পারদ ক্রমশ উঠছে, চড়া রোদ যা আমাদের শরীরের সমস্ত অনুভূতির চেয়েও চড়া। ৪২ ডিগ্রি ফিল লাইক ৫২ ডিগ্রি। মাটিতে যেন আগুন লেগে গেছে। চারপাশ পুড়ে ছাই হবার জোগাড়। শরীরে ক্লান্তি, মনে ক্লান্তি, ওষ্ঠাগত প্রাণ। ঘামে ভিজে সর্দিগর্মি, লু, খাবারে অরুচি, ডায়ারিয়া, তার মাঝে বড় দোসর অ্যালার্জি। গ্রীষ্মের তীব্র গরমে বাড়বাড়ন্ত হয় অ্যালার্জির। এই সময় বাতাসে নানা রকম ধুলোকণা, পরাগ বা রেণু ভেসে বেড়ায়। মূলত এই কারণেই অ্যালার্জির প্রকোপ এই সময় বেড়ে যায়। আর কিছু কিছু মানুষের শরীরে এই ধরনের কণা প্রবেশ করামাত্রই রি-অ্যাকশন শুরু হয়ে যায়। বাদ যায় না চোখও।
সান অ্যালার্জি
শীতের হিমেল দিনে সূর্য যতটা আরামের গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে ততটাই ভয়ঙ্কর। সান অ্যালার্জি যাকে আক্ষরিক অর্থে বলা হয় ফটোসেনসিটিভ ডিজঅর্ডার অথবা ফটোডার্মাটাইটিস। সূর্যের আলোর সংস্পর্শে থেকে আসার পর ত্বকে লাল লাল র্যা শ বেরয়, চাকা চাকা দাগ হয়। অনেক সময়ে ত্বক ফেটে রক্ত বেরোয়। ত্বকে ফোস্কার মতো চাকতিও বেরোয়। তারপরেই সারা গায়ে চুলকানি শুরু হয়।
উপসর্গ
কিছুক্ষণ সূর্যের আলোয় থাকার পর অনেকেরই হাত, পা এবং বুকের ওপরের অংশে চুলকানি-সহ র্যাশ বেরয়। খুব ইরিটেশন শুরু হয়। একটা জ্বালাভাব থাকে। তাহলেই বুঝে নিতে হবে সূর্যের রশ্মি থেকে ত্বক সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে। এই সান অ্যালার্জির চিকিৎসার পরিভাষা হল ‘পলিফার্মস লাইট ইরাপশন’। একেক জনের শরীরে এই র্যা শ একেক রকম দেখায় বলে একে পলিফার্মস বলা হয়। হাত-পা এবং বুকেই সূর্যরশ্মি থেকে সাধারণত এই অ্যালার্জি হয়।
গায়ের রঙ যাঁদের ফর্সা তাঁরাই মূলত এই অ্যালার্জিতে বেশি ভোগেন। যাঁদের গায়ের রং কালো তাঁদেরও হয়, তবে কম।
কী করবেন/করবেন না
সূর্যের আলোর সংস্পর্শে যাঁদের এমন হবার সম্ভাবনা রয়েছে তাঁদের সূর্যের আলো থেকে ত্বক সবসময় ঢেকে রাখুন।
দুপুর ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সূর্যের তেজ বেশি থাকে। এ-সময়টা রোদে থাকবেন না। বেরনোর আগে মুখে এবং হাতে ভাল করে সানস্ক্রিন মেখে নিন। সানগ্লাস আর মাস্ক পরুন।
সান অ্যালার্জি মূলত ভিটামিন ডি-র অভাবে হয়ে থাকে। তাই ভিটামিন ডি-সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাবেন।
অ্যালার্জেন থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে। যেমন ফুলের রেণু, ধুলোকণা, ঝুরো মাটি প্রভৃতি। সকাল ও সন্ধ্যায় বাতাসে অ্যালার্জেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। ওই সময়টা এড়িয়ে যান।
চোখে অ্যালার্জি
প্রবল গরমে অ্যালার্জি শুধু ত্বকেই নয়, চোখেও হয়। চোখে অ্যালার্জির প্রধান উপসর্গগুলি হল চোখ লাল হয়ে যাওয়া। এরপরেই চোখ জ্বালা অথবা চুলকানি শুরু হয়। চোখ দিয়ে জল পড়ে, একটু বেশি সংক্রমণ হলে অতিরিক্ত পরিমাণে পিঁচুটি, চোখ কটকট করে, চোখের পাতায় ফোলাভাব দেখা দেয়।
অনেক সময় আবার চোখের অ্যালার্জির সঙ্গে শ্বাসকষ্টের সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম নাক দিয়ে জল পড়া, হাঁচি, ঠান্ডা লেগে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট এমনকী বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ত্বকেও র্যাশ বেরোতে পারে।
কী করবেন/করবেন না
চোখে অ্যালার্জি হলে জোরে চুলকাবেন না। তার পরিবর্তে চোখ চুলকালে আইসপ্যাক ব্যবহার করা যেতে পারে। একটা পরিষ্কার কাপড়ে কয়েকটা বরফের টুকরো জড়িয়ে নিয়ে ৫ মিনিট মতো চোখের পাতায় রাখুন। এতে চুলকানি, চোখের লালচে ভাব কেটে যাবে এবং আরামও পাওয়া যায়।
