আগুন দিও
‘বিপদ আবার ডাক দিয়েছে, দমকা বাতাস… আলগা বোতাম…
বসন্তকে সাক্ষী রেখে আজ যদি ফের সঙ্গী হতাম?’ হ্যাঁ, এ হা-হুতাশ কবির। এই সময়ের এক প্রেমিক কবির। বসন্তে বিচলিত তাঁর কবিমন। তিনি এই বসন্তেও ভাবেন নন্দিনী, রাজা আর বিশুর কথা। বসন্তের বিপদকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে অনায়াসে শ্রীজাত বলেন—
‘বিপদ আসুক, লাগুক বাতাস, ছুটুক সময় তোমার দিকে।
পাগল হওয়া বিশুই জেনো আগলে রাখে নন্দিনীকে!’ ফুরিয়ে যাওয়া শীতের শেষে আগুন নিয়ে আসে বসন্ত। ক্লান্ত শহর আর বিবর্ণ গ্রামে রঙ লাগে। জেগে ওঠে প্রকৃতি। সবাই তখন একটু খানি আগুন চায়— আমায় তখন আগুন দিও-চোখের ভেতর বুকের ভেতর, দুরন্ত এক আগুন দিও শরীর সেঁকার আগুন দিও, মনের ভেতর অদম্য সব-ইচ্ছেগুলো জাগিয়ে রাখার— আগুন দিও
ভালোবাসা থাক না তোলা— শান্তি প্রিয় তাঁদের জন্য। কী এসে যায় এক জীবনে, সব কিছু নয় নাই বা পেলাম।
নব ফাল্গুনের দিনে
না পাওয়া থেকেই বসন্তের পূর্ণতা। বসন্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। পলাশ ফুল, প্রেমিকের হাত, শিমুল রঙের হৃদয় প্রকৃতিকে যেমন সাজিয়ে তোলে তেমনি সাজিয়ে তোলে মানুষকেও। প্রকৃতিও যেন সদ্যযৌবনা তরুণী। কবিগুরু সেই ভীরু অপেক্ষারত বসন্ত তরুণীর পরিচয় দেন— ‘যদি তারে নাই চিনি গো,/ সে কি আমায় নেবে চিনে/এই নব ফাল্গুনের দিনে?/ জানি নে, জানি নে।/ সে কি আমার কুঁড়ির কানে কবে কথা গানে গানে/ পরান তাহার নেবে কিনে এই নব ফাল্গুনের দিনে?’
কোকিল কলরব
বাংলা সাহিত্যেও বসন্তবন্দনা হয়েছে রকমারি রঙে-ঢঙে কেউ বলেছেন বিচ্ছেদের ঋতু। কেউ বলেছেন প্রকৃতির রানি। আবার কেউ আগ্রাসী খল ঋতু বলে দেগে দিয়েছেন বসন্তকে। কিন্তু সবখানেই আছে আপাদমস্তক ভালবাসা, আছে বসন্তবন্দনা। চর্যাপদ থেকে এই সময় বাংলা সাহিত্যে, গানে, কবিতায়, প্রবন্ধ-উপন্যাসে সব জায়গায় ফাগুন কিংবা বসন্তের প্রকৃতি প্রেম, বিরহ এবং বিদ্রোহ জেগে উঠেছে।
বাংলার বসন্ত নিয়ে চর্যাপদের কবিদের মধ্যে যে দু’-একটি পঙ্ক্তি আছে তা বসন্তের জন্য যথেষ্ট। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনে বসন্তের দেখা মেলে। আর পদাবলি সাহিত্য তো বসন্তের মহাকাব্য। জয়দেবে সংস্কৃত শ্লোকেও রয়েছে বসন্ত। তবে বাঙালি কবি সৈয়দ আলাউল তাঁর কাব্যে বসন্তকে দেখেছেন গ্রামের ঋতু হিসেবে— ‘প্রথমে বসন্ত ঋতু নবীন পল্লব।/ দুই পক্ষ আগে পাছে মধ্যে সুমাধব॥ মলয়া সমীর হৈল কামের পদাতি।/ মুকুলিত কৈল তবে বৃক্ষ বনস্পতি॥/ কুসুমিত কিংশুক সঘন বন লাল।/ পুষ্পিত সুরঙ্গ মল্লি লবঙ্গ গুলাল॥/ ভ্রমরের ঝঙ্কার কোকিল কলরব।/ শুনিত যুবক মনে জাগে অনুভব॥’
একি লাবণ্যে
অন্নদা মঙ্গলে মুকুন্দ রাম ফুল্লরার বারোমাস্যায় বসন্তকে অগ্নিদগ্ধ ঋতু হিসাবে দেখিয়েছেন— ‘সহজে শীতল ঋতু ফাল্গুন যে মাসে।/ পোড়ায় রমণীগণ বসন্ত বাতাসে—’
বাঙালির ঘরে বসন্ত নিয়ে এসছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে, কবিতায় তাঁর লেখায়। রবীন্দ্রনাথের মোট ২২৩২টি গানের মধ্যে প্রকৃতি পর্বে গান রয়েছে ২৮৩টি এর মধ্যে বসন্তকে নিয়ে গান ৯৮টি। ১৩০৩ বঙ্গাব্দের বসন্তের পঞ্চম দিনে রবীন্দ্রনাথ মেতে উঠলেন ঋতু রঙ্গ উৎসবে লিখলেন— ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে
আনন্দ-বসন্ত-সমাগমে/ বিকশিত প্রীতিকুসুম হে/ আনন্দ-বসন্ত-সমাগমে’।
