বিজেপি-বিরোধী রাজ্যগুলিতে সেখানকার সরকার ও শাসকদলের বিরুদ্ধে সিবিআই, ইডি-র হানা এখন তো রোজকার ঘটনা। কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এখন দেশ জুড়েই শোনা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন-মিধিলির ল্যান্ডফল বাংলাদেশে, সামান্য বৃষ্টি বিভিন্ন জেলায়
বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে তদন্তের গতি-প্রকৃতির সঙ্গে বিজেপি-বিরোধী রাজ্যগুলির তদন্তের অতি-তৎপরতার পার্থক্যের মধ্যে রয়েছে আসমান-জমির ফারাক। আমাদের রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগে বিজেপি নেতার প্রায় কিচুই হয় না। তাঁরা দিব্যি মুক্তকচ্ছ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনও প্রমাণ ছাড়াই এ রাজ্যে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতার পর্যন্ত করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। ‘দুর্নীতিবাজ’, ‘চোর’ ইত্যাদি বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ এক বিরক্তিকর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আইনের বিচারে কোনও অভিযোগের ফয়সালা কবে হবে, তা অনেক বিলম্বিত এক প্রক্রিয়া।
আরও পড়ুন-তৃণমূল নেতা খুনে ৫ লাখি সুপারি, ধরপাকড়
ভোটের আগে এভাবে বিরোধী নেতৃত্বকে কলঙ্কিত করে চাপ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। এমনকী যেভাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হচ্ছে, তা যে অভিসন্ধিমূলক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এক্ষেত্রে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে রাজ্যের সিপিএম-কংগ্রেস। এঁদের সকলের ভূমিকা নিন্দাজনক। ভীতি প্রদর্শন এবং মিথ্যাচার বিজেপির কোষে কোষে প্রবাহিত। এবং তার ধরন পুরোপুরি ফ্যাসিস্ট চরিত্রের। বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ রাজ্যের সিপিএম-কংগ্রেস সেই ফ্যাসিস্টদের মদত দিচ্ছে। তাঁরা যে আসলে ফ্যাসিস্ট-বিরোধী নন, তা প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
পশ্চিমবাংলায় বিজেপি যত দুর্বল হচ্ছে, তাদের সাংগঠনিক দুর্বল অবস্থা যত প্রকট হয়ে উঠছে, ততই নানাভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আর সেই কাজের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছ সিবিআই ও ইডি। এর পিছনে রয়েছে একটি সুচতুর রাজনৈতিক লক্ষ্য। বিজেপি চায় বিরোধী-শাসকের বিপক্ষ হিসাবে কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে দাঁড় করিয়ে দিতে। তাতে বিজেপিকে কেউ সরাসরি দায়ী করতে পারবে না। আদালতের নির্দেশ এবং আইনের পথে সবকিছু চলছে বলে, নিজেরা সাধু সেজে চলছে বলে দায় এড়িয়ে যাবে বিজেপি। নিজেদের দলকে আড়াল করা যাবে এবং শেষ বিচারে বিজেপির ভোটের পালে হাওয়া দেওয়ার সুবিধা হবে।
আরও পড়ুন-জেসিবির ধাক্কায় মৃত কনস্টেবলের পরিবারের পাশে মুখ্যমন্ত্রী, আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা
বিহার, পাঞ্জাব, দিল্লি, অন্ধ্র-সহ অন্যান্য বিজেপি-বিরোধী রাজ্যে একই প্রক্রিয়া চলছে। পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে না পেরে ক্রোধবশত এই রাজ্যে হয়রানি বেশি করা হচ্ছে। ওদের মূল কথা হল— হয় আত্মসমর্পণ কর, নতুবা দুর্ভোগ বাড়বে। এটা হল প্রতিহিংসার রাজনীতি। অভিযোগ এনে, কাউকে গ্রেফতার করে, তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারকে জুড়ে দেওয়ার এক ষড়যন্ত্র চালানো হচ্ছে। অপরিপক্ক রাজনীতিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতারের মতো আজেবাজে কথা বলছেন। তাঁকেই টার্গেট করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তৃণমূলের সবাই ‘চোর’। যেটা কখনওই বাস্তবসম্মত সত্য হতে পারে না। জনমানসে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা গড়ে তোলার সার্বিক চক্রান্ত বিরোধীরা খুব হালকা চালে করে চলেছে। তাঁরা জানেন, এখনও মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে মানুষের মনে যথেষ্ট আস্থা বর্তমান এবং সেই আস্থা এত সহজে দুর্বল করা যাবে না। তবুও ওঁরা বিশ্বাস করেন, মিথ্যারও একটা শক্তি আছে। বারবার একটা মিথ্যা বলতে থাকলে একসময় মানুষ তা বিশ্বাস করে নেবেন। এটাই হল ফ্যাসিস্ট-বিশ্বাস। যাকে ফ্যাসিস্ট-দর্শনও বলা যায়।
