সত্যিই কি টাইম ট্রাভেল সম্ভব

আমরা প্রায়শই বিভিন্ন বই বা চলচ্চিত্রে এই টাইম ট্রাভেল-এর কথা শুনি, দেখি। যা বেশ উপভোগ্য। এই টাইম ট্রাভেল আদৌ সম্ভব কি? এর কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? মানুষ সত্যিই কি ভবিষ্যতে যেতে পারে কিংবা অতীতে? এর উত্তর খুঁজলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

টাইম ট্রাভেল একটা ‘মিথ’ তা মেনে নিতে মন চায় না। কথায় বলে যা রটে তার কিছু তো ঘটে, তাই টাইম ট্রাভেল-এর ক্ষেত্রেও যুক্তিটি ঠিক সেইভাবেই খাটে। এই টাইম ট্রাভেল আদৌ সম্ভব কিনা? আদৌ এর পেছনে কি কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? আদৌ কি কোনও মানুষ ভবিষ্যতে যেতে পারে কিংবা অতীতে? এর উত্তর— হ্যাঁ, পারে? কিন্তু কীভাবে?

আরও পড়ুন-ট্রেনের তলা থেকে বের হচ্ছে ধোঁয়া, ধৌলি এক্সপ্রেসে আগুন

তত্ত্ব
টাইম ট্রাভেল সাধারণত দু’ভাবে করা যায়। এক, ভবিষ্যতে টাইম ট্রাভেল আর দুই, অতীতে টাইম ট্রাভেল। এই ভবিষ্যতে টাইম ট্রাভেল সম্বন্ধে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব স্পেশাল রিলেটিভিটি’ বা বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে। তিনি এখানে সময়ের লঘুকরণের কথা বলেন যাকে বলেন ‘টাইম ডায়ালেশন’। আইনস্টাইনের এই ব্যাখ্যার আগে এটি মনে করা হত যে সময় হল কনস্ট্যান্ট অর্থাৎ সময় যেকোনও ক্ষেত্রে, যেকোনও জায়গায়, যেকোনও অবস্থায় সর্বদাই একই দিকে একই ভাবে একই বেগে প্রবাহিত হয়। আর এই ধারণাটি দেন আইজ্যাক নিউটন। তবে নিউটনের এই ব্যাখ্যা নস্যাৎ করে দিয়ে আইনস্টাইন বলেন যে, সময় হল ঠিক নদীর মতো। নদীতে জলের বেগ বৃদ্ধি বা হ্রাসের মতোই সময়ের বেগও কখনও বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়, তবে সময়ের এই হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ভর করে গতিবেগ ও অভিকর্ষজ টানের ওপর। অর্থাৎ গতিবেগ বা অভিকর্ষজ টানের পরিবর্তনের মাধ্যমে সময়কে প্রসারিত করা যায় বা সময়ের গতিকে ধীর করা যায় যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘টাইম ডায়ালেশন’ বলে।

আরও পড়ুন-বাংলার শিক্ষায় আরও কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক মঞ্চে এলো

যুক্তি ও ব্যাখ্যা
সাধারণত গতিবেগ বাড়ালে সময়ের গতি ধীর হয়ে যায়। এই তত্ত্বের পরীক্ষা করা হয় ১৯৭১ সালে। একটি অ্যাটোমিক ঘড়ি বানানো হয়েছিল সময় পরিমাপ করার জন্য এবং এতে দেখা গিয়েছিল যে সত্যিই বিমানে থাকা ঘড়ির সময়, সমতলে স্থির অবস্থায় থাকা ঘড়ির তুলনায় কয়েক ন্যানোসেকেন্ড পিছিয়ে চলছে। এই পরীক্ষার নাম ছিল হ্যাফেল-কিটিং পরীক্ষা। তবে কি সময় সত্যিই ধীরে চলে? আজ্ঞে না, যে মানুষটি বিমানে বসে আছেন তাঁর কাছে সেই সময়টি একদম ঠিক কিন্তু আমাদের সাপেক্ষে অর্থাৎ যারা স্থির অবস্থায় আছে তাদের সাপেক্ষে সেটি ধীর হয়ে যাচ্ছে বা পিছিয়ে যাচ্ছে। গেনেডি পেডাল্কা নামক একজন রাশিয়ান নভশ্চর সবচেয়ে বেশি টাইম ট্রাভেল করেছেন বলে জানা যায়। তিনি মহাকাশে ৮৭৯ দিন কাটান এবং তিনি যে স্পেস ক্র্যাফটে ছিলেন তার গতিবেগ ছিল ২৮০০০ কিমি/ ঘণ্টা। তাই সেই হিসেবে দেখলে তিনি ০.০২ সেকেন্ড ভবিষ্যৎ সময় যাত্রা করে নিয়েছেন। এমনকী এখন এঁর বয়স পৃথিবীর মানুষের চাইতে ০.০২ সেকেন্ড কম।

