সময়টা ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম বা দ্বিতীয় দশক। শিয়ালকোট শহরে পীর হামজা গাউসের বিরাট প্রতিপত্তি। নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী এই পীর কোনও একটি ঘটনায় নগরবাসীর উপর রেগে গিয়ে তাঁদের ভূমিকম্প ও বজ্রপাতে মৃত্যুর অভিশাপ দিলেন। অভিশাপ কার্যকর করতে নিজেকে গৃহবন্দি করে তপস্যায় বসেন। শহরবাসী আতঙ্কিত কারণ পীরের কথা ফলবেই। শহরের প্রান্তে সেসময় এসে উপস্থিত গুরু নানকদেব। একটি কুল (বের) গাছের নিচে বসে শিষ্য মর্দানাকে পাঠালেন পীরের কাছে।
আরও পড়ুন-দুটি অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ
পীরের শিষ্যরা জানালেন দেখা করতে দেওয়া সম্ভব নয়। নগরবাসী এসে নানকের কাছে পীরের অভিশাপমুক্ত হওয়ার ভিক্ষা চায় নতজানু হয়ে। সবার চোখের সামনে নানকদেব প্রার্থনায় বসলেন। অকাল বজ্রপাতে মিনারের গম্বুজে ধরল ফাটল। প্রাণভয়ে ভীত পীরসাহেব বেরিয়ে এলেন ঘর ছেড়ে। নানকদেবের সঙ্গে পীরের হল সাক্ষাৎ। নানকদেব পীরকে বোঝালেন প্রকৃত সাধক সেই হয় যে মানবকল্যাণে নিজের রাগ অভিমান ত্যাগ করতে পারে। ক্ষমা দিয়ে মানুষের ভালবাসা পেতে হয়, অভিশাপ দিয়ে মানুষকে ভয় পাওয়ানো সাধকের কাজ নয়।
আরও পড়ুন-ময়দানে আর চলবে না ঘোড়ায় টানা গাড়ি! কী বলছে হাই কোর্ট
নানা দেবতার পুজো, আড়ম্বর, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, অভিশাপের বাইরে সকল মানুষের জন্য একই রকম ভালবাসা ছড়িয়ে ধর্মকে একটা সরল এবং প্রাণের করেছিলেন গুরুনানক। মানুষের জন্য একটাই ধর্ম— মানবতা। না কেউ হিন্দু না কেউ মুসলমান। ঈশ্বর একটাই, তাঁকে ডাকার জন্য হাজার নাম আর মূর্তির আড়াল খুঁজতে হয় না। মানুষকে ঈশ্বর অভিমুখী করে তাকে ধর্মপথে চালনা করার জন্য একজন সদগুরুর প্রয়োজন। সহজ কিছু পদ্ধতি এবং সরল এক বিশ্বাসকে জীবনদর্শন করে গুরুর দেখানো পথে ঈশ্বরের সাধনা আর সর্বজনে সেবা ও প্রেম ভালবাসার মাধ্যমে একজন মানুষ প্রকৃত মানবতার ধর্ম পালন করতে পারে।
আরও পড়ুন-বিপন্ন আমার দেশ, স্বদেশের সংবিধান
সাড়ে পাঁচশো বছর আগের এক মনোরম বসন্তে তিনি এসেছিলেন মানুষকে মানবতার ধর্ম শেখাতে। ১৪৬৯-এর ১৫ এপ্রিল দিল্লির সুলতানের অধীন তখন ভারতের লাহোরের রায় ভোয় কি তালবন্দি নামে এক জায়গায় নানকদেবের আবির্ভাব। তৃপ্তাদেবী আর কল্যাণ সিং মেহতা পৃথিবীতে আনলেন আলোর পথের দিশারিকে। ছোট থেকেই পড়ায় অমনোযোগী নানক ভালবাসতেন ঈশ্বরকথা, জপধ্যান। পড়ায় মন না থাকায় নানকদেবের একসময় কাজ হয়েছিল গোপালকের। ভারতের ইতিহাসে এক গোপালক বড় হয়ে মানুষকে গীতার আলোয় উদ্ভাসিত করেছিলেন তেমনই লাহোরের এই বালক, গোপালক থেকে কালের নানা পথ পরিক্রমা করে হয়ে উঠলেন এক নতুন ধর্মমতের প্রবক্তা— গুরুনানক।
আরও পড়ুন-আজ যোগদান-সহ তৃণমূলের প্রতিবাদসভায় মন্ত্রী, সাংসদ
