হাড়ে হিম

মাঘের শীত এ-বছর বাঘ-ভল্লুক সবার গায়। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া সঙ্গে সুগ্রীব দোসর বৃষ্টি। হাত-পা অসাড়। হাড়ে লেগেছে হিম। প্রবল শীতে কাতর আট থেকে আশি। জানেন কি বিশ্বের এমন কিছু জায়গা রয়েছে, শীতকালে যেখানকার তাপমাত্রা ফুৎকারের উড়িয়ে দিতে এমন ঠান্ডাকেও! যা বিশ্বের শীতলতম স্থান। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

ভাবছেন এ কী ঠান্ডা! এমন শীত কস্মিনকালেও দেখেননি! হাত-পা পেটে ভিতর সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কাজ করা তো দূরস্থান লেপ-কম্বল থেকে বেরতে যেন মন চাইছে না। আবার অনেকেই ভাবছেন, এ আর এমন কী ঠান্ডা! এর চেয়ে বেশি ঠান্ডা উপেক্ষা করে ছুটেছেন সিকিম, লেহ, লাদাখ, কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশ। শীতবিলাসিতায় মজেছেন। জানেন কি বিশ্বে রয়েছে এমন কিছু স্থান রয়েছে যেখানে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির উপরেই ওঠে না। ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারে আপনার পছন্দের শীতবিলাসের জায়গাগুলো। সেসব স্থানে মানুষের বাস হাতে গোনা। পর্যটকেরা এক্সপিডিশনের সাহস বিশেষ দেখান না। সেখানে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা চালান। সাধারণ শীতপোশাকে যেখানে বেঁচে থাকা অসম্ভব।

আরও পড়ুন-উন্মাদনায় ফিরল আসিয়ানের স্মৃতি

পূর্ব আন্টার্কটিকার মালভূমি
এই মুহূর্তে পৃথিবীর শীতলতম স্থান পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার মালভূমি। উপগ্রহের তথ্য অনুযায়ী ওখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ৯৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল। অ্যান্টার্কটিকা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে সারা বছর। তবে জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস-এর জার্নাল প্রকাশিত তথ্য মতে, তাপমাত্রা আরও নিচেও নেমে যায় কখনও কখনও।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডো-বোল্ডারের ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটা সেন্টারের গবেষক টেড স্ক্যাম্বোসের মতে, ‘ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা সম্ভবত এর চেয়ে কম হওয়া সম্ভব না।’
যদিও অতীতে এটা শীতলতম স্থান ছিল না। ২০১০ সালে অ্যান্টার্কটিকার ভস্তক রিসার্চ স্টেশন ছিল সবচেয়ে শীতলতম স্থান। এটি অ্যান্টার্কটিকার ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু থেকে ১ হাজার ৩০১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানকার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল মাইনাস ৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে তাপমাত্রা এত কম হলে কী হবে, সূর্য কিন্তু এখানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে তার আলো বিচ্ছুরণ করে। ডিসেম্বর মাসে ভস্তক রিসার্চ স্টেশনের আকাশে টানা ২২ ঘণ্টা সূর্যকে দেখা যায়। ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র এই রিসার্চ স্টেশনটি স্থাপন করে। এই স্থানে বরফে চাপা-পড়া একটি হ্রদ আবিষ্কার করেছেন বৈজ্ঞানিকরা। হ্রদের নাম লেক ভস্তক। এখানে এক মাইক্রোব্স এবং মাল্টিসেলুলার অর্গানিজমের বাস্তুতন্ত্র আবিষ্কার করেছেন গবেষকরা। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এখন পূর্ব অ্যান্টার্কটিকার মালভূমির তাপমাত্রা ভস্তকের চেয়ে আরও কমে গেছে।

আরও পড়ুন-আজ থেকে বৃষ্টির আশঙ্কা, কমবে শীত

ভার্খোয়ানস্ক
রাশিয়াকে বিশ্বের শীতলতম দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রতি বছর কমপক্ষে চার মাস এখানে তুষারপাত-সহ বৃষ্টি হয়। এই কারণে এখানকার স্বাভাবিক তাপমাত্রা -২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যেখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা খুব বেশি হলে ৮ ডিগ্রি পর্যন্ত যেতে পারে। রাশিয়ার ভার্খোয়ানস্ক, ওয়ম্যাকনের মতো রাশিয়ার শহরগুলো ঠান্ডার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। বিশ্বের এক আজব শহর ভার্খোয়ানস্ক। উত্তর মেরুর অন্যতম শীতলতম স্থান এটি। সাইবেরিয়ান হাই নামের শীতল বাতাস এখানকার শীতলতম জলবায়ুর জন্য দায়ী। ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৬৯.৮ ডিগ্রি। শীতকালে বছরের অন্যান্য সময়ও তাপমাত্রা মারাত্মক কম থাকে। অথচ গ্রীষ্মকালে শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ ডিগ্রিরও বেশি হয়ে যায়। শীত এবং গ্রীষ্মের তাপমাত্রার মধ্যে এতটা তফাত বিশ্বের আর কোনও অঞ্চলে দেখা যায় না। সে-কারণে এখানে লোকসংখ্যা অনেক কম। আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরে খুব বেশি হলে এক হাজার মানুষ বসবাস করেন। ১৯৩৩ ওয়ম্যাকনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৬৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাধারণত এখানকার তাপমাত্রা -৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে থাকে।
ডোম অর্গাস
আন্টার্কটিকার ডোম অর্গাস হল আন্টার্কটিক মালভূমির সর্বোচ্চ বরফের গম্বুজ। একে পৃথিবীর শীতলতম স্থান বলে মনে করা হয়। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে ডোম অর্গাসের তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল -৮২.৫ সেলসিয়াস। ওই বছরই গবেষকরা এই স্থানটিকে বিশ্বের অন্যতম শীতলতম স্থান বলে ঘোষণা করেন। বর্তমানের শীতলতম স্থান ডোম ফুজির খুব কাছেই অবস্থিত এই স্থান। পূর্ব আন্টার্কটিকা অঞ্চলের যে স্থানগুলিতে তাপমাত্রা -৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে ২০১৮ সালে সেগুলি শনাক্ত করেন কোলোরোডো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী হিম চাদরগুলির সর্বোচ্চ অংশে (৩,৮০০ থেকে ৪,০৫০ মিটার) অগভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে ডোম অর্গাস রয়েছে প্রথম সারিতে।
ক্লিঙ্ক রিসার্চ স্টেশন, নর্থ আইস গ্রিনল্যান্ড

আরও পড়ুন-এবার আবাস যোজনার বাড়ি করে দেওয়ার উদ্যোগ রাজ্যের

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড যা একটি বিশাল বড় হিম চাদর। বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তর নিয়ে গবেষণা করছেন এবং তাঁরা সম্প্রতি নেচার জার্নালে তাঁদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছেন। এখানকার লোকসংখ্যা বেশ কম। এখানেই আছে ক্লিঙ্ক রিসার্চ স্টেশন। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৬৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবং এটিই সেখানকার নিম্নতম তাপমাত্রা। উত্তর মেরু অঞ্চলের চরমতম আবহাওয়া এখানেই বিরাজমান। গ্রিনল্যান্ডের আরও একটি গ্রাম নর্থ আইস যার তাপমাত্রা শীতকালে পৌঁছয় -৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। একসময় এই গ্রামটি গবেষণার জন্য ব্যবহার করা হত। ১৯৫২ সালে ব্রিটিশদের নর্থ গ্রিনল্যান্ড অভিযানের সময় এখানে একটি গবেষণাকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা হয়। বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রথমে সামরিক বাহিনীর বিমান ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোনও কারণে বিমান বিধ্বস্ত হলে ব্রিটিশ সরকার আর ঝুঁকি নিতে চায়নি। পরে কুকুরের সাহায্যে স্লেজ বানিয়ে সরঞ্জাম পৌঁছানো হয়েছিল সেখানে। ১৯৫৪ সালে ওই বছর এটাই ছিল উত্তর মেরুর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এখানে জিওলজি, সিসমোলজি, ফিশিওলজি এবং গ্ল্যাসিওলজির গবেষণা চলে। কিন্তু আজ এই জায়গাটিতে এতই ঠান্ডা যে কেউ এখানে থাকতে চায় না।

আরও পড়ুন-আজ দুই দিনাজপুরে মুখ্যমন্ত্রী

স্নাগ, ইউকোন কানাডা
কানাডার ইউকোন ভ্যালির আকার দেখতে যেন ঠিক একটা বাটির মতো। আর স্নাগ ইউকোনের একটি ছোট তুষার গ্রাম। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এখানকার তাপমাত্রা সবচেয়ে নিচে নেমেছিল। সেই বছর এখানকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল -৬২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা এতটাই কমে গিয়েছিল যে বাতাসে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। ফলে স্নাগ গ্রামের বহু বাসিন্দা ঠান্ডার চোটে জ্ঞান হারান। বাতাস এতই ভারী যে বাইরের লোক এখানে এসে এই তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। এখানে এলে ভয়ানক শ্বাসকষ্টে ভুগতে শুরু করেন। বরফে মোড়া ফাঁকা গ্রামে ফিসফিসিয়ে কথা বললেও প্রতিধ্বনি শোনা যায়।
বিশ্বের অপার বিস্ময়ের কোনও শেষ নেই। লেপ-কম্বল আর চাদরের বাইরে এক সুবিশাল হাড় হিম-করা শীতভুবন রয়েছে। যা আমাদের চিন্তাচেতনার দূরের বস্তু। সেইসব শীতলতম স্থানকে কুরনিশ।

Latest article