মাথা নেই, নেই কোনও জটিল অঙ্গের উপস্থিতি, না আছে কোনও তন্ত্র তাও তারা বুদ্ধিমান। সামান্য স্লাইম মোল্ড। তারা তাও সমাধান করতে পারে জটিল থেকে জটিলতম ধাঁধা। মস্তিষ্ক নেই তাও মনে রাখতে পারে তথ্য, করতে পারে খাবারের সন্ধান এমনকী খাবারের গন্ধও পায় তারা। এত কিছু করে কীভাবে এরা? এরা কী ধরনের? কী এদের পরিচয়? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজব বিজ্ঞানীদের পাওয়া বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে আর চেষ্টা করব যুক্তি দিয়ে এর সত্যতা প্রমাণ করার।
আরও পড়ুন-তমলুকে সমবায় নির্বাচনে তৃণমূল পেল ৪৩, বিরোধী ০
আমরা যদি কখনও স্লাইম মোল্ড দেখি তাহলে দেখতে পাব অবিন্যস্তভাবে তারা গাছের কাটা গুঁড়ি বা বাগানের এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, বিশেষ করে স্যাঁতসেঁতে জায়গায়। কখনও তারা একটি পাতলা স্তর বিস্তার করে আবার কখনও তারা কোনও জায়গা থেকে অবিন্যস্তভাবে ঝুলছে। আসলে বিবর্তনের একেবারে শুরুর দিকে যখন উদ্ভিদ ও ছত্রাক প্রজাতি দুটি আলাদা শাখায় বিভক্ত হচ্ছিল ঠিক তার আগের স্তরেই ছিল এরা এই স্লাইম মোল্ড। তবে তারা কোনওভাবেই উক্ত দুই শ্রেণির অন্তর্গত না হয়ে নিজেদের এক আলাদা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করে, এদের মধ্যে কিছু প্রজাতি আবার এককোষী অবস্থায় জীবন কাটায় আবার কিছু একত্রিত হয়ে দল গঠন করে। যদিও তাদের এই দলগঠন খানিকটা হলেও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপরেও নির্ভরশীল থাকে। অনেক সময় দেখা যায় এরা এককোষী অবস্থায় থাকলেও এদের মধ্যে অসংখ্য নিউক্লিয়াসের সমাবেশ। এরা এক বৃহৎ গঠন সৃষ্টির দ্বারা মাটির এক বিশাল অংশকে ঢেকে ফেলেছে আর তাতে রয়েছে শতাধিক নিউক্লিয়াস।
স্লাইম মোল্ডের পরিচয়
Physarum polycephalum সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত স্লাইম মোল্ডগুলির একটি। এর স্বতন্ত্র উজ্জ্বল হলুদ রং সত্যিই আমাদের নজর কাড়ে। সবচেয়ে বড় কথা হল এটিকে যেকোনও পরীক্ষাগারে সহজেই বড় করা সম্ভব। এই স্লাইম মোল্ড সম্পর্কে আমরা যা জানি তার বেশিরভাগই Physarum-এর গবেষণা থেকেই পাওয়া। এই প্রসঙ্গে বাস্তুবিজ্ঞানী এবং কীটতত্ত্ববিদ তানিয়া ল্যাটি, যিনি তাঁর সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, পরীক্ষাগারে Physarum এবং এরই বিভিন্ন প্রজাতি স্লাইম মোল্ড নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি মনে করি তারা সত্যিই খুব সুন্দর।” তাদের শিরাগুলিতে এই সুন্দর নিদর্শন রয়েছে, তাদের একটি ফ্র্যাক্টাল চেহারা দিয়েছে। এমনকী এই বিজ্ঞানী স্লাইমগুলির গন্ধ অনুধাবনের উপায়ের ওপরও মুগ্ধ।
ল্যাটি তাই তাদের স্নেহের সাথে ‘ছোট পাতলা এলিয়েন’ হিসাবে উল্লেখ করেন। এই এলিয়েনরা রয়েছে সর্বত্র। পৃথিবীতে কমপক্ষে ৯০০ প্রজাতির স্লাইম মোল্ড রয়েছে, তাদের গঠনের সাথে তাল মিলিয়ে আবার এদের কিছু জুতসই ডাকনামও রয়েছে, যেমন ‘কুকুরের বমি’ এবং ‘ডাইনির মাখন’ ইত্যাদি। যদিও তারা ভিজে, নাতিশীতোষ্ণ স্থান বেশি পছন্দ করে, তবে মাটিতেও প্রচুর পরিমাণে এদের উপস্থিতি দেখা যায়।
খাবারের গন্ধ পায়
আমরা মানুষেরা নাকি নাকে থাকা রিসেপ্টরগুলি বা গ্রাহকগুলি দিয়ে খাবার থেকে বাতাসে ভেসে আসা গন্ধের রাসায়নিক পদার্থ শনাক্ত করতে পারি। স্লাইম মোল্ডগুলির প্রায় একই জিনিস রয়েছে : তাদের কোষের সমস্ত অংশে রয়েছে রিসেপ্টর যা তাদের খাবার থেকে আসা রাসায়নিক সংকেত শনাক্ত করতে সাহায্য করে শুধু তাই নয় এটি তাদের বলে যে খাবার কাছাকাছি রয়েছে।
