বাংলার বুকে গেরুয়া উৎপাতের লম্ফঝম্প দেখে ২০২১ এর কথা খুব মনে পড়ছে।
মেঠো উত্তাপ মাখা ফিসফিসানি সেবারও ঘুরপাক খাচ্ছিল মাঠে-ময়দানে। পাড়ার আড্ডায়। চায়ের ঠেকে। একুশের বিধানসভা ভোটে জল্পনাটা গাছে উঠেছিল। কে না জানে রাজনীতি হাজারো সম্ভাবনারই আঁকিবুকি শিল্প। দল আর জোটের পারমিউটেশন কম্বিনেশন। ভাঙাগড়া কমাবাড়া চলতেই থাকে। সেবার দিল্লি থেকে সকাল-বিকেল উড়ে এসে ডেলি প্যাসেঞ্জারি এবং শাহি মেজাজে অমিতবিক্রম হুঙ্কার গেরুয়া বাহিনীর।
আরও পড়ুন-২১ ফেব্রুয়ারি পঞ্জাবে আপ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
তৃণমূল ভাঙার ছক। মোদিজি বাংলার দখল চান! সেই খোয়াইশ পূরণে বহিরাগতদের দাপাদাপি, টাকা ছড়ানো, একুশের ঐতিহাসিক বিধানসভা নির্বাচনে কম কিছু দেখেনি রাজ্যের মানুষ। মোদির জেনারেল দুশো আসন জেতার খুড়োর কল ঝুলিয়েছিলেন বঙ্গের গেরুয়া নেতৃত্বের সামনে। পরীক্ষাটা ছিল ২৯৪ আসনে। নেতা বাড়ন্ত, তাই করোনার প্রকোপ একটু কমতেই তৃণমূল ভাঙিয়ে ‘লঞ্চ’ করা হয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের এক গদ্দার খোকাকে। দলবদলুর মহামান্য পিতৃদেব-সহ গোটা পরিবারেরই উন্নতির অনুঘটক ছিলেন জোড়াফুল ও একমেবাদ্বিতীয়ম্ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্দার খোকার ভাইদের উন্নতির সোপানও তো কালীঘাটের আটপৌরে ওই জননেত্রীই! সে যাত্রায় দলবদলুর আহ্বানে তৃণমূল থেকে বেরিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন অনেকে। তাতে আশ্বস্তও হয়েছিলেন দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গের কেষ্টবিষ্টুরা। ফল বেরোতে বিফল মনোরথ হয়ে তাঁরা অধিকাংশই ফিরে গিয়েছেন পুরনো জায়গায়। একটা মহল তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, জোড়াফুলের দিন শেষ, আমরাই আসছি। ফল বেরোলে পিন পতন নীরবতা গ্রাস করেছিল বাংলার সীমা ছাড়িয়ে গেরুয়া দলের দিল্লির সদর দফতরকে। দলবদলুর লম্বা-চওড়া কথায় বিশ্বাস করে গেরুয়া রথ সেই যাত্রায় গোঁত্তা খেয়ে একশোও পেরোয়নি। সব সমীক্ষাকে মিথ্যা প্রমাণ করে রেকর্ড ২১৩ আসন জিতে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন-তেলের বিল বকেয়া ১৯ কোটি টাকা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আজ উত্তরে প্রতিবাদ
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে। জেতা ৭৭ জন বিধায়ককেও ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। প্রতিদিন সংখ্যাটা কমছেই। পরাজয়ের সেই ক্ষত সরিয়ে আবার ময়দানে আগের বারের ব্যর্থ দলবদলুকেই ‘রি-লঞ্চ’ করার প্রক্রিয়া চলছে চব্বিশে। একই প্রোডাক্ট ভারতীয় জঞ্জাল পার্টি আর কতবার ভোটরঙ্গে সামনে আনবে? মাত্র ৭৭ জন বিধায়ককেও ধরে রাখতে না পারা দলের নেতাকে ভোট ময়দানে রি-লঞ্চ করার মহড়া চলছে রোজ। নরেন্দ্র মোদির আশীর্বাদধন্য এহেন তৃণমূলের ঘরে খেয়ে বড় হওয়া নেতাকে আর কতবার মুখ করবে দীনদয়াল উপাধ্যায় ভবনের নেতারা, যার হিসেব নেই। তবে এই থোড় বড়ি খাড়া, আর খাড়া বড়ি থোড় স্টাইল নিয়ে অসন্তোষ চাপা নেই বঙ্গ বিজেপির অন্দরে। দশ বছর কেন্দ্রে সরকার চালিয়েও বাংলায় মোদি, অমিত শাহের বিজেপির এই করুণ দশা কেন? প্রশ্নটা উঠছে। প্রশ্নটা উঠবেই।