যাঁরা চোখে লেন্স পরেন তাঁদের গ্রীষ্মে অতিরিক্ত সতর্কতা মানতে হবে। কারণ লেন্সের পৃষ্ঠতলে অ্যালার্জেন জমে। যা অ্যালার্জির উপসর্গকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
রোসাসিয়া
বিশ্বের বহু মানুষই রোসাসিয়া-আক্রান্ত হন। এর থেকেই দীর্ঘস্থায়ী চর্মরোগের সৃষ্টি হয়। এটি জেনেটিকও। মাথার চুলের স্ক্যাপ্লে একধরনের জীবাণু থাকে যার মুখ থেকে যে লার্ভা বের হয় তার থেকে চর্মরোগের সৃষ্টি হয়। বাতাসে প্রচণ্ড গরম ভাব এবং ধুলোবালি থেকে শরীরে গরম বেড়ে গেলে এই জাতীয় অ্যালার্জি বৃদ্ধি পায়।
অনেক সময় অতিরিক্ত শুষ্কতার কারণেও এটি হতে পারে।
মুখের চামড়া শুকিয়ে লালচে হয়ে যায়, ছোপ ছোপ দাগে ভরে যায়, একটু ফোলাভাবও আসে। বিদেশিদের এই চামড়ার সমস্যা বেশি হলেও ভারতীয়দেরও গ্রীষ্মকালে এই সমস্যা প্রবলভাবে দেখা দেয়।
কী করবেন/করবেন না
এই ধরনের সমস্যা থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব শরীরকে ঠান্ডা রাখুন। ছায়াযুক্ত স্থানে, ঘরের মধ্যে থাকার চেষ্টা করুন।
হাইড্রেটেড থাকুন। প্রচুর জল বা জল জাতীয় পানীয় খান। রোসেসিয়া হবার প্রবণতা থাকলে গ্রীষ্মে চা-কফি খাওয়া একটু কমিয়ে ফেলুন।
প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ভিটামিন বি-৩ খুব ভাল এই ধরনের অ্যালার্জির প্রতিকারে।
ইন্টারট্রাইগো
ল্যাটিন শব্দ ‘ইন্টারট্রিজ়নাস’ থেকে ইন্টারট্রাইগো কথাটি এসেছে। শব্দটির অর্থ শরীরে যে কোনও ভাঁজ— ঘাড়, বগল, পেট, কুঁচকি ইত্যাদি। ভাঁজের প্রদাহকে বলে ইন্টারট্রাইগো।
ত্বকের সঙ্গে ত্বকের ঘর্ষণে এই সংক্রমণটি হয় অর্থাৎ, শরীরের যে অংশে ভাঁজ রয়েছে গরমে ঘাম জমে সঙ্গে ধুলো-ময়লা জমে, সেই অংশেই হানা দেয় এই অ্যালার্জি। আপাতভাবে দেখলে মনে হবে লাল রঙের র্যাশ, কিন্তু ক্রমশ অস্বস্তি ও চুলকানি বাড়তে থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বেশ ব্যথাও হয়। অনেক সময়ে, ইন্টারট্রাইগোর উপরে ব্যাক্টিরিয়া বা ইস্টের একটা সেকেন্ডারি সংক্রমণও হতে পারে।
স্থূলতার সঙ্গে ইন্টারট্রাইগোর সম্পর্ক রয়েছে। ছোট হোক বা বড় যাঁদের ওজন বেশি তাঁদের শরীরে ভাঁজের সংখ্যাও বেশি। ফলে গরমকালে হতে পারে এই প্রদাহ। যাঁদের ডায়াবেটিস, হাইপোথাইরয়েডিজ়ম রয়েছে, ক্যানসার রয়েছে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন তাঁদের এই ধরনের সংক্রমণ হয় দ্রুত। এটাকেই ডায়াপার র্যাশ বলে।
কী করবেন/করবেন না
হাইজিন ঠিক রাখতে হবে। এই প্রচণ্ড গরমে দু-তিনবার নিয়মিত স্নান করতে হবে। ঘাম যাতে না বসে। পরিষ্কার সুতির পোশাক পরলেই ভাল।
পাউডার ব্যবহার করবেন না। পাউডার ত্বকের রোমকূপ বন্ধ করে দেয়। বদলে অ্যান্টি-পার্সপিরেন্ট ডিয়োডোরেন্ট ব্যবহার করুন শরীরের ভাঁজে ভাঁজে।
গরমে শিশুদের প্রয়োজন হলে একাধিক বার স্নান করাতে হবে। দিনে দু-ঘণ্টা অন্তর ডায়াপার বদলে দিতে হবে। ডায়পার পরা অংশ মুছে পরিষ্কার রাখতে হবে।
সংক্রমণ একটু বেশি মাত্রায় হলে অ্যান্টি ফাঙ্গাল মলমের সঙ্গে ওষুধ খেতে হবে। চুলকানির অস্বস্তি কমাতে অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধ খেতে হবে।
সংক্রমণের বাড়াবাড়ি হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্টেরয়েড খেতে হবে।
গরমে অ্যালার্জি
চড়ছে তাপমাত্রার পারদ। সারাক্ষণ শরীর ঘামে ভেজা। মুখ চোখে জ্বালাপোড়া ভাব। আবহাওয়াজনিত কারণে এই সময় ত্বকে একাধিক সমস্যা দেখা দেয়। গরমে বাড়বাড়ন্ত হয় অ্যালার্জির। চামড়া ফেটে যাওয়া, লালচে হয়ে যাওয়া, র্যাশ-ফুসকুড়ি ইত্যাদি। কোন ধরনের অ্যালার্জি হয় এই সময়? কেন হয়? কীভাবে করবেন এর প্রতিরোধ? লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী