মা কালী সমাজের পরাজিত-শোষিতদের দেবী, তিনি থাকেন সমাজের নিম্নবর্গের সঙ্গে। বাঙালি এই দেবীর পুজো খুব ধুমধামের সঙ্গে করে। অবশিষ্ট ভারত দিওয়ালি ‘মানায়’।
আরও পড়ুন-তারাদের ভাইফোঁটা
দিওয়ালি রাবণকে হারিয়ে রামের অযোধ্যায় প্রবেশের দিনকে কেন্দ্র করে উদযাপিত হয়। জয়-পরাজয় নয়, বাঙালির কালীপুজো চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে এক অনন্য উপাসনা। মহাভারতের যুদ্ধে বাঙালি যোগ দিয়েছিল কৌরবপক্ষে, এ-কথা আছে দ্রোণপর্বে। সৌপ্তিকপর্বে দেখা যায়, রাত্রির অন্ধকারে কৌরবপক্ষের অন্যতম সেনাপতি অশ্বত্থামা যখন হত্যালীলা চালাচ্ছেন তখন তাঁর পাশেই ছিলেন রক্তনয়না, সংহারের বিগ্রহ কালী।
এই কালী সারা ভারতে তেমনভাবে পূজিতা নন, তাঁর পুজো কেবল বাংলাতে মহাসমারোহে পালিত হয়।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
এককালে তিনিও বাংলার ঘরে পূজিতা হতেন না, তাঁর আরাধনা হত লোকালয়ের বাইরে। কারা পুজো করতেন কালীর? মূলত তান্ত্রিকরা, যে তন্ত্রের সঙ্গে ‘মূল’ ধারার ধর্মীয় উপাসনার বিরোধ রয়েছে। শঙ্করাচার্য সাংখ্যবাদীদের ‘তন্ত্রান্তরীয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। শঙ্কর শুধুমাত্র সাংখ্যকে বোঝানোর জন্যই ‘তন্ত্র’ শব্দের উল্লেখ করেছেন, অন্য দর্শন প্রসঙ্গে তিনি তা করেননি। আদিম তন্ত্রসাধনার অন্তর্নিহিত তত্ত্বগত দিক কালক্রমে সাংখ্যদর্শনে রূপান্তরিত হয়েছিল সেই তন্ত্রসাধনার তত্ত্বকেই অন্যতম তৈর্থিক মত বলে স্বীকার করা হয়। কারা তৈর্থিক? যাঁরা প্রচলিত মতের বিরোধী বা ‘মূল’ মত-এর স্খলনকারী অর্থাৎ অবতরণবাদী; যাঁরা ‘অন্য’ মতে বিশ্বাসী। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তৈর্থিকদের ‘হেরেটিক’ বা ধর্মদ্রোহী বলে উল্লেখ করেছেন।
আরও পড়ুন-সারা বছর ধরেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার
মূল মত থাকে ঘরে, ভিন্ন মত লোকালয়ের বাইরে। সেই জন্য লোকায়ত কালীর পুজো লোকালয়ে হত না, হত শ্মশানে বা গুপ্তস্থানে। বাংলায় লোকালয়ের বাইরের জায়গায় গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন কালীমন্দির। আরামবাগের কাছে তেলো ভেলোর মাঠে ভীমে ডাকাতের কালীমন্দির, খানাকুলে কাঞ্চন ডাকাতের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, মনোহরপুকুর রোডে মনোহর ডাকাতের কালীমন্দির, খিদিরপুরের অদূরে রঘু ডাকাতের কালীমন্দির, চিতু ডাকাতের চিত্তেশ্বরী কালীমন্দির সেই সাক্ষ্য বহন করে। এরা নিছক ডাকাত ছিলেন না, তাঁদের বলা হত ধনীর শত্রু, দরিদ্রের রবিনহুড। প্রথম দিকে কালীর কোনও মূর্তি ছিল না, পুজো হত ঘটে বা যন্ত্রে, কিন্তু কালক্রমে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে ষোড়শ শতাব্দীতে কালীমূর্তির প্রচলন হয়।
আরও পড়ুন-বঞ্চনার জবাব দেবে বাংলা, বিজয়া সম্মিলনীর মঞ্চে শপথ, কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, ধরা পড়ল একই দৃশ্য
