালিনের আশীর্বাদে লোকসভায় ২ জন সদস্য নিয়ে সিপিআই(এম) ইন্ডিয়া জোটের কর্তৃত্ব নিতে চায়। সেটা কী করে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস তো কর্তৃত্ব চায়নি। বরং বলেছে যে, এখন থেকে আসন ভাগাভাগি নিয়ে কথা হোক। সময় নষ্ট করার কোনও দরকার নেই। আর যে যেখানে শক্তিশালী সেখানে তাদের বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে দেওয়া হোক। তিনটে বিষয় ইন্ডিয়া জোটে গৃহীত বিষয়। সিপিআই(এম)-এর ভয় এখানেই। তাহলে পশ্চিমবাংলায় কী হবে? কিচ্ছু হবে না, তাঁরা হারবেন। একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেবেন পলিটব্যুরো এই মাত্র। ভোট নেমে যাবে ৫-এর নিচে। শুধু মনে করিয়ে দিই ৩০-এর দশকে ইউরোপে ফ্যাসিবাদ রুখতে সবকে একসঙ্গে নিয়ে মাঠে নামা হয়েছিল। জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টি জোট না করার জন্য হিটলারের দল জিতে গিয়েছিল। বাকিটা সবাই জানে। ভারতে সিপিআই(এম)-এর সেই ক্ষমতা নেই। কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি নেই। তাই সমন্বয় কমিটিতে ‘না’ শোনা গিয়েছে। মানুষের কাছে জবাব ওদের দিতে হবে।