ক্ষত

ঘটনাটা যখন প্রথম ঘটে তখন বিলাস সামন্ত ক্লাস ফোরের ছাত্র, বয়স নয়-দশ।

Must read

অভিজিৎ রায়: ঘটনাটা যখন প্রথম ঘটে তখন বিলাস সামন্ত ক্লাস ফোরের ছাত্র, বয়স নয়-দশ। মানে ঘটনাটা অনেকটাই পুরোনো আর-কী! সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে কুড়ি বছর আগের কথা। তখন ইস্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার শেষ দিন। শুক্রবার। বিষয় ভূগোল। পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ সময় শেষ হতে তখনও প্রায় আধ ঘণ্টা বাকি। একটিও খাতা তখনও জমা পড়েনি শিক্ষকের টেবিলে। তড়িঘড়ি উত্তরপত্র জমা করার উদ্যোগ নিল বিলাস এবং বিপত্তিটা ঘটল ঠিক তখনই। উত্তরপত্রটা হাতে নিয়ে, প্রথম পাতাটার উপরের দিকে কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি স্থির করে বসে রইলেন শিক্ষক। শিক্ষক মানে নীলেশ সমাদ্দার। নীলেশবাবু পড়াতেন বাংলা এবং ইংরেজি। ভূগোল এবং ইতিহাস পড়াতেন প্রবীর সাবুই। যাই হোক, খাতার পাতা থেকে নীলেশবাবু যখন দৃষ্টি তুললেন তখন তাঁর চোখজোড়ায় যেন আগুন জ্বলছে, চোয়াল শক্ত, ভ্রু কুঞ্চিত। কোনও প্রকার ভূমিকা না করেই বিলাসের ডান কানটা আচ্ছা করে মলে দিয়ে, মাথায় সজোরে একটা গাঁট্টা বসিয়ে দিয়ে নীলেশবাবু বলেছিলেন, ‘গাধা কি আর গাছে ফলে রে! নিশ্চয়ই মাঠে গিয়ে বল পেটানোর বেগ পেয়েছে তাই এত তাড়া, তাই না?’
বিলাসের চোখে তখনও বিস্ময়ের মাখামাখি। খাতাটি ঘরভর্তি ছাত্রদের উদ্দেশে তুলে ধরে নীলেশবাবু বলেছিলেন, ‘‘এ ব্যাটা ভূগোল বানানে ‘ওকার’টাই হজম করে ফেলেছে।”

আরও পড়ুন-কথা হল কবিতায়

অবশেষে ব্যপারটা বুঝতে পেরেছিল বিলাস। কানমলা বা গাঁট্টায় সে বিশেষ কিছু মনে করেনি, কিন্তু একঘর পরীক্ষার্থীদের সামনে তাকে ‘গাধা’ বলে সম্বোধন করায় মনে মনে সে একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছিল। এই পশুর তকমাটা যে স্কুল গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু মোটেই নয়। বাড়ির পরিসরেও ছোটখাটো ভুলের মাশুল হিসেবে প্রায়শই তাকে তুলনা করা হয়েছে ইতর প্রাণীর সঙ্গে। এই যেমন, দোকান থেকে নুন আনতে পাঠানো হয়েছে বিলাসকে। সেও কী খেয়ালে সোডা নিয়ে চলে এসেছে! ঘটনাটা একটু তলিয়ে দেখা গেছে, বিলাস ‘নুন’ নামটি ভুলে গিয়ে স্রেফ সাদা গুঁড়ো কিছু একটা আন্দাজ করে সোডা কিনে নিয়ে এসেছে।
‘ছাগল ঘাস-পাতা খেলেও তোর থেকে বেশি বুদ্ধি ধরে’, ঝাঁঝালো গলায় বলেছিল মা। বাবাও ওই জাতীয় কিছু একটা বলে তিরস্কার করেছিল। এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। একসময় ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে উঠেছিল বিলাসের।
বিলাসের বয়স এখন সাতাশ। একটা বেসরকারি অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্টের পদে বহাল হয়েছে বছর তিনেক। মাইনে খুব বেশি নয়। উদ্বাস্তু শখ-আহ্লাদ ছেঁটে ফেলতে পারলে মোটামুটি মাসের খরচটুকু চলে যায়। তা হোক। চাকরি যে একটা খুঁটি সেকথা খুব ভাল করেই জানে বিলাস। প্রতিকূল স্রোত আছড়ে পড়বে কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে হলেও সেই খুঁটি শক্ত করে ধরে রাখতে হবে— জীবনের এই গোপন মন্ত্র এতদিনে উপলব্ধি করে ফেলেছে সে।