আরও পড়ুন-লাহিড়ীবাড়ির ৪৫০ বছরের পুজোভোগে আকর্ষণ ইলিশ ও চিংড়ি

এ-ছাড়াও অভিকর্ষজ বল বা টানের বৃদ্ধি দ্বারাও কিন্তু আইনস্টাইন টাইম ডায়ালেশন-এর কথা বলেছেন। তবে এর গভীরে যাওয়ার আগে একটা জিনিস আমাদের একটু কল্পনা করে নিতে হবে। ধরা যাক স্পেস-টাইম-এর একটা পাতলা চাদর আছে ঠিক একটা জালের পর্দার মতো। এর মধ্যে যদি আমরা কিছু ভারী বল ফেলে দিই তাহলে দেখব সেই চাদর ওই বলের ওজনের দরুন নিচের দিকে ভাঁজ খাচ্ছে। আর এই বলের যত বেশি ওজন হবে তত বেশি তার অভিকর্ষজ বল হবে। এবার এই বলকে যদি আমরা কোনও গ্রহজ বস্তু হিসেবে ধরে নিই তা হলে কোনও গ্রহজ বস্তুর অভিকর্ষজ বল যত বেশি হবে তত বেশি স্পেস-টাইম-এর সেই জালের পর্দায় ভাঁজ পড়বে আর তত বেশি সেই বস্তুর ক্ষেত্রে সময় ধীরে চলবে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বৃহস্পতির অভিকর্ষজ বল পৃথিবীর তুলনায় বেশি আবার সূর্যের অভিকর্ষজ বল বৃহস্পতির তুলনায় বেশি তাই এইসব গ্রহের আশেপাশে সময় খুব ধীরে চলে অর্থাৎ এইসব জায়গায় কয়েক মুহূর্ত থাকা মানে পৃথিবীতে কয়েক বছর এগিয়ে যাওয়া। এক কথায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ দেখা। এরকম টাইম ডায়ালেশনের আরও একটি উদাহরণ হল জিপিএস, যা আমাদের পৃথিবীর কিছুটা বাইরে অবস্থান করায় সেখানেও সময়ের হেরফের দেখা যায় কিন্তু বিজ্ঞানীরা ক্রমাগত সেই সময়কে ঠিক করে দেওয়ার কারণে আমরা সময়ের এই হেরফের বুঝতে পারি না।

আরও পড়ুন-সবার ঘরে জ্বলুক দীপাবলির আলো

এ তো গেল ভবিষ্যতে যাওয়ার কথা কিন্তু সময়ের সারণি বেয়ে সত্যিই কি অতীতে যাওয়া যায়? আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা অতীতে যেতেই পারি। যদি স্পেস-টাইমের ওই জালের পর্দায় ভাঁজ না সৃষ্টি করে যদি তাতে ফুটো করে দেওয়া যায় যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ওয়ার্মহোল বলে তাহলে আমরা সেই অক্ষ-বরাবর অতীতেও যেতে পারব কারণ সেটি অতীতের সেই স্পেস টাইম জালের পর্দার সঙ্গে গিয়ে মিশবে। যাতে একটি বদ্ধ সময়চক্র অর্থাৎ ক্লোজড টাইম লাইক কার্ভ তৈরি হবে। তবে এই ওয়ার্মহোল বা ফুটো তৈরি করার জন্য যে বল আমরা ব্যবহার করব তার অভিকর্ষজ বল অনেক-অনেক বেশি হতে হবে। যা কেবল একটি ঘূর্ণনযুক্ত ব্ল্যাক হোলের পক্ষেই সম্ভব। অর্থাৎ তত্ত্বের ভিত্তিতে অতীতে যাওয়ার কোনও সমস্যা নেই। তবে সমস্যা আছে অন্য জায়গায়, যেখানে বলা হয়েছে— ধরা যাক আমরা অতীতে গিয়ে আমাদের ঠাকুরদাকে মেরে ফেললাম তাহলে বর্তমানে আমাদের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব কি? আর যদি আমাদের অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে কি অতীতে গিয়ে ঠাকুরদাকে মেরে ফেলা সম্ভব? এটিই হল গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স। আরও একটি প্যারাডক্সের কথা আমরা জানতে পারি, সেটি হল প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স, যেখানে বলা হয়েছে বর্তমানে ঘটা সমস্ত কার্যক্রমই অতীতের সঙ্গে জুড়ে আছে, অর্থাৎ আমরা যদি অতীতে গিয়ে কোনও কিছু পরিবর্তন করার চেষ্টা করি তা হলে দেখতে পাব ওই পরিবর্তনের চেষ্টার ফলেই বর্তমান এরকম হয়েছে। আসলে পূর্বনির্ধারিত কোনও কিছুকেই পরিবর্তন করা যায় না, একেই প্রি-ডেস্টিনেশন প্যারাডক্স বলা হয়। অতীতে যাওয়ার রাস্তা তো আছে কিন্তু তার পরিবর্তন আদৌ সম্ভবপর কিনা সেটি আমরা জানি না।

আরও পড়ুন-বাংলার শিক্ষায় আরও কাজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এক মঞ্চে এলো

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের দেওয়া থিওরি অনুযায়ী আমরা ভবিষ্যৎ বা অতীত যেকোনও জায়গায় টাইম ট্রাভেল করতে পারি তবে এখনও সেটি কেবলই তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আদৌ তা প্রয়োগ করা যাবে কি না সেকথা এখনও বলা যাচ্ছে না।

Latest article