দীর্ঘ প্রত্যাশার অবসান
বেণু এল ঘরে ফিরে। হম্ আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার প্রেরিত মহাকাশযান ওসিরিস-রেক্সের হাত ধরে দীর্ঘ সাত বছর পর ২৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর বুকে পৌঁছাল গ্রহাণু বেণুর শিথিল শিলাচূর্ণ। এ-যেন একপ্রকার কঠোর সাধনার জোরে সিদ্ধিলাভই বটে! এর আগে পৃথিবীর বুক থেকে প্রেরিত কোনও মহাকাশযান ওই অন্তরীক্ষে ভাসমান কোনও গ্রহাণু থেকে তার মাটি বা শিলাচূর্ণ এমন সফলভাবে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। ওসিরিস-রেক্স সেটা করে দেখাল!
আরও পড়ুন-ভোটের আগের দিন নকশাল হামলা ছত্তিশগড়ে, জখম BSF জওয়ান-সহ ৩
প্রকল্প ও প্রচেষ্টা
নাসা পরিচালিত এই সৌরজগতের উৎস, বর্ণালি বিশ্লেষণ, সম্পদের চিহ্নিতকরণ ও নিরাপত্তা এবং নিসর্গে ভাসমান শিলাচূর্ণের অন্বেষণ সম্পর্কিত ‘অরিজিন্স, স্পেক্ট্রাল ইন্টারপ্রিটেশন, রিসোর্সেস আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড সিকিউরিটি— রিগোলিথ এক্সপ্লোরার’ বা ওসিরিস–রেক্স মহাকাশযানটি ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ওই আশ্চর্য মহাজগৎ থেকে কোনও বিশেষ স্মরণিকা কিংবা কোনও আদিম পাথরের নুড়ি নিয়ে পৃথিবীর বুকে পদার্পণ— এই বিশেষ গুপ্তধনই হয়তো সৌরজগতের প্রকৃত জন্মবৃত্তান্ত ও পৃথিবীতে প্রাণসঞ্চারের প্রকৃত ইতিহাস জানতে সাহায্য করবে। এই লক্ষ্যে একটি বাদামী ও সাদা রঙের যন্ত্র সৌরজগতের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল এবং বিশেষকরে কার্বনে পরিপূর্ণ গ্রহাণু ‘বেণু’র কাছাকাছি অবস্থান করছিল; যেন সুযোগ পেলেই ওই নির্দিষ্ট গ্রহাণুর মাটিতে প্রবেশ করবে।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই আজ বিশ্বের দরবারে সমাদৃত শারদোৎসব
কার্যসিদ্ধি
মহাকাশ যন্ত্র ওসিরিস-রেক্স বেণুর মাটিতে পা রেখেছিল ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন গ্রহাণুটির পৃষ্ঠতল হয়তো মসৃণ, বালুময় সূক্ষ্মকণায় ভর্তি থাকবে; কিন্তু বাস্তবে সেরূপ ছিল না। পৃষ্ঠতল অত্যন্ত বন্ধুর ও পাথুরে, খাঁজকাটা চাতালযুক্ত, সঙ্গে বড়বড় পাথরের চাঁই, কোনও কোনওটি আবার দশতলা বাড়ির সমান উঁচু। এইসব কারণে মহাকাশযানটির নমুনা শিলাচূর্ণ সংগ্রহ করার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই সময় নাসার বিজ্ঞানীরা অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, কোনওরকম দুর্ঘটনায় সব কিছু শেষ না হয়ে যায়! হলও তাই— বেণুর উত্তর মেরুতে পাথরে পিছলে পুরো যন্ত্রটাই গিয়ে পড়ল বাটির মতো একটি গর্তে। এখানেই মিরাকল ঘটল। ওসিরিস-রেক্স নিজেকে সামলে নিয়ে সেখানেই কামড় বসিয়ে দিল, দিনটা ২০ অক্টোবর, ২০২০; যন্ত্রে লাগানো একটি বোতল থেকে নাইট্রোজেন গ্যাস নির্গত করে বেণুর শিথিল শিলাচূর্ণ উড়িয়ে দিল, এবং নিজের ক্যানিস্তার ভরে নিল। পরিমাণ প্রায় অর্ধেক পাউন্ড, সংগৃহীত নমুনার পরিমাণ অপ্রত্যাশিত, বিজ্ঞানীরা বেজায় খুশি।
আরও পড়ুন-আজ ভবানীপুরে বড় কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রাপ্তি
২০ অক্টোবর, ২০২০। এই দিনটিতে ওসিরিস-রেক্স তার ৩০ সেন্টিমিটার চওড়া মুখ দিয়ে নমুনা শিলাচূর্ণ সংগ্রহের ঠিক ছ’মাস পরে ২০২১-এর ১০ মে বেণুকে বিদায় জানিয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য দু-বছরের যাত্রা শুরু করে। ২৪ সেপ্টেম্বর ওই নমুনা-সহ ওসিরিস-রেক্সের ঝুড়ির মতো দেখতে একটি ধাতব যন্ত্রাংশ পশ্চিম আমেরিকার সল্টলেক সিটির আশি মাইল পশ্চিমে উটা টেস্ট অ্যান্ড ট্রেনিং রেঞ্জের মধ্যে অবতরণ করে; স্থানীয় সময় সকাল ৮টা বেজে ৫২ মিনিট। মহাকাশযানটি ফিরে আসার পথে নানা সমস্যার সামনাসামনি হতে হয় বিজ্ঞানীদের; নমুনার পরিমাণ বেশি হওয়ায় মহাশূন্যে ক্যানিস্তার উপচে পাউডারের মতো ঝরে পড়ছিল নমুনা। এই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কায় রাতের ঘুম হারিয়ে গিয়েছিল বিজ্ঞানীদের। শেষ পর্যন্ত অনেক বৈজ্ঞানিক কসরতের পর সফল হয় এই মিশন। ওসিরিস-রেক্স আমেরিকার প্রথম মহাকাশযান যেটি সফলভাবে কোনও গ্রহাণু থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ফিরে এসেছে নিজের ঘরে।
