নারীচরিত্রে অভিনয়
রবীন্দ্রনাথ তখন নতুন মুখ খুঁজছেন। একদিন শান্তিনিকেতন আশ্রমে এক নবীন ছাত্রকে দেখে তাঁর পছন্দ হয়। কবি তাঁকে অভিনয়ের সুযোগ দেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে। তবে পুরুষ চরিত্রে নয়, নারী চরিত্রে। নাটকে রবীন্দ্রনাথ সাজলেন ‘বাল্মীকি’, আর ছাত্রটি ‘মায়া’। এইভাবে ছাত্রটির মনে অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা জাগিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে ছাত্রটি অভিনয় করেন কবির ‘রাজা’, ‘ডাকঘর’ ইত্যাদি নাটকে। অভিনয়ের গুণে তিনি অল্প দিনেই লাভ করেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহ। পরবর্তী সময়ে কবির কাছে গান, ছবি আঁকা, যন্ত্রসঙ্গীত শেখারও সুযোগ লাভ করেন। ছাত্রটি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা চলচ্চিত্রের আদি যুগের অভিনেতা, নির্মাতা এবং পরিচালক। ‘ডিজি’ নামেই লাভ করেন বিশেষ পরিচিতি।
আরও পড়ুন-বঙ্গসাহিত্যে সরস ‘তারা’
রক্ষণশীল পরিবারের বাধা
পূর্বপুরুষের বাস ছিল বাংলাদেশের বরিশালে। তবে ধীরেন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতায়। ১৮৯৩ সালের ২৬ মার্চ। এক অভিজাত পরিবারে। ছাত্র হিসেবে ছিলেন মেধাবী। ছবি-আঁকাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে শান্তিনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে কৈশোরে আসেন কলকাতায়। এর পিছনে ছিল রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ। প্রথমে বৈঠকখানার জুবিলি আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। তারপর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে পূর্ণমাত্রায় চিত্রকর হয়ে বেরিয়ে আসেন। ১৯১২ সালে। পাস করেন ডিস্টিংশন-সহ। কিন্তু তাঁর রক্ষণশীল পরিবার শিল্পচর্চায় নানা ভাবে বাধা দিতে থাকে। তবে কোনও বাধাই মানেননি ধীরেন্দ্রনাথ। শুনেছিলেন শুধুমাত্র মনের কথা। নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন শিল্পসাধনায়। পরিবার ছিল সচ্ছল। তিনি অর্থোপার্জনের জন্য ছবি আঁকতে থাকেন। নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করতে থাকেন বিভিন্ন পত্রিকায়। চিত্রকর হিসেবে সেই সময়ে ধীরেন্দ্রনাথ সকলের সম্ভ্রম আদায় করে নেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিয়েছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছ’টি তৈলচিত্র আঁকতে। ওড়িশার বামড়ার রাজা সচ্চিদানন্দ ত্রিভুবন দেওকে ছবি আঁকা শেখানোর চাকরিও পেয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন-দুই তারাপদর গল্প
হায়দরাবাদের আর্ট কলেজে অধ্যক্ষের চাকরি
বিচিত্র কর্মের সঙ্গে জড়িয়েছেন নিজেকে। শান্তিনিকেতনে রূপসজ্জা শিল্পী হিসেবে নিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ। সেই সুবাদে একটি চাকরি পেয়ে যান কলকাতা পুলিশের দফতরে। তাঁর কাজ ছিল বড় কর্তাদের পোশাক তৈরি করা। পাশাপাশি ছবি তোলার প্রতিও তৈরি হয় আগ্রহ। তুলতেন নানা রকমের ছবি। বিভিন্ন বিষয়ের। সেইসব ছবি নিয়ে পরে ‘ভানওয়ার অভিব্যাকে’ নামে বই প্রকাশ করেন। উচ্চপ্রশংসিত হয় বইটি। ১৯১৬ সালে হায়দরাবাদের নিজাম আর্ট কলেজে অধ্যক্ষের চাকরি পান। মেক-আপ-এর কাজেও দক্ষতা ছিল। যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা বই ‘ভাবকী অভিব্যক্তি’তে। সেই বিষয়ে ব্রিটিশ ভারতে এবং পরে স্বাধীন ভারতে গোয়েন্দা সংস্থা সিআইডি-র অফিসারদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-শারদ-সাহিত্যে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতা
রবীন্দ্রনাথের সানন্দ অনুমতি
ধীরেন্দ্রনাথের কৈশোরে হীরালাল সেনেরা থিয়েটারের নাট্যাভিনয় ও পথঘাটের চলমান জীবন ক্যামেরায় তুলে প্রদর্শন করতেন। ভ্রাম্যমাণ বিদেশি বায়োস্কোপওয়ালারা কলকাতায় তাঁবু খাটিয়ে চলচ্চিত্র দেখিয়ে বেড়াতেন। সেগুলো দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ইচ্ছে জেগেছিল ধীরেন্দ্রনাথের। ১৯১৪ সালে বিদেশে গিয়ে তিনি চলচ্চিত্রের টেকনিক শিখে আসার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দারুণভাবে উৎসাহিত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভাবনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে হাল ছাড়েননি ধীরেন্দ্রনাথ। একটা সময় জে এফ ম্যাডানের সঙ্গে পরিচিত হন। বুঝতে পারেন, পূরণ হতে চলেছে স্বপ্ন। ম্যাডান কর্তৃপক্ষ জানালেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করতে চান। কিন্তু কবি অনুমতি দিচ্ছেন না। ধীরেন্দ্রনাথ যদি অনুমতি আদায় করে আনতে পারেন, তাহলে তাঁকে দিয়েই ছবিটি পরিচালনা করানো হবে। ধীরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সানন্দ অনুমতি নিয়ে এলেন। পরে জানতে পারলেন ম্যাডান কোম্পানি ছবি পরিচালনার দায়িত্ব তাঁকে দেবেন না। অসন্তুষ্ট হন ধীরেন্দ্রনাথ। বেরিয়ে আসেন ম্যাডান থেকে।
আরও পড়ুন-১২ বছর পর বিশ্বজয়ের মুখে রোহিতরা, আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল, তিনের বদলা তেইশে?
