প্রশংসিত প্রথম ছবি
বিজ্ঞাপন থেকে চলচ্চিত্রে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। একই পথ অনুসরণ করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। দু’জনেই বাংলা ছবিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে। এবার বিজ্ঞাপন থেকে চলচ্চিত্রে এলেন নবীন পরিচালক অভিজিৎ শ্রীদাস। তিনি মূলত অ্যাড ফিল্ম মেকার। এই প্রথম বানালেন ফিচার ফিল্ম। পূর্বসূরিদের সঙ্গে কোনও তুলনা না টেনেই বলা যায়, টলিউডের মননশীল ছবির পরিচালকদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে আসা এখন সময়ের অপেক্ষা। ২৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেঙ্গলি প্যানোরামা বিভাগে দেখানো হয়েছে তাঁর ছবি ‘বিজয়ার পরে’। প্রথম বড় ছবিতেই এই পরিচালক নিজের জাত চিনিয়েছেন। পেয়েছেন চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের প্রশংসা। তিনি যে লম্বা রেসের ঘোড়া, বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রসদনের একতারা মুক্তমঞ্চে শুরু হল কবিতা উৎসব, হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্রাত্যর গর্জন
আটপৌরে পরিবারের গল্প
তারকাসমৃদ্ধ ছবি ‘বিজয়ার পরে’। অকারণ আঁতলামো ভরে দিয়ে বাজার ধরতে চাননি পরিচালক। অপরাধ, যৌনতা, গোয়েন্দা, থ্রিলারের বাইরে বেরিয়ে বলেছেন আটপৌরে পরিবারের গল্প। নির্ভেজাল সম্পর্কের গল্প। কিছু অভিমানী কথার মনকেমনের গল্প। বৃদ্ধ দম্পতি এই ছবির ভিত্তি। দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন দীপঙ্কর দে এবং মমতা শঙ্কর। তাঁদের জুটিকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’ ও ‘আগন্তুক’ ছবির মাধ্যমে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আবহমান’ ছবিতেও দেখা গিয়েছিল এই জুটিকে। তারপর আবার ‘বিজয়ার পরে’ ছবিতে। নবীন পরিচালক এই ক্ষেত্রেও যেন অনুসরণ করলেন তাঁর পূর্বসূরিদের।
আরও পড়ুন-কৃষকদের আরও উন্নয়নে হল বৈঠক
বর্তমান সময়ের জ্বলন্ত সমস্যা
ছবিতে মমতা শঙ্করের নাম অলকানন্দা, দীপঙ্কর দে-র নাম আনন্দ। তাঁরা গুলঞ্চ বনেদি বাড়ির দম্পতি। ক্রমশ নিরুদ্দেশ হতে থাকা মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়ান। এই মানুষগুলো আর কেউ নন, তাঁদের পুত্রকন্যা। বাবা-মায়ের শেষ বয়সে সময় দেওয়া তো দূর অস্ত, একসঙ্গে থাকার ইচ্ছেটুকুও কারও মধ্যে নেই। কর্মব্যস্ততা আর পরিস্থিতির চাপে তাঁরা থাকেন দূর শহরে। সারাদিন দৌড় আর দৌড়। ফলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঘিরে জন্ম নেয় চরম একাকিত্ব। গুলঞ্চ বাড়িতে তাঁরা টিমটিম করে জ্বলতে থাকেন। প্রদীপ শিখার মতো। খাঁ খাঁ বাড়িতে হাতড়ে বেড়ান হারানো অতীত। ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেমেয়েদের মুখ। পরমুহূর্তেই বাস্তবে ফেরেন। চোখ ভিজে যায় জলে। দু’জনেই অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন নিজেদের অসহায়তা। বর্তমান সময়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা পর্দায় তুলে ধরেছেন পরিচালক।
