দেশ স্বাধীন হচ্ছে। ১৯৪৭। আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে দিল্লি। সেখান থেকে বহুদূরে এক প্রায় অন্ধকার পোড়ো রাজবাড়িতে বিমর্ষ হয়ে সময় কাটাচ্ছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান পুরুষ মহাত্মা গান্ধী। বাংলার কলকাতায়। মুসলমান অধ্যুষিত বেলেঘাটায়। সারাদিন অনশনে আছেন। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। এক মনে প্রার্থনা করছেন শান্তি ও ঐক্যের।
আরও পড়ুন-উন্মাদনায় ফিরল আসিয়ানের স্মৃতি
বাংলায় নানা সময়ে গান্ধী এসেছেন, নেতাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। কংগ্রেসের অধিবেশন উদ্বোধন করেছেন। কলকাতা সংলগ্ন সোদপুরে গান্ধী আশ্রম গড়ে উঠেছে। যাকে গান্ধীর দ্বিতীয় বাড়ি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি নিজেই। নোয়াখালি বা কলকাতায় যখন দাঙ্গা হচ্ছে, আর্ত মানুষের পাশে থেকেছেন গান্ধী। নোয়াখালির ঘটনা আজও আমাদের শিহরিত। অনেকে নিষেধ করলেও তিনি নোয়াখালি গেলেন। ১৪৭টা গ্রামে গিয়েছিলেন। ৭ সপ্তাহ হেঁটে ছিলেন ১১৬ মাইল। তখন তাঁর বয়স ৭৭। শান্ত হয়েছিল নোয়াখালি। তাঁর কথায় ও কাজে কোনও ফারাক ছিল না। কলকাতা দাঙ্গার সময়েও অনশন করে তিনি মানুষের শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছেন।
বাংলাতে গান্ধী কতখানি গ্রহণযোগ্য ছিলেন এটা নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। গান্ধীর কর্মধারা বাঙালি কতখানি গ্রহণ করেছে সেটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। ভবিষ্যতেও হবে। গান্ধীর প্রতি বাঙালির আবেগ ছিল এবং আছে। কিন্তু পরিমাণে খানিকটা কম সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেন এটা হয়েছে সেটা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে।
আরও পড়ুন-এবার আবাস যোজনার বাড়ি করে দেওয়ার উদ্যোগ রাজ্যের
বাংলাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র অভিযানটি ছিল খুবই ইতিবাচক ও উজ্জ্বল। দেশের যুবরা বিশ্বাস করতেন অনুরোধ উপরোধ করে স্বাধীনতা আসবে না। লড়াইয়েই আনতে হবে। অহিংসা সেখানে একেবারেই একটা ম্যাড়মেড়ে ব্যাপার। মা কালীর মূর্তির সামনে বুক চিরে রক্ত দিয়েছে বাঙালি যুবক। ক্ষুদিরামের মতো বাচ্চা ছেলে কোমরে পিস্তল নিয়ে সাহেব মারতে গিয়েছে। প্রফুল্ল চাকী শহিদ হয়েছে। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, গণেশ ঘোষ সাহেবদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে বাংলার প্রান্তে প্রান্তে তরুণ জীবনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। মেয়েরাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে এমন আন্দোলনে। তার সঙ্গে চরকা-কাটা আর অহিংসা মিলতে পারে না। বাংলার বেশির ভাগ মানুুষ সেটাই তখন মনে করে। বাংলায় গান্ধীতত্ত্বের চর্চা তখন বাহুল্য। এ ছাড়াও এ রাজ্যে দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহ্য। অগ্নিযুগের বিপ্লবী নায়করা যাঁরা কালাপানি গিয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন তাঁরা অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। গান্ধীচর্চা তাদের কাছে সময় নষ্ট হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। তা ছাড়া এ রাজ্যে দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট শাসনের অধীন ছিল। তারা প্রকাশ্যে গান্ধীর অবমাননা না করলেও গান্ধীর তত্ত্বগুলির চর্চাতে উৎসাহ দেখায়নি।
আরও পড়ুন-আজ দুই দিনাজপুরে মুখ্যমন্ত্রী