অযোধ্যার উচ্চকিত মন্দির রাজনীতি, কৌশলী ভারতরত্ন প্রদান না লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ডবল ভাতা, কার পক্ষে যাবে জনগণের রায় এই বাংলায়? নির্মলার বাজেটে কানাকড়িও নেই গরিবের হাতে, সব তোলা ২০৪৭ সালের স্বপ্ন দেখার মৌতাতের জন্য। আর বাংলায় সীমিত ক্ষমতায় রাজ্য সরকার উদারহস্ত। জনগণের হাতে টাকা দেওয়া হচ্ছে তেইশ বছর পর নয়, টাটকা এই চব্বিশ সালেই। সুতরাং ভোটের ফলাফলের দেওয়াল লিখন স্পষ্টতর হচ্ছে প্রতিদিন, রাজ্যের প্রত্যেক কোণে। এই লড়াইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তির উৎস, ৬৭টি জনমুখী প্রকল্প, যার সঙ্গে গরিব জনগণের আত্মার যোগ। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ভাতা দ্বিগুণ হয়েছে। পাবেন ২ কোটি ১১ লক্ষ মা-বোন। অর্থাৎ উপকৃত হবে সমসংখ্যক পরিবার। প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত রাজ্যের ৮ কোটি মানুষ। অনেক পরিবারে মা বার্ধক্য ভাতা পান আর মেয়ে পান লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। অর্থাৎ দু’হাজার টাকা। গ্রামে একটা পরিবারের খরচ চলে যায় ওই টাকায়। আর এত আন্দোলন করেও এখনও পিএফের ৮০ শতাংশ শ্রমিক হাজার টাকা পেনশনের মুখ দেখল না। এখানেই কেন্দ্রের সরকারের সঙ্গে মা মাটি মানুষের সরকারের পার্থক্য। এই জোরেই সাধারণ বাঙালির ঘরে এখনও তৃণমূল কংগ্রেস জনপ্রিয়তার শিখরে। রাজ্যের নারীশক্তির উত্তরণ সম্ভব হয়েছে তাঁর হাত ধরেই। স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডও পরিবারের মহিলার নামে। সম্ভবত মহিলাদের জন্য এতটা গভীরভাবে আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী আগে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। বছরে দু’মাস কোনও কাজ থাকে না মৎস্যজীবীদের। তাদের জন্য দু’মাস ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সাহায্যও দেওয়া হয়েছে। রাজ্য কর্মীদের ডিএ বাড়ানো হয়েছে ৪ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে সবে একদফা বৃদ্ধি কার্যকর হয়েছে। তার উপর আবার ৪ শতাংশ। বেতন বাড়ছে সিভিক ভলান্টিয়ারদেরও। করোনার সময় থেকে তিনি এভাবেই রাজ্যবাসীর হাতে টাকা তুলে দিচ্ছেন সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও।
আরও পড়ুন-এনডিএতে যাবেন না, জানালেন পালানিস্বামী
সংগ্রাম করেই তাঁর উত্থান। সেদিন অর্থবল ছিল না, আজকের মতো শক্তিশালী সংগঠনও ছিল না, শুধু ছিল সাহস আর বুকভর্তি আন্দোলনের আগুন। তাকে পাথেয় করেই বামেদের একের পর এক দুর্গ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। বামেরা আজ শূন্য, প্রায় অস্তিত্বহীন। গত একুশ সালের বিধানসভা ভোটে তার চূড়ান্ত রূপ দেখেছে বাংলার মানুষ। তবু হারাতে পারেনি অগ্নিকন্যাকে। এবার লোকসভা নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। একুশে প্রধানমন্ত্রীর ডেলি প্যাসেঞ্জারি রুখে দিতে পেরেছেন। এবার? যাঁর জীবনটাই লড়াই তাঁকে থামানো কঠিন। এই চব্বিশের ভোটের ফল তাই বাংলা ও বাঙালির রাজনীতির জন্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী বার্তাই বয়ে আনতে চলেছে।
তবে এখনই নিশ্চিতভাবে বলা চলে, ভোটের ফলে চমক কিছু থাকছে না। অতি লম্ফঝম্পের পরিণতিতে প্রাপ্তির ঘর ভরবে না মোদি বাবুদের। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।