টিপিক্যাল হিরোইন হতে চাননি
ছবির প্রেক্ষাপট দুর্গাপুজো। সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বাড়ির মেয়ের ঘরের ফেরার গল্প। এই মেয়েই স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। পর্দার মৃন্ময়ী ওরফে মিনু। ছবির শুরুতেই বিসর্জনের প্রতিমার সাজে চালচিত্রের উপর মানবী রূপী দুর্গার ভূমিকায় স্বস্তিকার লুক এবং অভিনয় অসামান্য। প্রথম দৃশ্যেই দর্শকদের মন জয় করে নেন। যদিও অনেকটা পরে তাঁর অভিনয় পূর্ণতা পায়। আসলে কোনও দিনই টিপিক্যাল হিরোইন হতে চাননি স্বস্তিকা। হতে চেয়েছিলেন সু-অভিনেত্রী। বহু আগেই লক্ষ্য পূরণ করেছেন। সিনেমা হোক বা সিরিজ, বেছেছেন টানটান চিত্রনাট্য, যেখানে নিজের চরিত্রের গুরুত্ব রয়েছে, সুযোগ রয়েছে নিজেকে যথার্থভাবে প্রকাশ করার। তাঁর সমবয়সি, যাঁরা একসময় নাচ-গানের নায়িকা ছিলেন, আজ অনেকেই ফুরিয়ে গেছেন, বুড়িয়ে গেছেন। কিন্তু স্বস্তিকা প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে চলেছেন। এখন তাঁকে সামনে রেখে বোনা হয় চিত্রনাট্য। তৈরি হয় নারীকেন্দ্রিক ছবি, সিরিজ। ‘বিজয়ার পরে’ ছবিতে তাঁর অভিনয় আলাদা উচ্চতায় পৌঁছেছে। মিনু চরিত্রটি নির্মল। পরিবারের মধ্যে একঘরে। বাবার ত্যাজ্যকন্যা। পিছনে রয়েছে বড় কারণ। দু’জনের মধ্যে দূরত্ব রচিত হলেও, বৃদ্ধ বাবা পাড়াতুতো নাতনির মধ্যে কন্যা মিনুকে আজও দেখতে পান। অভিমানের পাহাড় উঠেছে মধ্যিখানে। তবে বাবা-মেয়ের সম্পর্কের সুতোটা পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যায়নি। এমন নিঃসঙ্গ বিষাদের মাঝেই এসে পড়ে দুর্গাপুজো। নতুন উদ্যমে জীবন শুরু হয়। সেই উপলক্ষে দূরে থাকা ছেলেমেয়েদের ঘরে ফিরতে বলেন বৃদ্ধ দম্পতি। আমন্ত্রণ যায় মিনুর কাছেও। তারপর ঘটতে থাকে একটার পর একটা ঘটনা। শেষটা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো।
আরও পড়ুন-৮ জানুয়ারি সাগরে মুখ্যমন্ত্রী
নতুন বছরের উপহার
একজন মনস্তত্ত্ববিদের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মীর। পুরোপুরি সিরিয়াস চরিত্র। নেই কমেডির ছিটেফোঁটা। বিদীপ্তা চক্রবর্তী অভিনীত বড়বউ চরিত্রটি নেতিবাচক। তবে নজর কেড়েছেন। বড় ছেলে হিসেবে পদ্মনাভ দাশগুপ্ত যথারীতি মার্জিত। অন্যান্যদের অভিনয়ও প্রশংসাযোগ্য। সংগীত পরিচালক রণজয় ভট্টাচার্য ছবির গানগুলোয় সুরুচির ছাপ রেখেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে আধুনিক, প্রতিটি গানের সঙ্গীতায়োজন অপূর্ব। রবীন্দ্রসঙ্গীতের উপর কোরিওগ্রাফি করেছেন মমতা শঙ্কর। যদিও নিজে নাচে অংশ নেননি। প্রসেনজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেক আপ প্রশংসনীয়। চমৎকার পোশাক পরিকল্পনা অভিষেক রায় ও সন্দীপ জয়সওয়ালের। সবমিলিয়ে নতুন বছরের শুরুতে একটি অসাধারণ বাংলা ছবি উপহার পেতে চলেছেন দর্শকরা। ‘বিজয়ার পরে’ বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে ১২ জানুয়ারি।