ইন্দো-ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি
১৯১৮ সালে ম্যাডান থিয়েটার্সের ব্যবস্থাপক নীতীশ লাহিড়ীর সঙ্গে যৌথভাবে গড়ে তোলেন বাঙালিদের প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা ইন্দো-ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি। টাকা দিলেন পি এন দত্ত নামের এক সজ্জন ব্যক্তি। তিনজনের মিলিত প্রচেষ্টায় বনহুগলির এক বাগানবাড়িতে স্টুডিও তৈরি হল। ওই সংস্থা থেকেই ১৯২১ সালে মুক্তি পায় নির্বাক বাংলা ছবি ‘বিলাত ফেরত’। পরিচালক ছিলেন নীতীশ লাহিড়ী। কাহিনি লেখার পাশাপাশি মূল চরিত্রে অভিনয় করেন ধীরেন্দ্রনাথ। পরের বছর, ১৯২২ সালে মুক্তি পায় আরও দুটি সিনেমা, ‘যশোদা নন্দন’ এবং ‘সাধু অউর শয়তান’। দুটি ছবিই জনপ্রিয়তা পায়। ধীরেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ভদ্রঘরের মেয়েদের চলচ্চিত্রশিল্পে এনে অভিনয়কে সম্মানের পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাঁর শিক্ষিতা স্ত্রী প্রেমময়ীদেবী, কন্যা মণিকাদেবীকে অভিনয় জগতে নিয়ে আসেন। তাঁর আহ্বানে অভিনয় জগতে এসেছিলেন আরও অনেক মহিলা।
আরও পড়ুন-রেলে নাভিশ্বাস দেশবাসীর, বিমান ভাড়াকেও হার মানাচ্ছে টিকিটের দাম
ক্ষুব্ধ হন হায়দরাবাদের নিজাম
১৯২৩ সালে ভেঙে যায় জুটি। আলাদা পথ বেছে নেন নীতীশ এবং ধীরেন্দ্রনাথ। ভগ্ন মনে হায়দরাবাদে ফিরে যান ধীরেন্দ্রনাথ। সেখানেই নিজামের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলেন লোটাস ফিল্ম কোম্পানি। ১৯২২ সালে সেই সংস্থা থেকে পরপর দুটি ছবি মুক্তি পায়, ‘লেডি টিচার’, ‘ম্যারেজ টনিক’। ১৯২৪ সালে মুক্তি পায় ‘রাজিয়া বেগম’। ইলতুতমিসের কন্যা রাজিয়া সুলতানার সঙ্গে আবিসিনিয়ার এক ক্রীতদাসের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে ছবি। সেটা দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন হায়দরাবাদের নিজাম। একদিনের মধ্যেই তাড়িয়ে দেন ধীরেন্দ্রনাথকে।
আরও পড়ুন-আজ ছটপুজোয় ঘাটে মুখ্যমন্ত্রী
তৃতীয় নির্বাক স্টুডিও
কলকাতায় ফিরে আসেন ধীরেন্দ্রনাথ। তৈরি করেন ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন ফিল্ম কোম্পানি। ১৯৩০ সালে এই সংস্থা থেকে চিতোরের রানি পদ্মিনীর জীবন নিয়ে ‘ফ্লেমস অফ ফ্লেশ’ নামে একটি ছবি বানান। শ্যুটিং হয়েছিল রাজস্থানের অম্বর প্রাসাদে। তাঁর ডোমিনিয়ন ফিল্ম স্টুডিও তৃতীয় নির্বাক স্টুডিও। এর বোর্ড অফ ডিরেক্টরের সদস্য ছিলেন প্রমথেশ বড়ুয়া, তরুবালা সেন, এন এন মুখোপাধ্যায়, কে সি রায়চৌধুরী প্রমুখ। ব্যবস্থাপক পরিচালক ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। সংস্থার প্রথম সিনেমায় কাজ করেছিলেন দেবকীকুমার বসু, চিত্রনাট্যকার ও চিত্রনির্মাতা দীনেশরঞ্জন দাস, ক্যামেরাম্যান শৈলেন বসু এবং দ্রোণাচার্য। মোট আটটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল ওই প্রযোজনা সংস্থা থেকে। ১৯৩০ সালে সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে ধীরেন্দ্রনাথ যোগ দেন প্রমথেশ বড়ুয়ার বড়ুয়া পিকচার্স কোম্পানিতে। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা দু’জনেই নাম লেখান বি এন সরকারের নিউ থিয়েটার্স-এ। নির্বাক সিনেমার পাশাপাশি সবাক সিনেমাতেও বহু কাজ করেছেন ধীরেন্দ্রনাথ। তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হল ‘হরগৌরী’ (১৯২৩), ‘দ্য স্টেপমাদার’ (১৯২৩), ‘চিন্তামণি’ (১৯২২), ‘চরিত্রহীন’ (১৯৩১), ‘হোয়াট নট’ (১৯৩১), ‘নাইট বার্ড’ (১৯৩৪), ‘বন্দিতা’ (১৯৪৫), ‘মরণের পারে’ (১৯৩১), ‘অলীক বাবু’ (১৯৩০), ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯২৭) এবং ‘কান্ট্রি গার্ল’ (১৯৩৬)। বাংলায় হাস্যরসাত্মক চলচ্চিত্রে স্মরণীয় হয়ে আছে তাঁর বেশকিছু কাজ। নিউ থিয়েটার্স-এর ব্যানারে ‘মাসতুতো ভাই’ এবং ‘এক্সকিউজ মি স্যার’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর পরিচালিত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘কার্টুন’ (১৯৪৯), ‘শেষ নিবেদন’ (১৯৪৮), ‘শৃঙ্খল’ (১৯৪৭), ‘আহুতি’ (১৯৪১), ‘অভিসারিকা’ (১৯৩৮), ‘দ্বীপান্তর’ (১৯৩৬) ইত্যাদি। শান্তিনিকেতনের ছাত্র হিসেবে মুখকে একটি মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করার শিক্ষা পেয়েছিলেন। হাস্যরসাত্মক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্যুটিংয়ের আগে নিজের নোটবুকে মুখের নানাবিধ ভঙ্গিমা ও অভিব্যক্তি আলাদাভাবে এঁকে রাখতেন।
আরও পড়ুন-অবনতির শীর্ষে মধ্যপ্রদেশ, রিপোর্ট প্রকাশ তৃণমূলের
ছদ্মবেশে ঘোরাঘুরি
ধীরেন্দ্রনাথ পোশাক-পরিচ্ছদ বা ছদ্মবেশ খুবই ভালবাসতেন। প্রায়ই মহিলার ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াতেন। একবার রাস্তায় সারা দিন ভিখারি সেজে প্রমথেশ বড়ুয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ডিজি অ্যান্ড বেঙ্গলি ফিল্মস’ নামে একটি বইও লিখেছিলেন। পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একটি ছবি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। অভিনয় করার কথা ছিল স্বয়ং কবির। কিন্তু কবি বিদেশ সফরে চলে যাওয়ায় কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। রবীন্দ্রকন্যা মীরা ছিলেন তাঁর আপন বউদি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন কবিগুরুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়া।
আরও পড়ুন-জলসঙ্কট মেটাতে ওয়াটার এটিএমে নিখরচায় জল
আশি পেরিয়েও নায়ক
বাংলা রঙ্গমঞ্চেরও দাপুটে অভিনেতা ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। সাতের দশকে তিনি ‘অলীকবাবু’ নাটকে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের নায়কের চরিত্রে টানা একশো-রাত্রি অভিনয় করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা তাঁর অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠেছিল। বাংলার বুকে এত বেশি বয়সে নায়কের চরিত্রে তাঁর সাবলীল সেই অভিনয়ের রেকর্ড এখনও পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি। ১৯৭৪ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন ধীরেন্দ্রনাথ। ১৯৭৫ সালে তাঁকে সম্মানিত করা হয় দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে। ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর তিনি চলে যান না-ফেরার দেশে। ৮৫ বছর বয়সে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ধীরেন্দ্রনাথ অভিনীত এবং পরিচালিত ছবিগুলো আজ আর দেখার সুযোগ নেই। কারণ কোথাও সেইভাবে সংরক্ষিত হয়নি। কেবলমাত্র কল্পনা লাজমির ‘ডিজি পাইওনিয়ার’ নামের একটি তথ্যচিত্রে পাওয়া যায় তাঁর অভিনীত সিনেমার কিছু ধারণা। আজ তিনি বিস্মৃতপ্রায়।