আরও পড়ুন-বেআইনি পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ মুখ্যমন্ত্রীর, পোস্তার সমস্যা সমাধানে বিশেষ কমিটি গঠন
সংবাদমাধ্যমের বড় শক্তি এই ফ্যাসিস্ট-বিশ্বাসের উপর ভর করে নানা কায়দায় সরকারকে, মুখ্যমন্ত্রীকে কলুষিত করছে। কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছে তারা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। তাই তারা যা দেখছে না, তা-ও ফলাও করে বলে যাচ্ছে। প্রকৃত সংবাদ তুলে ধরা এক জিনিস, আর সংবাদ বানানো অন্য কিছু। এই ‘অন্য কিছুটাই’ করে বেড়াচ্ছে সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ আজ আর সোজা দাঁড়িয়ে নেই। কর্পোরেট বিজ্ঞাপন বন্ধ হওয়ার ভয়ে তাদের অনেকেই শাসকের কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
আরও পড়ুন-বড় দুর্ঘটনা নৈনিতালে, যাত্রী বোঝাই পিক-আপ ভ্যান খাদে পড়ে শিশু-সহ মৃত একাধিক
ইডি-সিবিআইয়ের ভূমিকা নিয়ে অতি-সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত অতি-গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। বর্তমান পর্যায়ে সেই কথাগুলি আশার সঞ্চার করে। ইডির ভূমিকা দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে প্রমাণ ছাড়াই যে-কোনও নাগরিককে গ্রেফতারের পূর্ণ অধিকার রয়েছে ওই সংস্থার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত গত সপ্তাহে স্মরণ করিয়ে দিল— না সেই ‘অধিকার’ ইডির নেই। ‘পঙ্কজ বনশল বনাম ভারতীয় ইউনিয়ন’ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে, ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’-এ এমন কোনও শর্ত নেই যে কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উঠলেই তাকে সরাসরি গ্রেফতার করা হবে।
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে চলছে শেষ দফার ভোট, ২৩০ কেন্দ্রে নির্বাচন হচ্ছে মধ্যপ্রদেশে
সাধারণত তদন্তে সহযোগিতা না করার অজুহাত দেখিয়ে ইডি নিজের কাজকে সঙ্গত বলে দাবি করে। কিন্তু, শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, অপরাধ অস্বীকার করাকে অসহযোগ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। বরং এই আইনে যে কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে, মহামান্য আদালত সেই দিকে জোর দিতে বলেছেন। বলা আছে, গ্রেফতারকারী অফিসার কেন গ্রেফতার করছেন তা সোজাসুজি লিখিতভাবে নথিভুক্ত হতে হবে। সেই নথি ঠিকভাবে স্বাক্ষরিত হতে হবে। নথির প্রতিলিপি অভিযুক্তকে আগেই হাতে দিতে হবে। এই বিধির কোনও ব্যতিক্রম হবে না। অভিযুক্ত মানেই অপরাধী নন। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা করা মানেই অভিযোগ প্রমাণিত নয়। তাই প্রতিহিংসা নয়— নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার মেনে কোন বিশেষ প্রমাণযোগ্য অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তা নথিবদ্ধ রাখা গণতান্ত্রিক শাসন বিভাগের আবশ্যিক দায়িত্ব।
আরও পড়ুন-ছত্তিশগড়ে চলছে শেষ দফার ভোট, ২৩০ কেন্দ্রে নির্বাচন হচ্ছে মধ্যপ্রদেশে
মোদির শাসনে সুপ্রিম কোর্টের এই বক্তব্যের গুরুত্ব বিরাট এবং অপরিসীম। এই আমলে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের এবং তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদের ও অন্য নাগরিকদের যেভাবে ইডি-র টার্গেট বানিয়ে তোলা হয়েছে, তা কোনও নতুন কথা নয়। এদের ৯৫ শতাংশই বিরোধী নেতা। এর থেকে স্পষ্ট যে, মোদি-প্রশাসন প্রতিহিংসা পরবশ হয়েই এ-কাজ করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিটি নাগরিকের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া কর্তব্য।