‘‘বৃন্দাবন মেঁ গৌ চরাবে। লঙ্কা চড়কে নাদ বাজাবে। মক্কে দা বন হাজি আবে। বাহ্ বাহ্ রং বটাইদাং হুণ কি থীঁ আপ ছপাইদা।”
কবির থেকে লালন, শ্রীরামকৃষ্ণ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, সর্বত্রই এই ধর্ম চেতনার অনুভববেদ্য প্রকাশ। উল্লিখিত গানটি অবশ্য এঁদের কারও গাওয়া কিংবা লেখা নয়। এই গানটির রচয়িতা একজন সুফি সাধক। নাম বুল্লহে শাহ। তিনি বৃন্দাবন থেকে লঙ্কা, সেখান থেকে মক্কায় ফকির দরবেশের আলখাল্লার মতো নানা রঙের বাহার দেখেছেন। এক রঙে ছুপানো কাপড় নয়। এক ভাবনায় জারিত মনোলোক নয়। নানা রঙের উজ্জ্বলতা অভিন্ন পোশাকে বর্ণিল। আর এই বর্ণাঢ্য ঔজ্জ্বল্যই ভারতাত্মার ঐক্যময় আধাত্ম্য বৈভবের অত্যুঙ্গ প্রকাশ। বৃন্দাবনে গো চারণকারী রাখাল বালকের সঙ্গে শেষবিচারে তাই মক্কায় হজ করতে যাওয়া পুণ্যাভিলাষী মহম্মদের কোনও পার্থক্য দেখেননি। কৃষ্ণ-মহম্মদে কোনও ভেদ চেনেননি। একই ভাবনা ছিল শ্রীরামকৃষ্ণেরও।
আরও পড়ুন-প্রচার শুরু করে আত্মবিশ্বাসী সুজাতা জোর লড়াইয়ের বার্তা দিলেন সৌমিত্রকে
স্বামী অভেদানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য। তিনি নির্দ্বিধভাবে লিখেছেন, ‘‘শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনোদ্দেশ্য হল এক সার্বভৌম ও শাশ্বত সত্য প্রচার করা। সেই সত্য হল যদিও এই ব্রহ্ম এক এবং অত্বিতীয় তথাপি ইনি বিভিন্নরূপে বিরাজমান এবং এই বিরাট পুরুষেরই পূজা করে বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন রূপ ও নামে।”
স্মর্তব্য, শ্রীরামকৃষ্ণ ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদগুলিকে একটিমাত্র আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে সমন্বিত করার পক্ষে জোর দেননি। বরং বিবিধ পরিপূরক সাধনার মধ্যে কোনও একটিকে অবলম্বন করে ঈশ্বর সাধনার চরম লক্ষ্যে পৌছনোর কথা বলেছেন। রম্যাঁ রঁল্যা তাই এই সাধন প্রকরণ প্রসঙ্গে লিখতে বলে লিখে গেছেন, ‘‘The total unity of this river of God, open to all rivers and all streams.”
আবহমান কাল ধরে চলে আসা ভারতীয় সনাতন হিন্দুধর্ম পরধর্মের পরম বার্তাগুলিকে তার বুকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। সেজন্য এই ধর্মমতগুলির মধ্যে সাযুজ্যসমূহ লক্ষণীয়।
আরও পড়ুন-দুর্গাপুরে বিজেপির বহিরাগত তকমা ধুয়ে দিলেন আজাদ
জরথ্রুষ্ট প্রবর্তিত পারসি ধর্মেও মৃত্যু পরবর্তী পর্যায়েও আত্মার অস্তিত্ব উল্লিখিত হয়েছে। কর্ম অনুসারে তার সৎ কিংবা অসদ্গতি হয়ে থাকে। বেদ এবং অবেস্তা, দুই-ই, অভিন্নভাবে আজীবন মনেপ্রাণে সৎকর্ম অনুশীলন, চারিত্রিক শুদ্ধতা, পরদুঃখকাতরতা, আত্মনির্ভরশীলতা, সৎচিন্তা, সৎবাক্য প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। উপনয়ন, যজ্ঞ, পুরোহিত প্রভৃতির উল্লেখ ও উপস্থিতি উভয় ধর্মাচরণেই প্রবলভাবে বিদ্যমান। বেদোক্ত যজ্ঞ আবেস্তায় যসন, মন্ত্র মনথ্র, মিত্র মিথ্র, অসুর অহুর, এসব তো আছেই। তাছাড়াও, পারস্যর অপরনাম ইরান যে আর্যভাষা সম্ভূত, সেটা একপ্রকার প্রমাণিত সত্য। আর্য > আরিয় > এরিয়ান > ইরান, বির্তনের এই গতিপথটিও স্বীকৃত ও মান্যতা প্রাপ্ত।
আরও পড়ুন-জল্পেশ মন্দিরে পুজো দিয়ে প্রচার শুরু প্রার্থী নির্মলের
