রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার একটি বিভাগ আছে, যেটির নাম ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ, সংক্ষেপে ডিইপিআর। সেই দফতর তাদের ২০২২-২৩-এর প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০৩৩ নাগাদ ভারতের জিডিপি বিপন্ন হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরম কিংবা ঠান্ডার অত্যধিক প্রাবল্যের দরুণ। নির্মাণ ও পরিষেবার মুখ্য কেন্দ্র সমূহে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যদি বিবেচনা করা হয়, তবে এই বিপন্নতার বহর আরও বৃদ্ধি পাবে, সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন-সুসম্পাদিত দুটি শারদ পত্রিকা
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উৎপাদন ব্যয়ের যে চারটি বিষয় বিশেষভাবে প্রভাবিত হয় সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসবে উৎপাদিকা ব্যয়ের প্রসঙ্গ। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার কারণে যে সময় নষ্ট হয়েছে, সেই ক্ষতি পূরণ করার জন্য কর্মীরা মাত্রাতিরিক্ত মেহনত করে। ফলে একদিকে যেমন তাদের শরীর ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে ওরকম ক্ষেত্রে কাজ করতে শ্রমিকরা নিরুৎসাহিত বোধ করে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং, সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট ইত্যাদির মতো যেসব ক্ষেত্রে মানসিক উৎপাদনশীলতার দরকার সবচেয়ে বেশি, সেইসব ক্ষেত্রে এ-ধরনের অসুবিধা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন-পেশাদারি রঙ্গালয়ের ১৫০ বছর
বায়ু দূষিত হলে ভোক্তাকেন্দ্রিক অর্থনীতিও বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। কারণ, ভোক্তারা তখন বাড়ির বাইরে বের হতে চায় না। ২০১৯-এ উপভোক্তাকেন্দ্রিক ব্যবসার ২২০০ কোটি ডলার মুনাফা করত যদি দূষণের স্তর একটু কম হত। দূষণের কারণে সেবছর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জামাকাপড় এবং খাবারের ব্যবসা।
বায়ুদূষণ বাণিজ্যিক সম্পদের আয়ু কমিয়ে দেয়। সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো দূষণকারী বস্তু বিদ্যুৎ সার্কিটের মতো জিনিসগুলোর ক্ষতি ত্বরান্বিত করে। এর ফলে তথ্য-প্রযুক্তির সম্পদগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষিজ উৎপাদনে ৫ থেকে ১২ শতাংশ ক্ষতির কারণ এই বায়ুদূষণ।
বায়ুদূষণের ফলে অকালমৃত্যু হয়। তার ফলেও অর্থনীতির ক্ষতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। ২০১৯-এ ভারতে ১৮ শতাংশ মৃত্যুর কারণ ছিল বায়ুদূষণ। এর ফলে ৩৮ লক্ষ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে।
আরও পড়ুন-আজ মহারণ, অপেক্ষা শুধু বিরাট সেঞ্চুরির
এই বছর জুন মাসে বিশ্বব্যাঙ্ক কর্তৃক প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে প্রকাশ, বায়ুদূষণ উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি শ্রম সরবরাহ-সহ বিভিন্ন অর্থনীতিক বিষয়সমূহকে প্রভাবিত করে। ২৫টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫৫০টি জেলায় সমীক্ষ চালিয়ে এটা দেখা গিয়েছে। যে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে সেগুলি ভারতের মোট জিডিপির ৯০ শতাংশের জন্য দায়ী।
২০২১-এ ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ শীর্ষক একটি গবেষণাপত্র দেখায় বায়ুদূষণের কারণে ভারতের মৃত্যুহার এবং অসুস্থতার হার বিভিন্ন রাজ্যের উৎপাদনশীলতা ০.৬৭ শতাংশ থেকে ২.১৫ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যসমূহ।
আরও পড়ুন-যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উড়িয়ে গাজার অ্যাম্বুল্যান্সে হামলা ইজরায়েলের
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের ৫০ শতাংশ জিডিপির জোগান দেয় এমন সব কাজ যেগুলো তাপপ্রবাহের মোকাবিলা করে করতে হয়। পক্ষান্তরে ইউরোপের ২৫ শতাংশ জিডিপি আসে এরকম অর্থনৈতিক কর্ম থেকে।
অপর একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ভারতের ব্যবসাগুলো বছরে প্রায় ৯,৫০০ কোটি ডলার (১ ডলার = প্রায় ৮৩ টাকা) ক্ষতি স্বীকার করছে স্রেফ বায়ুদূষণের কারণে। অঙ্কটা ভারতের মোট জিডিপির প্রায় ৩ শতাংশ।
২০২১-এর সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছিল— (১) নভেম্বর থেকে জানুয়ারি, যখন বায়দূষণের মাত্রা বছরের মধ্যে সর্বাধিক তখন মুম্বইয়ের লিঙ্কিং রোডে বাজার-দােকানে ক্রেতার হার ৫ শতাংশ কমে যায়; (২) একটি সোলার প্যানেল উৎপাদক সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশ ওই সময় তাদের উৎপাদনশীলতা ১৩ শতাংশ হ্রাস পায়, (৩) বেঙ্গালুরুর প্রযুক্তি হাব হোয়াইট ফিল্ড কর্পোরেট জোনে উৎপাদনশীলতা ওই সময় ৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ কমে যায়।
আরও পড়ুন-শহরের বাজারগুলিতে টাস্কফোর্সের অভিযান অব্যাহত
বায়ুদূষণের দাম চােকাতে হয় আমাদের আট ডজন উপায়ে। (১) উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, (২) ক্রেতার সংখ্যা হ্রাস পায়, (৩) সম্পদ সৃষ্টির ক্ষমতা হ্রাস পায়, (৪) স্বাস্থ্য-বিষয়ক খরচ বৃদ্ধি পায়, (৫) কল্যাণখাতে ক্ষতি বৃদ্ধি পায় এবং (৬) অকালে মৃত্যু হয়।
পৃথিবীর সর্বাধিক দূষিত বায়ু সম্পন্ন ৩০টি শহরের ২০টি ভারতে। এদের মধ্যে শীর্ষে আছে দিল্লি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বলছে, এদেশে কর্মসংস্থান সৃৃষ্টি বহুলাংশে ঘরের বাইরের কাজ, যেমন চাষবাস, নির্মাণ কাজ, নিরাপত্তা প্রদানের কাজ, পণ্য ইত্যাদি বিলি প্রভৃতি। এগুলো তো বটেই এমনকী গৃহের অভ্যন্তরে কল সেন্টারের কাজেও উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয় দূষণের কারণে।
সুতরাং বায়ুদূষণ নিয়ে হেলাফেলা করলে, তা নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক না হলে, সেটা আমাদের দেশের পক্ষেই ভীষণ খারাপ হবে। এ-নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবেই, আমাদেরকেও ভাবতে হবে। নিছক মিটিং-মিছিল, সেমিনার আর পাতা জোড়া বিজ্ঞাপনে কাজ হবে না।
“There’s so much pollution in the air now that if it weren’t for our lungs there’d be no place to put it all.” যিনি এই কথাটি বলেছিলেন, তিনি ভুল কিছু বলেননি।