বাংলায় নেতার অভাব নেই। ধর্মীয় বা রাজনীতি কোথাও কোনও সঙ্কট হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ আছেন। তাদের প্রভাব বাংলায় আপামর জনমানসের উপর গভীরভাবে পড়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে গান্ধীর দেখা হয়নি। কোনও আলোচনা হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাংলার মানসে রবীন্দ্রনাথের ছায়া অকাশ বিস্তীর্ণ। গান্ধীর সকল মতামতের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একমত ছিলেন না। যেমন চরকা-কাটা। রবীন্দ্রনাথ একমত হননি। বিহারের বিশাল ভূমিকম্প সম্পর্কে গান্ধীর বক্তব্যের প্রতিবাদই করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের তাৎক্ষণিক মতামতকে অপরিণত বলেছেন গান্ধী। আবার গান্ধী রবীন্দ্রনাথকে বলেছেন গুরুদেব। আর তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের মহাত্মা। শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর ট্রাস্টির সদস্য হতে চাননি গান্ধী। সম্পর্কটা কেমন ধারা রয়ে গিয়েছে।
দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র। বাঙালির চোখের মণি। বিলেত থেকে ফিরে প্রথম যিনি একগুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে গেলেন মণিভবন-গান্ধীর কাছে। সব উত্তর মনেঃপূত হল না সুভাষের। গান্ধীর নির্দেশে এলেন চিত্তরঞ্জনের কাছে। কলকাতায়। মনের মানুষ খুঁজে পেলেন। পথচলা শুরু সুভাষের। গান্ধীর সঙ্গে মত বিরোধেরও সূচনা। শেষ পর্যন্ত গান্ধীর ইচ্ছায় সুভাষ কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। সুভাষের ভাষণেই দেশবাসী শুনল স্বাধীনতার পর দেশ কি পরিকল্পনায় চলবে। তাঁর ভাষণে গান্ধী বামপন্থীদের গন্ধ পেলেন। সুভাষকে নিজপুত্র বলে সম্মােধন করেও ‘বখে যাওয়া ছেলে’ বললেন। পরের বার আর সুভাষকে সভাপতি হতে পছন্দ করলেন না। সুভাষচন্দ্রও জেদ ধরলেন। গান্ধী পাল্টা প্রার্থী দিলেন। হেরে গেলেন। সুভাষ জয়ী হলেন। শেষপর্যন্ত সুভাষ কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হলেন এবং আলাদা দল করলেন। সুভাষ তখন বাঙালির চোখে ‘হিরো’। গান্ধী হলেন খলনায়ক। আপামর বাঙালি বিশ্বাস করে নিল সুভাষের দুর্গতি এবং দেশত্যাগের জন্য গান্ধী দায়ী। এমন অবস্থায় গান্ধীভক্তি ও গান্ধীচর্চা বাংলায় কী করে বাড়তে পারে? বাড়েনি। সে কারণেই বাঙালির কাছে গান্ধীর কাছে সুভাষ বড় নেতা। আজও।
আরও পড়ুন-হাড়ে হিম
১৯২৫ সাল। ৭ জুন। একটা লেখাতে গান্ধীজি বলছেন “I am not able to leave Bengal and Bengal will notlet me go.” বোঝা যায় কথাগুলো হৃদয় থেকে উচ্চারণ করেছেন। ২১ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে, অনেক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে দেশে ফিরলেন। ৩২ বছর কাটালেন ভারতে। বারবার তাঁর আহ্বানে দেশ তোলপাড় হয়েছে। মানুষ দলে দলে অসহযোগ আন্দোলন, পদযাত্রা, সত্যাগ্রহে যোগ দিয়েছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের তিনি প্রধান মুখ। সারা দেশ চষে ফেলেছেন। গ্রামের পর গ্রাম পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন। তিনি জানতেন দেশকে, দেশের মানুষকে জানতে হবে। তাহলে এই কষ্টকর কাজটি তাঁকে করতেই হবে। তিনি করেছেন। ৩২ বছরের ভারতে থাকার সময়ে তিনি মোট ৫৬৬ দিন বাংলায় থেকেছেন। তার মধ্যে স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবাংলায় ২৬ দিন। বাংলায় জন্ম নয় এমন কোনও কংগ্রেস নেতা বা স্বাধীনতা সংগ্রামীর এমন রেকর্ড নেই। তাই বলছিলাম প্রথমের শব্দগুলি হৃদয় থেকেই বলেছেন।
দেশ ভাগ হয়ে গেল। গান্ধীর কাছে এটা মর্মপীড়ার কারণ। আস্তে আস্তে নিজেকে সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছিলেন। দিল্লির আলোকমালার মধ্যে না থেকে তিনি কলকাতাকে বেছে নিলেন ১৫ অগাস্ট থাকবেন বলে। নিপীড়িত আহত মানুষের পাশে থেকে অহিংসা ও সত্যের বাণী দিয়েছেন। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর আজ বোঝা যাচ্ছে ‘অহিংসা’ সারা পৃথিবীতে মানব সমাজের কাছে কত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। হিংসার পৃথিবীতে শান্তি আনয়নে সেটাই একমাত্র পত্র। গান্ধী যে কারণেই চিরদিন প্রাসঙ্গিক থাকবেন।