নতুন ভারতের ঘোষণায় যখন কর্মসংস্থানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় তখন ২০১৪ সালে কোটি কোটি চাকরির ঘোষণার কথা মনে পড়ে। এ যেন সুকুমার রায়ের সেই খুড়োর কল; চোখের সামনে গাজর ঝুলছে— যতই দৌড়াও খাবার পাবে না। মানে চাকরির কথা বারবার বলা হবে, বাস্তবে নতুন চাকরি তৈরি হবে না। মোদি সরকার বস্তুত মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও তথ্যের ভোজবাজির সরকার।
আরও পড়ুন-ভরা মাঠে জাতীয় সঙ্গীত গায়ে কাঁটা দেয় : বিরাট
২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি ১৩ বার কর্মসংস্থানের কথা উল্লেখ করে। তারা আগের সরকারের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করে বছরে কোটি কোটি চাকরির ঘোষণা করে। কিন্তু ২০১৯ সালে যখন ভারতের প্রাচীন তথ্য সরবরাহ সংস্থা এনএসএসও তথ্য দেয় ৪৫ বছরে ভারতের সবথেকে বেশি বেকারত্ব সেই সময় চলছিল; তখন দ্বিতীয়বারের মোদি সরকার এনএসএসও-এর বিলোপ সাধন করে। আবার সার্বিক বেকারত্বের হার নিয়ে সিএমআইই যখন কোনও নেতিবাচক (!) (সত্যি) তথ্য প্রদান করে তখন বিজেপি তা অস্বীকার করে।
আরও পড়ুন-ভোটের আগের দিন নকশাল হামলা ছত্তিশগড়ে, জখম BSF জওয়ান-সহ ৩
আসলে মোদি সরকার এক মিথ্যার জাল বুনে চলেছে। বছরে ২ কোটি চাকরির কথা হলে ৯ বছরে ১৮ কোটি চাকরি হওয়ার কথা। এর মধ্যে প্রথমেই যদি সরকারি চাকরির তথ্য তালাশ করা যায় দেখা যাবে ২০১৪ সালে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে ৪৭ লক্ষ স্থায়ী বেতনভুক কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী কাজে যুক্ত ছিল (সূত্র : পিটিআই)। কেন্দ্র সরকারের তথ্য অনুযায়ী (আনুয়াল রিপোর্ট অন পে অ্যান্ড অ্যালাউন্স) ২০২০ সালের মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৪১.১ লক্ষ (প্রায়) তার মধ্যে কাজ করছে ৩১.১ লক্ষ (প্রায়) অর্থাৎ প্রায় ১০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীর পদ ফাঁকা বা খালি। ওই একই রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালের মার্চ মাস অবধি ৩০. ৫৫ লক্ষ কর্মী কর্মরত ছিলেন। মানে শূন্য পদের সংখ্যা বেড়ে যায়। লক্ষণীয় ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল অবধি বিরাট আকারে কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির অনুমোদিত পদ খারিজ হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী ভারতের সবথেকে বড় কর্মসংস্থানের জায়গা রেলে ২০২২ সালে ৭২ হাজার পদ অবলুপ্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন-১৯ নভেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড টেরর কাপ’ খেলে দেখাব, এয়ার ইন্ডিয়া বিমান ওড়ানোর হুমকি পান্নুর
