শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এমন কোনও শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের বিচরণ ছিল না। যদিও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি কবি। পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান, চিঠি। ছবি এঁকেছেন। অভিনয় করেছেন। গেয়েছেন গান। সেইসঙ্গে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন-ধর্ম নয়, উন্নয়নের নিরিখে ভোট দিন: আহ্বান দেবের
তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছিল মাত্র আট বছর বয়সে। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়। কবিতার নাম ‘অভিলাষ’। তারও আগে বাবামশাই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে হিমালয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে ১৮৭৩ সালের মে মাস থেকে তিনি ‘বনফুল’ নামে কবিতা লিখতে শুরু করেন। তার আটটি সর্গ প্রকাশিত হয় ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায়। ‘বনফুল’ গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালের ৮ মে। দাদা সোমেন্দ্রনাথের উৎসাহে।
তবে ‘বনফুল’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাবার আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘কবি-কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থ। এটাই রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত বই। প্রকাশকাল ১৮৭৮ সালের ৫ নভেম্বর। তখন তাঁর বয়স সতেরো বছর। ‘কবি-কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি তার আগের বছর ধারাবহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির ‘ভারতী’ পত্রিকায়। বইটির প্রকাশক ছিলেন প্রবোধচন্দ্র ঘোষ। তাঁর আগ্রহ ও চেষ্টাকে স্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘কবি-কাহিনী কাব্যই আমার রচনাবলীর মধ্যে প্রথম গ্রন্থ-আকারে বাহির হয়।’ আরও লেখেন, ‘আমার কোনো উৎসাহী বন্ধু এই বইখানা ছাপাইয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আমাকে বিস্মিত করিয়া দেন।’ প্রবোধচন্দ্র ঘোষ ছিলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এন্ট্রাস ক্লাসে কবির দাদা সোমেন্দ্রনাথ ও ভাগনে সত্যপ্রসাদের সহপাঠী।
আরও পড়ুন-প্রখর রৌদ্রে ঝলসে যাচ্ছে চা-পাতা, সঙ্কটে চাষিরা
রবীন্দ্রনাথ প্রথম জীবনে ছিলেন কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর অনুসারী। তাঁর ‘কবি-কাহিনী’, ‘বনফুল’ এবং ১৮৮১ সালে প্রকাশিত ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্য তিনটিতে ‘ভোরের পাখি’র কবির প্রভাব দারুণভাবে লক্ষ্য করা যায়। সেগুলো ছিল মূলত গীতিকবিতা। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান নিজস্ব ভাষা। সূচনা পর্বের রচনা হলেও, ‘কবি-কাহিনী’ যথেষ্ট কাব্যগুণ সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাওয়ার কিছুদিন পর কলকাতা থেকে ‘কবি-কাহিনী’ প্রকাশিত হয়। জানা যায়, কবিতাগুলো লিখতে তাঁর সাত দিন সময় লেগেছিল। পাঠকের সমাদর কতটা পেয়েছিল ৫৬ পৃষ্ঠার ডিমাই সাইজের বইটি? ৫০০ কপি ‘কবি-কাহিনী’ গ্রন্থ প্রকাশের পর প্রকাশক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘তিনি যে কাজটা ভালো করিয়াছিলেন তাহা আমি মনে করি না, কিন্তু তখন আমার মনে যে ভাবোদয় হইয়াছিল, শাস্তি দিবার প্রবল ইচ্ছা তাহাকে কোনোমতেই বলা যায় না। দণ্ড তিনি পাইয়াছিলেন, কিন্তু সে বইলেখকের কাছে নহে।’ তাঁর এমন মন্তব্যের কারণ বইটি একেবারেই পাঠক-মহলে সমাদৃত হয়নি।
সত্যিই, প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশিত বইগুলোর বাজারদর তেমন ছিল না। একাধিক সংস্করণের মুখ দেখেছিল হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র বই। একটা সময় রবীন্দ্রনাথকে মুদ্রণ ও প্রকাশনার দায়িত্ব নিতেও দেখা গিয়েছে। তবে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথের বইয়ের চাহিদা যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। ১৯১০ সালে ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস থেকে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের দীর্ঘ চোদ্দো বছর পর বইটির অষ্টম সংস্করণ মুদ্রিত হয়।
আরও পড়ুন-ক্লাস শুরুর আগেই একাদশের পড়ুয়াদের ট্যাব
না, ‘কবি-কাহিনী’ সেই সময় পুনঃমুদ্রিত হয়নি। কারণ তার প্রয়োজন পড়েনি। গ্রন্থটি লাভ করেনি পাঠকপ্রিয়তা। তবে এই ‘কবি-কাহিনী’ তখন কোনও এক বিশেষ মানুষের কোমল হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। আসা যাক সেই কথায়। রবীন্দ্র-গ্রন্থপ্রকাশের ১২৫তম এবং বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের ৮০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক ‘কবি-কাহিনী’র বিশেষ স্মারক সংকলন প্রকাশিত হয় ১৪১০ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক সুধেন্দু মণ্ডলের সম্পাদনায়। বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে। এই সংকলনে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর অনুজকে বোম্বাইয়ের একটি মারাঠি পরিবারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন— বিলেত যাত্রার পূর্বে ইংরেজি চালচলনটা ভালভাবে রপ্ত করে নেবার জন্য। বোম্বাইয়ে এই পরিবারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবি-কাহিনী কাব্যটির এক মুগ্ধ অনুরাগী পাঠিকা পেয়েছিলেন— বয়সে যিনি তরুণী, রূপে অসাধারণ সুন্দরী, শিক্ষিকা এবং সেই বয়সেই বিলাত প্রত্যাগতা। নাম তাঁর আন্না তরখড়। তাঁর কৌতূহল এবং আকর্ষণ কবি-কাহিনী গ্রন্থটির প্রতি যেমন, তার কবিটির প্রতিও ছিল তদ্রুপ গভীর ও তীব্র। আন্না রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজি শেখাতেন, আর রবীন্দ্রনাথ আন্নাকে তাঁর সদ্য রচিত কবি-কাহিনীর কাব্য ভারতীর পৃষ্ঠা থেকে পড়ে ও তর্জমা করে শোনাতেন।
সেই সময় আন্না রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি ডাকনাম চেয়েছিলেন। বাংলায়। ‘কবি-কাহিনী’র নায়ক স্বয়ং কবি। সেই কাব্যের কবি-প্রণয়িণী নায়িকার নাম ছিল নলিনী। রবীন্দ্রনাথ ভালবেসে আন্নাকে ‘নলিনী’ ডাকনামটি দিয়েছিলেন। ‘কবি-কাহিনী’ যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে সেই গ্রন্থের একটি কপি আন্নাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ হাতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন আন্না। জানিয়েছিলেন নিজের অপার মুগ্ধতা ও ভাললাগার কথা।
আরও পড়ুন-২ লক্ষেরও বেশি ভোটে জিতব, কর্মিসভায় কাকলি
সংখ্যা দিয়ে সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয় না। এটা ঠিক, ‘কবি-কাহিনী’ সেই সময় বিশাল সংখ্যক পাঠকের হাতে পৌঁছয়নি। তবে গ্রন্থটি ঘিরে আন্না তরখড়ের উদ্দীপনা রবীন্দ্রনাথকে নতুন সৃষ্টির অঙ্গনে পা রাখতে দ্বিগুণ উৎসাহিত করেছিল, এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।