রবীন্দ্রনাথ বসন্তকে ভালবেসে তার গানে লিখছেন— ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে?/ আজি খুলিয়ো হৃদয় দল খুলিয়ো,/ আজি ভুলিয়ো আপন-পর ভুলিয়ো,/ এই সংগীত মুখরিত গগনে/ তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো।’
রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বসন্ত প্রকৃতি ও প্রেমের ঋতু আবার তিনি দক্ষিণী মেয়ের হৃদয়ের আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বসন্তে— ‘সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা/ সুখের বসন্ত সুখে হোক সারা/ দুখিনী নারীর নয়নের নীর/ সুখী জনে যেন দেখিতে না পায়/ তারা দেখেও দেখে না/ তারা বুঝেও বোঝে না/ তারা ফিরেও না চায়/ আহা, আজি এ বসন্তে…’
বসন্ত এলো রে
বিদ্রোহী সত্তার কবি নজরুলের বসন্তকে নীরব করেনি। গুঞ্জরন-এ মাতাল কবি চৈতি হওয়ায় লিখছেন— ‘বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্রে ওঠা মন,/ পেয়েছিলেম এম্নি হাওয়ার তোমার পরশন।’
আবার বনে বনে,মনে মনে রং ঝরায় কবির চেতনা। পাগল বসন্ত কবিকে লিখতে বাধ্য করে— ‘বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,/ পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে/ রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।’
নজরুল শুধু ফুল, পাখি আর প্রকৃতির মধ্যে বসন্ত এনে নীরব হননি বরং দেখেছেন বসন্তের চলে যাওয়া— ‘বৈকালী সুরে গাও চৈতালি গান বসন্ত হয় অবসান।’
বসন্ত বিলাপে বিদ্রোহী কবি দক্ষ কখনও বলছেন— ‘অনন্ত বিরহ ব্যথায় ক্ষণিকের মিলন হেথায়/ফিরে নাহি আসে যাহা চায় নিমেষের মধুতর তান।’ গানে বসন্তকে বারবার নিয়ে এসছেন নজরুল। কখনও বলেছেন— ‘ফুল রেণু মাখা দক্ষিণা বায়/ বাতাস করিছে বন-বালায়’
আবার কখনও ভ্রমরের গুঞ্জনে বেঁধে ফেলেছেন এই ঋতু কে— ‘বসন্ত এলো এলো এলোরে/ পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে/ মুহু মুহু কুহু কুহু তানে/ মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে/ ভ্রমর গুঞ্জে গুঞ্জে গুনগুন গানে’
প্রিয়ার আগমনে ও আনন্দ বসন্ত নাড়া দেয় কবিকে।
‘আসিবে তুমি জানি প্রিয়/ আনন্দে বনে বসন্ত এলো
ভুবন হল সরসা,/ প্রিয়-দরশা, মনোহর।’
রবিঠাকুর অবশ্য তাঁর বসন্তের শব্দে ভাবনায় রাঙিয়ে দিয়েছেন আপামর বাঙালি কে— ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে,/ আমার সকল কর্মে লাগে,/ সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে,/ গভীর রাতের জাগায় লাগে॥’
আরও পড়ুন- বসন্তে লাগুক উষ্ণ ছোঁয়া
এক বসন্তের রাতে
যে কবি রূপসী বাংলার রূপের মাদকতায় মাতাল হয়েছেন তিনি প্রেমে পড়েছেন হেমন্তের। কিন্তু কোনও ভাবেই উপেক্ষা করতে পারেনি বসন্তকে তাঁকে বলতে হয়েছে— ‘সবিতা, মানুষ জন্ম আমরা পেয়েছি/ মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে;/ ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেই সব জাতি,/ তাহাদের সঙ্গে সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন।’
এই সময়ের কবি নির্মলেন্দু গুণ আগ্রাসী বসন্তের প্রেমে মাতোয়ারা হয়েছে। বলেছেন বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারোর। তাই লঘু চালে বসন্ত বর্ণনা করেছে— ‘এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,/ যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য।/ বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি/নবীন পল্ববে, ফুলে ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে/ গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।’