ছোট বালকের মনে প্রশ্নের পাহাড় জমে। দিদি নানকির স্বামীর সাহায্যে রাজ দরবারে চাকরি জোটে। আরও অনেক হরিপদ কেরানির মতো জীবন কাটাতে জীবনসঙ্গী করেন সুলাখনীকে। পৃথিবীতে আসে পরবর্তী প্রজন্ম শ্রীচাঁদ ও লক্ষ্মীদাস। কিন্তু তিনি তো সত্যি হরিপদ নন তাই গৃহ তাঁকে আবদ্ধ করতে পারেনি। সারা এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন এক ঈশ্বরের খোঁজে মানুষকে ভালবেসে। কোথাও কোনও দেশ নানকের নাম রেখেছে নানক লামা, কেউ-বা গুরু রিমপোচে, শেখ নানক, নানকাচার্য, নানকঋষি। তিনি সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও সদাচরণের ওপর নির্ভর করে একটি অনন্য ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলন করতে সক্ষম হন। তাঁর প্রবর্তিত নতুন বিশ্বাস বা শিক্ষা থেকে আসে শিখ। যখন যখন ধর্মের মধ্যে আসে গ্লানি অর্থাৎ নানা আচরণের ভিড়ে ধর্মের আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায় তখন ঈশ্বর-প্রেরিত মানুষ আসেন ধর্মকে গ্লানি মুক্ত করে পুনরায় জাগরিত করতে। যতজন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে জন্মেছেন, তাঁরা সকলেই অদম্য কাজের ছাপ রেখে গিয়েছেন। অগণিত মানুষ তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করেছেন, অনুপ্রাণিত হয়েছেন। আধ্যাত্মিক যুক্তি ও অভ্যন্তরীণ শান্তির জীবনযাপনের মূলমন্ত্র শিখিয়েছেন তাঁরা। শিখধর্মের প্রবর্তক গুরুনানক ছিলেন সেই অসাধারণ একটি সত্তা। মানুষের কাছে ইক ওঙ্কার (এক ঈশ্বর)-এর বার্তা প্রচার করেছিলেন। বিশ্বাস করতেন যে স্রষ্টা তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যে তাঁর বাস। গুরুনানকের প্রথম শিষ্য তাঁর দিদি বিবি নানকী!
আরও পড়ুন-অভিযুক্ত সেই ৬ ছাত্রের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা যাদবপুুর বিশ্ববিদ্যালয়ে
৩০ বছর বয়সে তিনি প্রথম ও প্রধান শিক্ষা দান করেন। শিখ ধর্মের তিনটি স্তম্ভ গঠন করেন— ভান্ড চাককো-মানে সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া এবং যাঁদের প্রয়োজন তাঁদের সাহায্য করা, কিরাত করো— মানে কাউকে শোষণ না করে এবং কোনও প্রতারণা ছাড়াই সৎ জীবনযাপন করা ও নাম জপো— মানে ঈশ্বরের নাম নিয়ে ধ্যান করা এবং আমাদের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করা।
১৫০০-১৫২৪ সালের মধ্যে ‘উদাসিস’, শিখ ধর্মে এই সময়কে এই নামে আধ্যাত্মিক ভ্রমণ বলে থাকে— প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করেছিলেন। মক্কা, বাগদাদ, মদিনা, শ্রীলঙ্কা, তিব্বত, কাশ্মীর, বাংলা ও মণিরপুরের মতো স্থানগুলি ভ্রমণ করেছিলেন। ভাই মর্দানা এবং তার রবাবের সুরে গুরু নানক তাঁর বাণী প্রচার করেছিলেন নানা জায়গা ঘুরে। গুরুনানকই প্রথম লঙ্গর প্রচলন করেন। লঙ্গর হল একই স্থানে জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পাশাপাশি বসে আহার করার রীতি। গুরু নানক লাহোর থেকে খানিক দূরে বিশাল জলাশয়ের ধারে একটি উপাসনা স্থান গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই জলাশয়ের নাম দিয়েছিলেন অমৃত সায়র। তবে সেই স্বপ্ন তাঁর জীবদ্দশায় সমাপ্ত করা যায়নি। পরবর্তীকালে সেই স্বপ্নপূরণ করেন শিখ গুরু অর্জুন শিং।