আরও পড়ুন-চলতি বছরে সবুজসাথী প্রকল্পে বাড়ছে আরও ৩ লক্ষ, ১৫ লক্ষ সাইকেল দেবে রাজ্য

চাকরির মাত্র দিন দশেকের মাথায় বস, সৌমিক সান্যাল যেদিন সামান্য একটা হিসেবে গরমিলের কারণে রাগে জ্বলে উঠেছিলেন, এবং তারপর অডিটের ফাইলটা ছুঁড়ে মেরেছিলেন সটান বিলাসের মুখের উপর, সেই মূহূর্তে তাঁর মনে হয়েছিল খুঁটিটা যেন আস্তে আস্তে হাতের মুঠি আলগা করে ছাড়িয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু না, খুঁটি হাতছাড়া হতে দেয়নি বিলাস। প্রাণপণ চেষ্টায় চোখের জল সামলে নিয়েছিল সেদিন।
দিন পাঁচেক আগের কথা। গড়িয়াহাট থেকে অফিস যাবে বলে বাসে উঠেছে বিলাস। ভিড়ে ঠাসা বাসের পেটটা যেন দরজায় এসে উপচে পড়ার জোগাড়। এসব পরিস্থিতির বিষয়ে নিত্যযাত্রীরা ওয়াকিবহাল। বাসের দরজা দিয়ে উঠতেই ডানদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে। যুবতী। সম্ভবত কলেজ ছাত্রী। বেখেয়ালে বিলাসের জুতোর নিচে চলে এল মেয়েটির পা। এক তীক্ষ্ণ চিৎকারের পর যে একটি ইংরেজি শব্দ মেয়েটির মুখ থেকে আছড়ে পড়েছিল তার অর্থ তৎক্ষণাৎ জানা ছিল না বিলাসের। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল সে। চারিপাশের জোড়া-জোড়া চোখ তখন বিলাসের উপর নিবদ্ধ। একটা অস্বস্তি মনের উপর চেপে বসেছিল বিলাসের। থেকে থেকে সেই ইংরেজি শব্দটা অনুরণিত হয়েছে কানে, বলা ভাল বিলাস নিজেই শব্দটি রোমন্থন করে স্মৃতিতে জিইয়ে রাখতে চেয়েছিল। রাতে বাড়ি ফিরে শব্দটির অর্থ খুঁজে পেয়েছিল বিলাস— শূকর। ইস্, লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল তার।
আজ সকাল থেকেই আকাশ যেন অভিমানী। বুকে জমিয়েছে কৃষ্ণকায় দুঃখের পাহাড়। সন্ধের পর আর সে ভার বহন করতে না পেরে উপুড় করে দিয়েছে। মুষলধারায় বৃষ্টি বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। অফিস থেকে বিলাস যখন বেরল তখন ঘড়িতে দশটা বেজে গেছে, অর্থাৎ চার ঘণ্টা লেট। উপায়ও তো নেই। গ্রাম থেকে এসে গড়িয়ার এক মেস বাড়িতে উঠেছে সে। বিয়ে-থা করেনি, ফলে ঘরে ফেরার তাগিদও যে কম তা বোঝাই যায়।

আরও পড়ুন-নলেন গুড় বাংলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের এক সুমধুর পরম্পরা

