নিজের ঘর
‘‘বাইরে থাকুন বা বিদেশে, ঘরে ফেরা সবসময়ই বিশেষ হয়৷ কলকাতা ঘরে ফেরার মতো৷”— একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন অভিনেত্রী তনুজা। মুম্বইয়ের মারাঠি পরিবারে জন্ম। দাম্পত্য সঙ্গী ছিলেন শমু মুখোপাধ্যায়। প্রবাসী বাঙালি। জামালপুরের মানুষ। তবু তনুজা কলকাতাকেই নিজের ঘর মনে করেন। অবাঙালি হয়েও তিনি মনেপ্রাণে বাঙালি। মুখোপাধ্যায় পরিবারের বধূ হয়েছিলেন কি নিখাদ বাঙালি প্রেমের জন্য? তনুজা বলেছেন, ‘‘বাঙালিকে বিয়ে করব এমন কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। বিয়ে করেছিলাম ভালবেসে। প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে।”
আরও পড়ুন-দুয়ারে ডাক্তার কর্মসূচিতে সাড়া পড়ে গেল পূর্বস্থলীতে
রক্তে অভিনয়
অভিনয় ছিল তাঁর রক্তে। দিদিমা রত্তন বাই ছিলেন নির্বাক যুগের বিখ্যাত অভিনেত্রী। মা শোভনা সমর্থ চল্লিশের দশকের অন্যতম অভিনেত্রী। বাবা কুমারসেন সমর্থ ছিলেন পরিচালক। বড় দিদি নূতনও অভিনেত্রী হিসেবে সাফল্য পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন তনুজা। ১৯৫০ সালে প্রথমবার ছবিতে অভিনয় করেন। নাম ‘হামারি বেটি’। তনুজা তখন ‘বেবি তনুজা’। বয়স মাত্র সাত। দশ বছর পরে বলিউডে প্রকৃত অভিষেক হয় তাঁর। ১৯৬০ সালে মায়ের পরিচালনায় ‘ছাবলি’ সিনেমায়। সঙ্গী ছিলেন দিদি নূতন। তারপর তনুজা অভিনয় করেন ‘হামারি ইয়াদ আয়েগি’ ছবিতে। ছবিটি যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।
আরও পড়ুন-ফর্মে ফিরতে সিন্ধুর প্রেরণা কিং কোহলি
মহানায়কের নায়িকা
১৯৬৩ সালে তনুজা আত্মপ্রকাশ করেন বাংলা ছবিতে। মহানায়ক উত্তমকুমারের বিপরীতে। ছবির নাম ‘দেয়া নেয়া’। প্রযোজক এবং সংগীত পরিচালক ছিলেন শ্যামল মিত্র। মিউজিক্যাল ফিল্ম বলা যেতে পারে। কারণ গানই ছিল প্রধান। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রশান্তকুমার রায়। তিনি গান করেন অভিজিৎ চৌধুরী নামে। সেই তিনিই নায়িকার বাড়িতে গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেন হৃদয়হরণ নামে। এই চরিত্রে ছিলেন মহানায়ক। তাঁর নায়িকা সুচরিতা। সুচিত্রা বা সুপ্রিয়া নন, এই চরিত্রে নির্বাচন করা হয়েছিল তনুজাকে। সেইসময় গুঞ্জন ছড়িয়েছিল, অবাঙালি নায়িকা তো বাংলা বলতেই পারবেন না। কিন্তু পর্দায় চোখ রাখতেই সবাই অবাক। অবাঙালির মতো উচ্চারণ মনে হচ্ছে না তো। তাহলে বোধহয় কাউকে দিয়ে ডাবিং করানো হয়েছে। শেষমেশ জানা যায়, নিজেই নিজের ডাবিং করেছেন তনুজা। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বলিউড তো বটেই, বাংলার আপামর দর্শকের কাছেও তিনি হয়ে ওঠেন প্রিয় নায়িকা। পরবর্তী সময়ে উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘রাজকুমারী’ ছবিতে। দুটি বাংলা ছবিতেই তাঁর অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো।
আরও পড়ুন-প্রকল্পে খরচ হল ৬ কোটি ৯ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা, জল সমস্যা মেটাল তৃণমূল
সৌমিত্রর সঙ্গে জুটি