আরও পড়ুন-ভিন রাজ্যের ভোটে বাংলার স্কিম নকল
গুরুনানকের জন্মদিবস এপ্রিলে হলেও কার্তিক পূর্ণিমার দিন বা রাস পূর্ণিমায় পালিত হয় তাঁর জন্মতিথি। কেউ বলেন এই দিন তাঁর আধ্যাত্মিক উপলব্ধির দিন, সোজা কথায় ঈশ্বরের দর্শন পাওয়ার দিন। এই উপলক্ষে প্রায় তিনদিন ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে নানক জয়ন্তী পালন করা হয়। উৎসবের সূচনা হয় শিখদের পবিত্র গ্রন্থগুরু গ্রন্থসাহিব পাঠের মাধ্যমে। একটানা ৪৮ ঘণ্টা এই গ্রন্থসাহিব পাঠ করা হয়। কোনওরকম বিরাম ছাড়া। একে বলে অখণ্ড পাঠ। এই দিনে শিখ ধর্মাবলম্বীরা গুরুনানক দেবের শিক্ষা অনুসরণ করে শপথ নেয়। আগের দিন থাকে শোভাযাত্রা-সহ নগর পরিক্রমা।
আরও পড়ুন-আজ যোগদান-সহ তৃণমূলের প্রতিবাদসভায় মন্ত্রী, সাংসদ
গুরুনানক দেব ইরাবতী নদীর ধারে একটি জনপদে নিজের অনুগামীদের নিয়ে এক বসতি শুরু করেন। সেটি এখন পাকিস্তানের কর্তারপুর। সমবেত খেত চাষ এবং একটি সম্প্রদায়ের রান্নাঘর বা লঙ্গর স্থাপন করেছিলেন। তিনি সেখানে শিখ সম্প্রদায়কে একত্রিত করেন এবং ২২ সেপ্টেম্বর ১৫৩৯ তারিখে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ১৮ বছর এখানে ছিলেন।
ঈশ্বরের প্রেরিত যে-সকল বিশেষ ব্যক্তি আসেন মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যেতে তাঁদের জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে তার কোনও বাস্তব ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যেমন শিয়ালকোটের সেই ঘটনাটির পর বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল কুলগাছটি। গাছটির অদূরে, গুরুনানকের ভক্ত নাথা সিংহ তৈরি করেছিলেন গুরুদ্বার ‘বাবে দি বের সাহিব’, গুরুনানকের এই ঘটনাটিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে। গুরুনানকের স্মৃতিমাখা সেই কুল গাছটি আজও জীবিত আছে। আজও আছে পীর হামজা গাউস সাহেবের সেই ফাটল ধরা গম্বুজটিও। এই অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। লেহ শহরের কাছে পাত্থরসাহিব গুরুদ্বার এমন এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী। দুষ্ট লোকের গড়িয়ে দেওয়া পাথর নানকদেবের শরীরে লাগতেই তা মোমের মতো নরম হয়ে যায় এবং তাতে তাঁর পিঠের ছাপ পড়ে। সেই পাথর তো রাখাই আছে, বাকিটা তর্কে বহুদূর। কর্তার সিং দুগ্গালের লেখা ছোট গল্পে পাই মর্দানার তেষ্টা মেটানোর জন্য পাথর তুলে জল বার করলে উপরে জল দিতে নারাজ বলি কান্ধারির কুয়োর জল ফুরিয়ে যায়। এমনকী মৃত্যুকে ঘিরেও অলৌকিকতা। জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, গুরুনানকের মৃত্যুর পর স্থানীয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। মুসলমানরা, যারা