এই লোকায়ত দেবীর পুজো হয় তন্ত্রমতে। তাই দেবীর আরাধনার মূল উপকরণ ‘পঞ্চ ম’। এটি বামপন্থী তান্ত্রিক শব্দবন্ধ। অর্থ— মদ, মাংস, মাছ, মুদ্রা, ও মৈথুন। অন্য তান্ত্রিকরা পেয়, ভক্ষ্য, ভোজ্য, লেহ্য, পেয় ও চোষ্য নামক পাঁচটি নৈবেদ্য দিয়ে দেবীর পুজো করে থাকেন। আত্মশক্তি ও তার উন্মেষসাধনই হল তন্ত্রসাধনা। আর সেটাই কালীর আরাধনা। তন্ত্র নিজের দেহরূপী আত্মা ছাড়া অন্য কোনও বাহ্য শক্তিকে দেবদেবী বা ঈশ্বর বলে স্বীকার করে না। তন্ত্র মতে, আমার দেহের মধ্যে যে এক জন বিরাজ করছেন, তা আমি বুঝি; তিনিও জগৎকে বুঝতে চান, সৃষ্টিপ্রহেলিকাকে উদঘাটন করতে চান। তাই অনুমান করি, যিনি আমার ভিতরে আছেন, তিনিই বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে আছেন, তিনিই কালী।
আরও পড়ুন-গাজায় ১০ মিনিটে এক শিশুর মৃত্যু, জানাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
এই যে ভিন্ন চিন্তা বা মত, তা এতদিন ছিল ব্রাত্য, তাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, তাই লোকালয়ের বাইরে লোকায়ত দেবীর আরাধনা হত। কালক্রমে দেবী উঠে এলেন অন্দরমহলেও, তিনি হয়ে উঠলেন হিন্দু বাঙালির আপনজন। বলা যায়, যে হেরেটিক বা মূলমত স্খলনকারীরা ব্রাত্য ছিলেন, তাদেরও আপন ঘরে ঠাঁই দেওয়া হল। কিন্তু সে-সময়ও লোকালয়ের মধ্যে অ-ব্রাহ্মণের পক্ষে মন্দির প্রতিষ্ঠা সহজ ছিল না।
১৮৪৭ সালে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে কৈবর্ত রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন বলে ঠিক করলেন। জমি চাই। কোনও হিন্দুর জমি পাওয়া গেল না, মিলল হেস্টি নামের এক খ্রিস্টান সাহেবের জমি।
আরও পড়ুন-মণ্ডপ-প্রতিমা থেকে আলোকসজ্জা বারাসতের কালীপুজোয় জোর টক্কর
জমির মালিক খ্রিস্টান বলে ব্রাহ্মণরা জমি কেনার ক্ষেত্রে কোনও বাধা দিতে পারেননি। কিন্তু মন্দির তৈরিতে এল হাজারো বাধা। নড়াইলের জমিদার রামরতন রায় রানির বিরুদ্ধে ষোলোটি মামলা করলেন— নারীর মন্দির প্রতিষ্ঠার অধিকার নেই, শ্মশানভূমিতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা অশাস্ত্রীয় প্রভৃতি। কিন্তু মন্দির তৈরির কাজ বন্ধ করা যায়নি। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির। পুরোহিত নিয়োগ করা হল। রানির আর একটি বৈপ্লবিক কাজ, তিনি ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে তাঁর এক বাগদি পরিচারিকা সৌদামিনীর বিবাহ দিলেন। শূদ্র নারী প্রতিষ্ঠা করলেন মন্দির, বর্ণব্যবস্থার বিরুদ্ধেও রেখে দিলেন প্রতিবাদ।
আরও পড়ুন-চম্পাহাটির পাশে দাঁড়িয়েছে রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ বাজি ব্যবসায়ীদের
নীলতন্ত্রমতে, কালীপুজোয় কোনও বর্ণভেদ নেই। সেখানে বলা হয়েছে— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের মধ্যে যে ব্যক্তি শাক্ত সে-ই ব্রাহ্মণ (১৮/৩)। শাক্তমত অনুসারে, দেবী হলেন পরমব্রহ্ম বা সর্বোচ্চ ব্রহ্ম। অন্যান্য দেবদেবী তাঁর রূপভেদমাত্র। ব্রহ্মের পুরুষ রূপ হল শিব। তবে তাঁর স্থান শক্তির নিচে। শাক্তমতাবলম্বী হলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র— সকলেই সমান হয়ে যান। সেই জন্য কমলাকান্ত ভট্টাচার্য থেকে প্রাঙ্গণ তরফদার, রামপ্রসাদ সেন, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, নিধুবাবু, কালী মির্জা, নজরুল ইসলাম শ্যামাসঙ্গীতের ধারায় কৃতিত্ব স্থাপন করতে পেরেছেন। বৈষ্ণব কবি আজু গোসাঁইয়ের সঙ্গে শাক্ত কবি রামপ্রসাদ সেনের দ্বন্দ্ব ছিল। রামপ্রসাদ লিখলেন, ‘কেন মন বেড়াতে যাবি?’ গোসাঁই উত্তর দিলেন, ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’। আজু গোস্বামী বলতেন রামপ্রসাদ দ্বন্দ্বে ভোগে, আমি ভুগি না; আমার আদি ঈশ্বর হলেন বিষ্ণু ও তাঁর অবতারগণ।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
রামপ্রসাদ বলেন, না— দেবী হলেন পরম ব্রহ্ম, অন্যরা তাঁর প্রকাশমাত্র। গোসাঁই জানালেন, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরম ব্রহ্ম। দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়তে লাগল। শেষমেশ আজুকে কোণঠাসা করলেন রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদ খেতে লাগলেন বলির পাঁঠা, গোসাঁই খান গাছপাঁঠা, মানে এঁচোড়।
পর্তুগিজ বাবা ও বাঙালি মায়ের সন্তান অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কালী সাধনার পথও সুগম ছিল না। খ্রিস্টান অ্যান্টনি হিন্দু বিধবাকে বিয়ে করলে সেই মহিলাকে গোঁড়া হিন্দুরা হত্যা করে। অ্যান্টনির বিখ্যাত গান— “খৃষ্টে আর কৃষ্টে কিছু প্রভেদ নাই রে ভাই/ শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে/ এ কথা তো শুনি নাই/ আমার খোদা যে/ হিন্দুর হরি সে…আমার মানবজনম সফল হবে/ যদি রাঙা চরণ পাই।” ‘ফিরিঙ্গি কালীমন্দির’ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।
আরও পড়ুন-অশান্ত মণিপুরে টানা ৩৩ ঘণ্টা বনধ, ব্যাহত জীবনযাত্রা
‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ প্রবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, “আমি নিজে দেখিয়াছি, ত্রিপুরাবাসী গোলমাহমুদ স্বীয় দলবল লইয়া স্ব-রচিত কালী-বিষয়ক নানা সঙ্গীত ঝিঁঝিট রাগিণীতে আসরে গাহিতেন। তাঁহার রচিত ‘উন্মত্তা, ছিন্নমস্তা এ রমণী কা’র’ প্রভৃতি গানের রেশ এখনও আমার কানে বাজিতেছে। কিন্তু গোলমাহমুদকে মুসলমানেরা কখনও ‘কাফের’ বলেন নাই। তিনি স্বর্ধমনিষ্ঠ ছিলেন। সৈয়দ জাফর শাহের কালী-বিষয়ক গান অনেকেই জানেন।” শাহ বিরিদ খাঁ, নওয়াজিস খান, আলি রেজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, মুনসি বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ, হাছন রাজা প্রমুখ অজস্র শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, তাতে কালীসাধকরা প্রসন্নই হয়েছেন। নজরুল লিখলেন, “শ্মশানে জাগিছে শ্যামা/অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে”। এই নজরুলকে ইংরেজ কারারুদ্ধ করে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য। এই ভাবে লোকায়ত মানুষের, পরাধীন জাতির, শোষিত সম্প্রদায়ের আশা-ভরসার দেবী হয়ে ওঠেন জাতিধর্মবর্ণমুক্ত মহাবিদ্যা কালী।