আবার, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সাযুজ্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। বৌদ্ধের নির্বাণ লাভ আর হিন্দুর ব্রহ্মত্ব অর্জন কার্যত একই অবস্থানে উত্তরণ। দুটি অবস্থাই অবাঙ্মানসগোচর, অবাচ্য, অনির্দশ, অপ্রতিষ্ঠ, অনাভাস এবং অনিকেত। গীতার অনুশালন আর বুদ্ধে জীবনদর্শন, দুটোতেই মৈত্রীমূলক কল্যাণব্রত, নিরাসক্ত ও নির্বাসনার কথা বলা হয়েছে। নিবৃত্তিমার্গী অজ্ঞেয়বাদী বুদ্ধর প্রচারিত ধর্ম বেদের বাহ্য কর্মবাদের বিরোধিতা করেছে। যাগযজ্ঞকে প্রশ্রয় দেয়নি, চতুর্বর্ণ সমাজ দর্শন মানতে চায়নি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বৌদ্ধের সঙ্গে প্রকৃত হিন্দুর পার্থক্যসূচক রেখাটি মোটেই মোটা নয়, বরং বেশ সরু। তাই, তাই-ই, শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘‘বৈদিক পৌরোহিত্যের বিরুদ্ধে নবোত্থিত ক্ষত্র শক্তির বিদ্রোহের নামই বৌদ্ধধর্ম।’’ আর সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ‘বৌদ্ধধর্ম হিন্দু ধর্মের পূর্ণ পরিণতি।’
প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের প্রভাবে শ্রীরামকৃষ্ণ শিষ্য বিবেকানন্দ স্থাপিত করেছিলেন হিন্দু সাধু সংঘ।
আল্লাহ তথা স্রষ্টাকে ভক্তি করা এবং তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসাই হল ইসলামের মূল বাণী। শাহদাথ বা ধর্মবিশ্বাস, নমাজ বা প্রার্থনা, রোজা বা উপবাস, হজ বা তীর্থযাত্রা এবং জাকাত বা দানধ্যান, এই পঞ্চ স্তম্ভের উপর গড়ে উঠেছে ইসলামের ধর্মীয় সংস্কৃতি। ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলেন এবং মানেন, ‘ইননামা মুমিমনা ইখওয়াতুন’ অর্থাৎ বিশ্ববাসীগণ অবশ্যই তোমার ভাই।’ একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায় ইসলামি সাম্যবাদ আর অদ্বৈতবাদের সাম্যচিন্তা প্রায় একই বিন্দুতে প্রতিষ্ঠিত। বললে অসুবিধা নেই, এই সাম্যবাদী চিন্তাই শ্রীরামকৃষ্ণকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। বৈদান্তিক যেরকম জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নরনারীকে একই ব্রহ্ম বা আত্মস্বরূপ বলে জ্ঞান করে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সামাজিকভাবে তাঁদের স্বধর্মাবলম্বীদের একই চোখে দেখে থাকেন, নিজেদের ভাই ভাবেন। বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন বেদান্তের এই আত্মিক ঐক্য ও অভেদত্বমূলক সাম্য মৈত্রী ও সমদর্শন এবং ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও সমদর্শিতা মিলিত হয়ে এক পূর্ণাঙ্গ ভারত গড়ে তুলবে। এজন্যই তিনি বারবার বলেছেন, বেদান্তের মস্তিষ্ক আর ইসলামের দেহ, বৈদান্তিক তত্ত্ব এবং ঐসলামিক সমাজের সংহতিবোধ, এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে আদর্শ ভারতীয় সমাজ।
এসবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল শিখগুরুদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন, শিখদের দশজন গুরু জনক ঋষির অবতার। রাজর্ষি জনকের মনে নাকি মোক্ষ লাভের আগে লোক কল্যাণ সাধনের ইচ্ছা জেগেছিল। তাই তিনি গুরু গোবিন্দ পর্যন্ত দশজন গুরুরূপে দশবার জন্মগ্রহণ করে শিখজাতির মধ্যে ‘ধর্মসংস্থান পূর্বক পরব্রহ্মের সহিত চিরকালের নিমিত্ত মিলিত হইয়াছিলেন।’ এটাই রামকৃষ্ণর বিশ্বাস ছিল।
আর ভারতে বিরাজিত সকল মুখ্য ধর্মের মূল নীতিগুলির রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝেছিলেন, ঈশ্বরকে ভালবাসাই মানবজীবনের উদ্দেশ্য। সেজন্যই মানব প্রেম ও ঈশ্বরপ্রেম এক হয়ে ধরা দিয়েছিল তাঁর মনোলোকে। ছোঁয়াছুঁয়ির বালাই, সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি, ধর্মোন্মত্ততার অবসান ঘটিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক মহান ঐক্য সূচিত হয়েছিল রামকৃষ্ণ ধর্মান্দোলনের বীজ-সত্যে।
আরও পড়ুন-সবংয়ে আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মকে বিযুক্ত করা নয়, সর্বধর্মসমন্বয়ের ভাবটিকে আত্মস্থ করা। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবন ও বাণীতে সেটাই তুলে ধরেছিল। অথচ তাঁর ১৮৯তম জন্মতিথির ঠিক আগে ক্যা ক্যা রব তুলে এদেশের চালকপুরুষরা সেটাকেই নস্যাৎ করার বন্দোবস্ত করলেন।
এটাই দুঃখের। এটাই বেদনার।