তাঁকে তাদের পীর হিসাবে দেখেছিল, তারা তাঁকে কবরস্থ করতে চেয়েছিল। হিন্দুরা, যারা নানককে তাদের গুরু বলে দাবি করেছিল, তারা তাঁর মৃতদেহ দাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু কিংবদন্তি অনুসরণ করে যে গুরুনানকের দেহ ফুলে পরিণত হয়েছিল, যা তখন দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্ত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-আজ যোগদান-সহ তৃণমূলের প্রতিবাদসভায় মন্ত্রী, সাংসদ
গুরু নানকদেব তাঁর ‘গুরু’ত্বের গুরুভার দিয়ে গিয়েছিলেন গুরু অঙ্গদের হাতে। দশম গুরু গোবিন্দ সিং এই গুরুদায়িত্ব ব্যক্তিমুক্ত করেন। সেই অবধি শিখদের এগারোটি ধর্মগুরু— একাদশতম হল নানকদেব-সহ সকল গুরুবাণী সংবলিত গুরু গ্রন্থসাহিব। প্রতিটি গুরুদ্বারে বিশেষ যত্নে যেটি রক্ষিত ও পঠিত হয়।
যে বিশেষ দিক শিখ ধর্মের দর্শন বলা যায় সেগুলো নানকদেব সহজে ভাবতে শিখিয়েছিলেন।
একমাত্র ঈশ্বর আছে— একটি তত্ত্ব যার উপর জোর দেওয়া হয়েছে ‘এক ওঙ্কার’ কথায়। এই শব্দগুচ্ছ শিখধর্মে ব্যবহৃত এক পরম সত্তাকে বোঝাতে যা মহাবিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। গুরুনানক জাতিভেদের বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি পুরোহিত এবং আচার-অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের অবতার বা এমনকী একজন নবিও নন, কিন্তু প্রত্যেকে সরাসরি ঈশ্বরের সঙ্গে ‘কথা বলতে’ পারে। ভগবানের ধারণা হল ‘ওয়াহিগুরু’, এমন একটি সত্তা যা আকৃতিহীন, নিরবধি, সর্বব্যাপী এবং অদৃশ্য। ঈশ্বরের অন্যান্য নাম হল আকাল পুরখ এবং নিরঙ্কার। নানক চরিত্র ও কর্মের বিশুদ্ধতা এবং দাতব্য ও নিঃস্বার্থ সেবার উপর অত্যন্ত জোর দেন। হিন্দুধর্মের অনেক ধারণাও শিখ ধর্মে দেখা যায়। যেমন মায়া, কলিযুগ, জন্মমৃত্যুর বন্ধন মুক্তি বা পরিত্রাণ, পুনর্জন্ম এবং কর্মের ধারণা। আসলে শিখ ধর্ম হল নানা ধর্মের সংস্কারমুক্ত সেতুবন্ধন।
আরও পড়ুন-হারমোনিয়াম
গুরুনানকের জন্মস্থান তালবন্দি গ্রাম এখন পাকিস্তানে। নানকদেবের সম্মানে তার নাম নানকানা সাহিব, শিখদের অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান, গড়ে উঠেছে বিশাল গুরুদোয়ারা জনমআস্থান। কর্তারপুর, যেখানে গুরুনানক মারা গিয়েছিলেন বলে কথিত আছে, সেখানেই নির্মিত গুরুদ্বারটি শিখ ধর্মের আরেক বৃহত্তম তীর্থ।
যে মহামানব ধর্মকে গ্লানিমুক্ত করে এক ওঙ্কারের খোঁজে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছেন, যিনি হিন্দু বা মুসলমানের বাইরে মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছেন, আজ তাঁরই দেখানো পথ অনুসরণ করে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মের স্বীকৃতি পেয়েছে শিখধর্ম। তবুও এক ওঙ্কারের খোঁজে নানকানা থেকে কর্তারপুরের জার্নি মানুষকে সম্পূর্ণ গ্লানিমুক্ত করতে পারেনি। পারলে কর্তারপুর করিডর থাকত বাধাহীন— উন্মুক্ত, বিশ্বজনীন।