সর্বনাশা বসন্ত
বাঙালির বসন্তে গান আছে সুর আছে আছে প্রেম আর অভিমান তাই বসন্তের গোধূলি বিকেলে এ শহরের এক প্রেমিক জটিলেশ্বরের সুরে গেয়ে ওঠেন— ‘কেউ বলে ফাল্গুন,/ কেউ বলে পলাশের মাস,/ আমি বলি আমার সর্বনাশ।/ কেউ বলে দখিনা কেউ বলে মাতাল বাতাস/ আমি বলি আমার দীর্ঘশ্বাস।’ আর সুফিয়া কামাল তাহারেই পরে মনে কবিতায় বেদনাতুর বসন্তের কথা অনুভব করেন— তরী তার এসেছে কি? বেজেছে কি আগমনী গান? ডেকেছে কি সে আমারে? শুনি নাই, রাখিনি সন্ধান।’
রঙ মানুষের মনে মনে
কৃষ্ণকান্তের উইলে বঙ্কিম চন্দ্র নিয়ে এসেছেন বসন্তের অনুষঙ্গ— ‘কোকিলের ডাক শুনিলে কতকগুলি বিশ্রী কথা মনে পড়ে। কী যেন হারাইয়াছি। যেন তাই হারাইয়া যাওয়াতে জীবনসর্বস্ব অসাড় হইয়া পড়িয়াছে। যেন তাহা আর পাইব না। যেন কী নাই। কেন যেন নাই। কী যেন হইল না। কী যেন পাইব না। কোথায় যেন রত হারাইয়াছি।’ অদ্বৈত মললবর্মণ তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসে বসন্ত ঋতুকে প্রকৃতি, প্রেম আর মানব মনের ত্রিকোণ এর মাঝে এঁকেছেন— ‘আসে বসন্ত।…বসন্ত এমনি ঋতু এই সময় বুঝি সবাইর মনে প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা।…যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ, পাতায় পাতায় রঙ। রঙ মানুষের মনে মনে।’
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
বাংলা গানের রাগের প্রকাশে বসন্ত অধিকার করে আছে হিন্দোল কারণ কচি পাতার আগমনেই বাঙালির মনে জাগে আনন্দ হিল্লোল। ভটির টানে মেঠো সুরে মাটির টানে তাই শাহ আব্দুল করিম গেয়ে ওঠেন— বসন্ত বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে,/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ,/ আমার বাড়ি আসে।/ সই গো বসন্ত বাতাসে!’ বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধে বসন্ত খুব একটা বাসা বাঁধতে পারেনি। শুধু প্রমথ চৌধুরী তাঁর ফাল্গুন প্রবন্ধে বসন্তের তুল্যমূল্য বিচার করেছেন। এই বাংলায় বসন্ত কখনও উৎসবের, কখনও বিচ্ছেদের কখনও বিষাদের, কখনও অভিমানের, তাকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারওর। সাহিত্যিক, কবি, লেখকদের বসন্ত বিলাপ তাই অন্তহীন। অন্তহীন এই বসন্ত বিলাপে সামনের সারিতে কবিদের দল। পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আত্মবিশ্বাসে, সমাজ চেতনায়, স্লোগান তোলেন— ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’ বসন্ত চিরসুন্দর রানির তুলনায় ধনবতী আর রাজকুমারীর তুলনায় রূপবতী। জয় গোস্বামীর বসন্ত তাই নদীর পাড়ে লুকিয়ে থাকে— ‘অন্ধ যখন বৃষ্টি আসে আলোয়/ স্মরণ অতীত সাঁঝবেলারা সব/ এগিয়ে দিতে এলো নদীর ধারে—/ নদীর ধারে বসন্ত উৎসবে…’
ফাগুন হাওয়ার মিষ্টি ধ্বনি
বসন্তের হাতবাক্সে অনেক প্রশ্নের উত্তর না থাকলেও বসন্তের একটি বাংলা উদ্ধৃতি শোনাতে শোনাতে আমরা পৃথিবীর সব নদী পার হই— ‘ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-ফুরানো দীর্ঘ রাত। একবার ডাকলেই, সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে, একবার ভালোবাসলেই, সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।’ এই বালিকাও বসন্ত বন্দনায় ভাবতে থাকে— ‘আমায় সাজাও, রাঙ্গাও আমায়
দাও ভরে দাও শৃন্য হিয়ায়
ধরিএীকে আবার সাজাই
দিয়ে প্রেমের বাণী—
তুমি ফাগুন হাওয়ার মিষ্টি ধ্বনি!’