রাজ্যসভায় ২০২২ সালের শীতকালীন অধিবেশনে এক প্রশ্নের উত্তরে কর্মী দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং বলেন কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রক ও দফতরে এ, বি ও সি গ্রুপে যথাক্রমে ২৩৫৮৪, ১১৮৮০৭ এবং ৮৩৬৯৩৬টি পদ ফাঁকা আছে। উল্লেখ্য সেখানে গ্রুপ ডি’র কোনও তথ্য ছিল না। কিন্তু প্রশাসনের ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস অনুযায়ী গ্রুপ ডি কর্মীর সংখ্যাই বেশি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এই সরকার একদিকে কর্মী সংকোচন করছে অন্যদিকে চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী কর্মীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। আবার ২০১৮ সালের মার্চে লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন পৌর ও জেলা সশস্ত্র পুলিশ কেন্দ্রীয় বাহিনীতে ৪.৪ লাখ আসন ফাঁকা। একই সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে ১০ লাখ শিক্ষকের পদ ফাঁকা ছিল।
আরও পড়ুন-‘আমার প্রচার চাই না’ বিজয়া সম্মিলনী থেকে কেন্দ্রকে নিশানা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
অন্যদিকে, গুজরাটে ভোট চলাকালীন ২০২২ সালে অক্টোবর মাসে মোদি সরকার রোজগার মেলা করে দু-দফায় ৭৫ হাজার ও ৭১ হাজার নিযুক্তিপত্র বিলি করে। তাদের অনেকেই এখনও কাজে যোগ না দিতে পারলেও যে সময়ে অর্থাৎ ভোটকালীন সময়ে মোদি সরকারের তরফে এহেন কর্মসূচি ভোট ব্যাঙ্ককে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যেই সাধিত হয়েছে বলে বলা যায়। রোজগার মেলাতেই লিখিত ও ঘোষিতভাবে জানানো হয় ২০২৩-এর মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরি প্রদান করা হবে কিন্তু তথ্য অনুযায়ী মোদি সরকার ২০২৩-এর অক্টোবর মাস অবধি ৫০ হাজার চাকরিও দিতে পারেনি। আইএএস-আইপিএস পদে ২৩০০, রেলে ২ লক্ষ ৯৩ হাজার, স্বরাষ্ট্র দফতরে ১ লক্ষ ৪৩ হাজার, ডিফেন্সে ২ লক্ষ ৪৭ হাজার, এবং পোস্টালে ৯০ হাজার চাকরির সুযোগ রয়েছে।
আরও পড়ুন-আজ ভবানীপুরে বড় কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
উল্লেখ্য, উক্ত ঘোষণায় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বা বিশ্ববিদ্যালয় সেই সঙ্গে সরকারি ব্যাঙ্কের ও অন্যান্য অনুমোদিত পদের কোনও উল্লেখ ছিল না। ২০১৩-’১৪ সালে সরকারি ব্যাঙ্কে মোট কর্মিসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ লক্ষ ৯০ হাজার যা ২০২১-’২২-এর শেষে দাঁড়ায় ৭.৬ লক্ষ। মনে রাখতে হবে মোদি সরকার ব্যাঙ্ক সংযুক্তীকরণ করে কর্মীসংকোচন করেছে। আবার শিক্ষায় চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক বেড়েছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে লোকসভায় দেওয়া কর্মী ও প্রশিক্ষণ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ থেকে ২০২২ অবধি ৭ লক্ষ ২২ হাজার কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির জন্য প্রায় ২২ কোটি ৬ লাখ দরখাস্ত জমা পড়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে আগ্রার এক নির্বাচনী সভায় তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন আগের ইউপিএ সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী বছরে ১ কোটি চাকরি দিতে ব্যর্থ। বিজেপি ক্ষমতায় এলে বছরে ১ কোটি চাকরি দেওয়ার ঘোষণা যদি সত্যি হত তাহলে ১৮ কোটি ছাড়ুন এই ৯ বছরে অন্তত ৯ কোটি চাকরি দিতে পারত কিন্তু তথ্য তা বলছে না! এখান থেকেই পরিষ্কার ভারতে বেকারত্বের হার কতটা এবং সরকারের তথ্যের ভোজবাজির বহর কেমন!