রাস্তাঘাট জলের তলায়। বাস স্টপ এখান থেকে মিনিট দশেক। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। প্যান্টটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিল বিলাস। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝলক আকাশের বুক চিরে দিয়ে যাচ্ছে। বাঁ দিকের ফুটপাথ ধরল বিলাস। বিভিন্ন আশ্রয়ের তলায় জমে থাকা ভিড় এখন পাতলা হয়ে এসেছে।
বাস কি পাওয়া যাবে? নিজের মনে মনে প্রশ্নটা করল বিলাস। শেষ বাস ক’টায় যায় তার জানা নেই। বাস না পেলে একমাত্র অ্যাপ ক্যাবই ভরসা। অফিসের অনেকেই ব্যবহার করে, বিলাস দেখেছে। খুব সহজ ব্যাপার— অ্যাপ ডাউনলোড করো, নিজের ডিটেল দিয়ে রেজিস্ট্রেশন, লোকেশন ও ডেস্টিনেশন সেট করে ক্যাব বুকিং। এসব তার কলিগ রিনি, মানে রুক্মিণী দস্তিদারের কাছে শিখেছে বিলাস। একবার শখ করে অ্যাপ ক্যাব বুকিং করার চেষ্টাও করেছিল সে। ডেস্টিনেশনে ‘৮/ডি বি আর রোড’ উল্লেখ করতেই ভাড়া দেখিয়েছিল ছয়শো বাইশ টাকা। চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল বিলাসের। বাস, দু’বার অটো চড়ে বিলাসের বাড়ি ফিরতে খরচ হয় ঠিক একান্ন টাকা। তৎক্ষণাৎ সেই অ্যাপকে বিদায় জানিয়েছিল সে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি প্রতিকূল। খরচের কথা ভাবলে এখন চলবে না। মানি ব্যাগে আটশোর কিছু বেশি আছে, সে জানে। মোবাইলটা বার করে প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটা ডাউনলোডে বসিয়ে দিল বিলাস।
হঠাৎ এক আতঙ্কের চিৎকার বিলাসের কানে আছড়ে পড়ল। একটি মেয়ের গলা। চমকে উঠল বিলাস। পঞ্চাশ মিটার দূরে বাঁহাতে একটি অন্ধকার গলি। আওয়াজটা যে ওদিকটা থেকেই আসছে তা বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হল না তাঁর। বিবেচনার সময় নেই। ফলে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাকে সামলে নিয়ে সেদিকে ছুটে গেল বিলাস।

আরও পড়ুন-যে মোয়ায় শীতের ছোঁয়া

জনশূন্য গলিটির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে বিলাস। একটি মাঝবয়সি, বলিষ্ঠ গঠনের ছেলের শক্ত মুঠিতে ধরা একটি যুবতী মেয়ের হাত। চলছে অসম লড়াই। মেয়েটির গলা চিরে বেরিয়ে আসছে আর্তচিৎকার। ছেলেটিকে সঙ্গত দিতে পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটি ছোকরা। রাস্তার ফ্যাকাসে আলোতেও তাদের হিংস্রতা স্পষ্ট আঁচ করা যায়। মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে আরও খানিকটা আড়ালে। চোয়াল শক্ত হয়ে এল বিলাসের। এমন বেপরোয়া আগে কখনও মনে হয়নি নিজেকে। অতর্কিতে ছুটে গিয়ে দুষ্কৃতীদ্বয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তার ভেতরে যে এত রাগ জমাট ছিল কই আগে তো কখনও টের পায়নি সে! মিনিট পাঁচেক ধরে চলল ধস্তাধস্তি। বিলাস বেশ খানিকটা আহত হয়েছে। জলে-কাদায় মাখামাখি অবস্থা। ছেলে দুটো অবশেষে নিরুপায় হয়ে গালাগাল দিতে দিতে চম্পট দিয়েছে। হাতের শিকার হাতছাড়া হয়ে গেলে যা হয় আর কী।
ব্যাগটা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল বিলাস। টপ টপ করে জল চুঁইয়ে পড়ছে তার থেকে। মেয়েটির দিকে এই প্রথম সরাসরি তাকানোর সুযোগ পেল বিলাস এবং সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল একটি ইংরেজি শব্দ ‘সোয়াইন’ যার অর্থ বিলাস এখন বিলক্ষণ জানে।
‘আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব? আপনি না থাকলে এই জানোয়ারগুলো…থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ’, আবেগতাড়িত গলায় কোনওক্রমে কথাগুলি বলল যুবতী।

আরও পড়ুন-যে মোয়ায় শীতের ছোঁয়া

কথাগুলির কোনও উত্তর না দিয়ে বড় রাস্তাটার দিকে পা বাড়াল বিলাস।
‘দাদা, শুনছেন, একটু দাঁড়াবেন, দাদা…আমাকে একটু এগিয়ে দেবেন…’
মেয়েটির আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর পেছন থেকে জোলো বাতাস ভেদ করে ভেসে আসছে। বিলাস এগিয়ে চলেছে। জামার একটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। মাত্র দু’মাস আগে জামাটা কিনেছে সে। দামটাও তো নেহাত কম নয়। দরাদরি করে তিনশো পঁচাত্তরে পেয়েছিল। লোকসানের হিসেবটা মনে মনে কষতে কষতে এগিয়ে চলেছে বিলাস। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইলটা বার করে আনল বিলাস। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অ্যাপটা ডাউনলোড হয়ে গেছে! অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article