আরও পড়ুন-কালীপুজোর আগেই শীত-ভাব
পূর্ব অভিজ্ঞতা
ওসিরিস-রেক্সের আগে জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা জাপান এয়ারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি বা জাক্সা ২০১০ খ্রিস্টাব্দে হায়াবুসা প্রকল্পের আওতায় মহাকাশযান পাঠিয়েছিল। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে এই মিশন সফল হয়নি; পৃথিবীর নিকটস্থ ইটাকাওয়া গ্রহাণু থেকে এক মিলিগ্রামেরও কম নমুনা নিয়ে ঘরে ফেরে। ঠিক এক দশক পর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দে জাক্সা হায়াবুসা-২ নামে আরও একটি মহাকাশযান অন্তরীক্ষে পাঠায়। এই মিশনও পুরোপুরি সফল হয়নি। পৃথিবীর নিকটবর্তী রিয়ুগু গ্রহাণু থেকে মাত্র কয়েক গ্রাম নমুনা শিলাচূর্ণ সংগ্রহ করে ফিরে আসে। তবে এই নমুনা-শিলাচূর্ণ গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর দিকে বিভিন্ন গ্রহাণু থেকে পৃথিবীতে জলে উৎস তৈরি হয়। এর মধ্যে ইউরাসিল নামে রাসায়নিক বর্তমান— প্রোটিন তৈরি হতে সাহায্য করে এবং যা দিয়ে ‘আরএনএ’ তৈরি হয়। এরপর থেকেই বিজ্ঞানী মহলে জোর আলোড়ন শুরু হয়েছে। তবে পৃথিবীর বাইরেও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে!
আরও পড়ুন-বিজেপি রাজ্যের স্কুলেই যৌন হেনস্তা ছাত্রীদের
গ্রহাণু বেণু
পৃথিবী থেকে প্রায় ৩২১ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে সম্ভাব্য বিপজ্জজনক গ্রহাণু হল ‘বেণু’। মনে করা হয় সৃষ্টির ৪.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে ১০ মিলিয়ন বছরের সৌরজগৎ সৃষ্টির অনেক আগেই নাকি গ্রহাণু বেণুর জন্ম। মূল গ্রহাণু বেল্টের মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্যবর্তী জায়গায় পৃথিবীর কাছাকাছি এর অবস্থান। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এর আবিষ্কার করেন, তখন নাম ছিল ‘১৯৯৯ আর কিউ ৩৬’। পরবর্তীতে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ন’বছরের একটি ছাত্র মিখাইল পুঁজিও একটি প্রতিযোগিতায় জিতলে মিশরের পৌরাণিক পাখি বেণুর নামানুসারে এর নামকরণ ‘বেণু’ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা বেণুর মতো গ্রহাণু বা ছোট্ট পৃথিবীরাই নাকি একদিন পৃথিবীর বুকে প্রাণসঞ্চারের জন্য আদি জৈবিক অণুর প্রতিস্থাপন করেছিল এবং এখনও এর মধ্যে সেইসব প্রি-বায়োটিকের উপস্থিতি বর্তমান। প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, আবার প্রাণের উৎস সম্পর্কে অজানা রহস্যের সন্ধানও মিলতে পারে। এ-ছাড়াও এই ধরনের গ্রহাণু পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনকও বটে, যে কোনও সময় ধাক্কা খেতে পারে, সৃষ্টি নাশ হতে পারে। বেণুর পৃথিবীকে আঘাত করার ঝুঁকি ২১৭৮-২২৭০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ২৪ সেপ্টেম্বর, ২১৪২ সবচেয়ে বেশি। তাই উভয় কারণেই বেণু বিজ্ঞানীদের চোখের মণিতে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন-রাজ্যপাল নিযুক্ত উপাচার্যরা ‘অনুপ্রবেশকারী’ তোপ ব্রাত্যর
আগামীর স্বপ্ন
জলের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ঘনত্ব-যুক্ত বেণুর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে আসা, এ-যেন গোটা বিশ্বের কাছে একটি উপহার তুলে দেওয়া; এমনটাই মনে করেন গ্রহবিজ্ঞানী দাঁতে লরেট্টা। ২০০২ সালের পর থেকে গ্রহাণুদের উপর বিশেষ নজরদারি শুরু হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। ওসিরিস-রেক্সের এই সাফল্যে নাসার প্রশাসক বিল নেলসন মন্তব্য করেছেন, এই বৃহৎ ঘটনা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে, একত্রিত করবে এবং এটি আজ দেখিয়ে দিল কোনওকিছুই আমাদের নাগালের বাইরে নয়। সত্যিই বেণু থেকে সংগৃহীত নমুনা শিলাচূর্ণ আগামী প্রজন্মের কাছে নতুন সম্ভাবনার খনির মতো— হয়তো সৃষ্টির আদি ও অন্ত নিয়ে নানা অজানা বিস্ময় প্রকাশিত হবে একদিন!