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তনুজার জুটিও সমাদৃত হয়েছিল। তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তনুজা সৌমিত্রকে বরাবরই প্রিয় বন্ধু মনে করে এসেছেন। এই জুটির নাম উঠলে প্রথমেই যে ছবিটির কথা মনে আসে, সেটা হল ‘তিন ভুবনের পারে’। চোখের সামনে ভেসে ওঠে তনুজাকে দেখে সৌমিত্রর সেই বিখ্যাত ট্যুইস্ট এবং এভারগ্রিন গান : ‘কে তুমি নন্দিনী?’ এই জুটি আবার ফিরে আসেন ‘প্রথম কদম ফুল’ ছবিতে। আটপৌরে ঘরোয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। সঙ্গে অপূর্ব সব গান। সৌমিত্র এবং তনুজা এরপর অভিনয় করেন ‘চেনা অচেনা’, ‘অপর্ণা’, ‘আগুন’, ‘সোনার পাহাড়’ ছবিতে। উত্তমকুমার, সৌমিত্রর পাশাপাশি তনুজা বাংলায় অভিনয় করেছেন রঞ্জিত মল্লিক এবং ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতেও। কোনও ছবি বাণিজ্যিক, কোনও ছবি অন্য ধারার। প্রতিটি ছবিই সমাদৃত হয়েছে। সবথেকে বড় কথা, সবক’টি বাংলা ছবিতে নিজের ডাবিং নিজেই করেছেন তনুজা।
আরও পড়ুন-ই-বাস চলবে মালদহ শহরে
বলিউডে সাফল্য
ছয় এবং সাতের দশকে বলিউডে অসংখ্য হিট উপহার দিয়েছেন তনুজা। সুপারস্টার রাজেশ খান্নার বিপরীতে ‘হাতি মেরে সাথী’, ‘মেরে জীবন সাথী’ হয়েছিল সুপারহিট। অভিনয় করেছেন দেব আনন্দ, সঞ্জীব কুমার, ধর্মেন্দ্র, আমজাদ খান, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গেও। ‘জুয়েল থিফ’, ‘বাহারে ফির ভি আয়েঙ্গি’, ‘অনুভব’, ‘ইয়ারানা’ প্রভৃতি ছবিগুলো আজও রয়েছে দর্শকদের পছন্দের তালিকায়। সুন্দরী ছিলেন তনুজা। তবে রূপসী নায়িকার ঘেরাটোপে আটকে থাকতে চাননি। হতে চেয়েছিলেন সু-অভিনেত্রী। তারজন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। নায়িকার পাশাপাশি তিনি কাজ করেছেন চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেও। পিক ফর্মে থাকার সময়েই। মাঝে কিছুদিন বিরতি নিয়েছিলেন। আবার ফিরেছেন ক্যামেরার সামনে।
আরও পড়ুন-সংঘাত তুঙ্গে, কানাডার নাগরিকদের ভিসা দেওয়া বন্ধ করল ভারত
ভাল আছেন
জীবনে বহু ঝড়ঝাপ্টা এসেছে। একটা সময় শমু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরেছিল। অবশেষে বিচ্ছেদ। সিঙ্গল মাদার হিসেবে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। ২০০৮-এ না ফেরার দেশে চলে যান শমু। তনুজা কোনওরকম আঁচড় লাগতে দেননি দুই কন্যা কাজল এবং তানিশার গায়ে। একা হাসিমুখে সবদিক সামলেছেন। কাজল বলিউডে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার পিছনে তনুজার অবদান অস্বীকার করা যায় না। তিনি প্রতি মুহূর্তে সমর্থন এবং উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন মেয়েকে। কাজলের প্রথম ছবি ‘বেখুদি’। সেই ছবিতে তনুজা কাজলের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। যদিও একটি সাক্ষাৎকারে তনুজা জানিয়েছেন, ‘‘আমি অভিনয় করতে চাইনি কাজলের মায়ের ভূমিকায়। আমাকে একপ্রকার জোর করেই রাজি করানো হয়েছিল।” ছোট মেয়ে তানিশাও কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। তবে সাফল্য পাননি। বড় জামাই অজয় দেবগন বলিউডের অন্যতম স্তম্ভ। সবকিছু নিয়ে এই মুহূর্তে ভালই আছেন তনুজা। সুখেই আছেন। প্রকাশ্যে আসেন কম। মাঝেমধ্যে অভিনয় করেন কোনও কোনও ছবিতে। বিশেষ অনুরোধে। অংশ নেন মুম্বইয়ে পারিবারিক দুর্গাপুজোয়। শমুর সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও, মুখোপাধ্যায় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি তাঁর। ১৯৪৩-এর ২৩ সেপ্টেম্বর জন্মানো ৮০-র তনুজা আজও জনসমক্ষে এলে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে অতীতের নন্দিনী…