এবং এটি শুধু এখানেই থামে না। একটি স্লাইম মোল্ডে সাধারণত অনেকগুলি বিভিন্ন ধরনের রিসেপ্টর থাকে, এই প্রতিটি রিসেপ্টর পরিবেশের এক একটি সংকেত বা কিউ-এর সাথে মিলিত হয়, যেমন আর্দ্রতা বা pH। এমনকী তারা আমাদের চোখের মতো ফটোরিসেপ্টর ব্যবহার করে আলো শনাক্ত করতে পারে। অর্থাৎ একটি একক কোষ হলেও, একটি স্লাইম মোল্ডে চোখ এবং নাকের মতো কিছু আছে।
আরও পড়ুন-ব্রিগেডের প্রস্তুতি, লোকসভা ভোট নিয়ে বৈঠকে মহুয়া
চলাফেরা করা
স্লাইম মোল্ডের উপাদানগুলির মধ্যে একটি হল এর প্রোটোপ্লাজম। যার প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশ বিনিময়যোগ্য, যার অর্থ হল প্রতিটি পৃথক প্রোটোপ্লাজম ইউনিট একটি শিরা বা একটি সিউডোপড হয়ে উঠতে পারে। যা কিনা অস্থায়ী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো গঠন তৈরির দ্বারা স্লাইম মোল্ডটিকে যেকোনও দিকে যেকোনওভাবে প্রসারিত করতে পারে। অর্থাৎ এরা অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন হওয়া সত্ত্বেও এদের প্রোটোপ্লাজমের প্রবহমানতা প্রয়োজন অনুসারে এদের যেকোনও দিকেই বয়ে নিয়ে যেতে পারে।
খাবার পছন্দ করা
তাঁর গবেষণায় ল্যাটি দেখেছেন যে স্লাইম মোল্ডগুলি চিনির মতো পদার্থের দিকে খুব সহজেই চলে যেতে থাকে কিন্তু লবণের মতো পদার্থ থেকে তারা দূরে সরে যায়। এবং শুধু তাই নয়, স্লাইম মোল্ডগুলি একই সময়ে একাধিক খাদ্য উত্স খাওয়ানোর জন্য টেন্ড্রিলগুলিকে (সূক্ষ্ম সুতোর মতো গঠন) প্রসারিত করতে পারে-এবং তারা এমন অনুপাতেই তা করে, যাতে তারা সর্বোত্তম পুষ্টি পায়। যদিও তারা কেবল প্রোটিন বা কার্বোহাইড্রেট-ই পছন্দ করে তা নয় আসলে তারা একটি নির্দিষ্ট ভারসাম্য পাওয়ার চেষ্টা করে। আমরা যা খাই তা আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ ও তন্ত্রের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আমাদের পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু এই স্লাইম মোল্ডগুলি তাদের বায়োমাসকে অর্থাৎ সম্পূর্ণ দেহকেই খাবারের উপর এমনভাবেই ছড়িয়ে দেয় যাতে তার সমগ্র অংশ সমানভাবে পুষ্টিলাভ করতে পারে।
আরও পড়ুন-পুর এলাকায় বাড়ি তৈরির নকশা অনুমোদনের কাজ সহজ করতে রাজ্যের বিশেষ কমিটি
মনে রাখার ক্ষমতা
ল্যাটি তাঁর সহকর্মী ক্রিস রিড-সহ একটি গবেষণায় দেখতে পান যে স্লাইম মোল্ডগুলি তাঁদের অতিক্রম করা পথকে চিহ্নিত করার জন্য তাঁদের দেহের কিছু অংশ স্লাগগুলিকে পিছনে ফেলে যায়। ঠিক যেমন পিঁপড়েরা ফেরোমোন ছেড়ে যায় তারা কোথায় খাবার পেয়েছে তা দেখানোর জন্য, তেমনি এই স্লাইমটি ‘বাহ্যিক স্মৃতি’র দ্বারা খাদ্যের উৎস পথের হদিশ রাখে দেহের অংশ দিয়ে।
তথ্যের আদান-প্রাদান
সাধারণত দুটি স্লাইম মোল্ডকে পাশাপাশি রাখলে তারা একত্রিত হয়। তাদের কোষপর্দা জুড়ে গিয়ে, তাদের অভ্যন্তরীণ অংশগুলিকে খুলে দেয় এবং একটি নতুন একক জীব তৈরি করতে তাদের শিরাগুলি পরস্পর সংযুক্ত হয়।
সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞানী দত্রুসর এবং তাঁর দলবল দেখেন যে তাঁরা যদি স্লাইম মোল্ডগুলিকে যেগুলি লবণ সহ্য করতে শিখেছিল সেগুলিকে মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য এমন স্লাইম মোল্ডের সাথে মেলামেশা করতে দেন যারা কিনা লবণ সহ্যই করতে পারে না, তারা সকলে একত্রিত হয়ে এমন এক মোল্ড গঠন করে যারা কিনা খুব সহজেই লবণ সহ্য করতে পারে।
বিবর্তনের উন্নত শিখরে বসে থাকা মানুষ যা সহজে বুঝতে, জানতে বা মানতে পারে না তা বিবর্তনের একেবারে আদিতে সৃষ্ট কতকগুলি স্লাইম কী সুন্দরভাবে মেনে বেঁচে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। আমরা নিজেদেরকে উন্নত মনে করি ঠিকই, কিন্তু সত্যিই কি তাই? প্রশ্নটা থেকেই যায়।