আরও পড়ুন-বেহালায় বাস দুর্ঘটনা, আহত একাধিক
তথ্যের ভোজবাজি কতটা ভয়ঙ্কর তা প্রধানমন্ত্রীর দুটি বক্তব্যের উদাহরণে পরিষ্কার করা যায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেটওয়ার্ক ১৮-এর রাইজিং ইন্ডিয়া সামিটে মোদি বলেন তাঁর সরকার বছরে ১.২ কোটি চাকরি দিয়েছে। আবার সেই মোদি ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বারাণসীর আসি ঘাটে ইন্ডিয়া টুডের এক ইন্টারভিউতে বলেন তাঁর সরকার বছরে ২.৫ কোটি চাকরি দিতে সক্ষম হয়েছে। অবাক লাগে মাত্র দু মাসের ব্যবধানে সরকার কীভাবে প্রতি বছরে ১.২ কোটি থেকে ২.৫ কোটিতে পৌঁছে গেল? সার্বিকভাবে দেখলে ওই দুই মাসে মোট সাড়ে ৭ কোটির চাকরি বা কর্মসংস্থান সাড়ে ১২ কোটিতে পৌঁছে গেল— এ ভোজবাজি ছাড়া আর কী? সিএমআইই-এর ২০১৬-’১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে মোট কর্মরত জনসংখ্যা ৪০ কোটি ৭৩ লক্ষ ছিল যা ২০২১ সালে দাঁড়ায় ৪০ কোটিতে এবং ২০২৩ সালের মার্চ মাসে হয় ৩৯.৫ কোটি। অর্থাৎ একদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে, আর কর্মসংস্থান কমছে। সিএমআইই-এর আরেকটি তথ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তে প্রায় ৪ কোটি বেকার রয়েছে। স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২৩ রিপোর্ট অনুযায়ী ২৫ বছরের নিচে গ্র্যাজুয়েটদের ৪২.৩ শতাংশ এখনও কর্মহীন বাকিদের ৫০ শতাংশের বেশি উচ্চশিক্ষায় যুক্ত। স্কুলশিক্ষা পার করাদের বেকারত্ব ২৪%-এর বেশি।
আরও পড়ুন-‘আমার প্রচার চাই না’ বিজয়া সম্মিলনী থেকে কেন্দ্রকে নিশানা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
মোদি সরকার দায়বদ্ধ নয়, তারা রোলিং ব্যাক দ্য স্টেট অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভূমিকাকে প্রত্যাহার করার উপর গুরুত্ব দেয়। এইজন্য অনেকে বেচু সরকার বলে। সেইল, ভেল, রেল, বিএসএনএল প্রভৃতি সরকারি ক্ষেত্রকে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী। এই সরকার দায়হীন যা চুক্তিভিত্তিক চাকরির উপর গুরুত্ব দেয়। উদাহরণ অগ্নিপথ প্রকল্প। যেখানে ৪ বছরের জন্য কর্মী নিয়োগ হবে কারণ রাষ্ট্র দেশের সুরক্ষা প্রদানকারীদেরও দায়িত্ব নিতে অক্ষম। আবার এক ধরনের ক্যাসিনো ক্যাপিটালিজমকে প্রসারিত করছে। বিভিন্ন জুয়ার লাইসেন্স দিচ্ছে যা আগে ছিল না। একই সঙ্গে গিগ ইকোনোমির প্রচার-প্রসার হচ্ছে যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিও কর্মীদের দায় না নেয়। ফলে ভারতে অদ্ভুত এক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। রেলে চাকরির জন্য কোটি কোটি টাকা দরখাস্তের জন্য আদায় হচ্ছে, পরীক্ষা হচ্ছে না, চাকরি হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় উত্তেজিত জনতা রেল জ্বালিয়ে দিচ্ছে আর মোদি নিজের প্রচার-প্রসারে উদ্যোগী হয়েছেন। যার একমাত্র লক্ষ্য এক অতিমানব তথা ভারতের রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা। কিন্তু সাধারণ মানুষদের কর্মসংস্থান ও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কার্যত নিশ্চুপ। তাই ২০২৪ হোক প্রতিজ্ঞার বছর যার উদ্দেশ্য ইন্ডিয়াকে জেতানো।