দুই দাদার মতো
ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল। ছবি আঁকছেন অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ। ডুবে রয়েছেন রং-তুলির মায়াজগতে। বহুবর্ণ চিত্রে রাঙিয়ে তুলছেন সাদা ক্যানভাস। পেরিয়ে যচ্ছে সময়। সকাল পেরিয়ে নামছে রাত। খেয়াল থাকছে না। আঁকার সময় তাঁদের ঘরে পা ফেলতে সাহস পান না কেউ। ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দূর থেকে দাদাদের শিল্পকর্ম দেখেন সুনয়নী। তাঁদের আদরের বোন। এই কন্যা দুই দাদার মতো ছবি আঁকতে চান। কিন্তু তখন পর্যন্ত মেয়েদের ছবি আঁকার প্রচলন খুব একটা হয়নি। বিচ্ছিন্ন ভাবে কেউ কেউ চেষ্টা করছেন। ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য ভেঙে হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর আঁকা শেখাতে শুরু করেছেন মেয়েদের। ভরসা বলতে এটাই।
আরও পড়ুন-প্রবীণতম নবতিপর অপরাজেয় গোপাল
অবশেষে তিরিশে
শৈশবে সুযোগ হয়নি। তিরিশ বছর বয়সে সুনয়নী, সুনয়নীদেবী হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং-তুলি। দুই দাদা মন দিয়ে দেখতেন বোনের আঁকা। প্রশংসা করতেন। প্রয়োজনে টুকটাক পরামর্শ। এইটুকুই। হাতে ধরে শেখাননি কেউই। সুনয়নীদেবী ছিলেন স্বশিক্ষিত শিল্পী। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মহিলা চিত্রশিল্পীদের পথিকৃৎ।
বহু গুণের সমাহার
সুনয়নীদেবীর জন্ম ১৮৭৫ সালের ১৮ জুন। বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মা সৌদামিনী দেবী। ঠাকুরবাড়ির এই কন্যার মধ্যে ছিল বহু গুণের সমাহার। ছবি আঁকার পাশাপাশি গাইতেন গান, বাজাতেন সেতার, করতেন অভিনয়। চর্চা ছিল লেখালিখির। শিল্পের কোনও আঙ্গিকেই তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল না। তবু এই নারী নিজের প্রতিভাকে সুন্দরভাবে মেলে ধরেছিলেন।
আরও পড়ুন-মায়ের মধ্যে ছিল অদ্ভুত ছেলেমানুষি
তখন তিনি বারো
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের ছিল পরস্পর শ্রদ্ধার সম্পর্ক। কিছুটা বন্ধুত্বের। সুনয়নীদেবীর মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে রচিত হয়েছিল আত্মীয়তা। রামমোহন রায়ের নাতি রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুনয়নীদেবী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। তখন তিনি বারো বছরের। জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়িতে তাঁরা পেতেছিলেন সুখের সংসার।
মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ বিশেষ স্নেহ করতেন ভাইঝি সুনয়নী দেবীকে। একবার বেনেপুকুরের বাড়িতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘বিরহ’ নাটকের অভিনয় হয়েছিল। দর্শকাসনে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুনয়নীদেবী চার ছেলে-বউদের সঙ্গে সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
দাদার সার্টিফিকেট
দাদাদের দেখে আঁকতে এলেও, দাদাদের মতো আঁকতেন না সুনয়নীদেবী। সমঝদাররা মনে করেন, তাঁর ছবি সম্পূর্ণভাবে অবনীন্দ্র-গগনেন্দ্রর প্রভাব-মুক্ত। বেছে নিয়েছিলেন স্বতন্ত্র পথ। তাঁর শৈলী সম্পূর্ণ নিজস্ব। কারও সঙ্গে মিলত না। অনুকরণ নয়, তাঁর ছবিতে দেখা যেত নিজস্ব দৃষ্টি। অবনীন্দ্রনাথ তখন আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষ। সুনয়নীদেবীর ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গগনেন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথকে ‘সার্টিফিকেট’ লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সুনয়নী যে ধারায় ছবি আঁকছে, তার জন্যে আমাকে সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে না। একদিন নিজগুণে দেশের লোকের কাছ থেকে নিজেই সার্টিফিকেট আদায় করে নেবে।
আরও পড়ুন-নেত্রীর স্মৃতিচিহ্ন উঠে এল নবপ্রজন্মের হাতে
ছবির প্রদর্শনী
ভুল বলেননি অবনীন্দ্রনাথ। সুনয়নীদেবীর ভিন্ন ধারার ছবিগুলো পরবর্তী সময়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেশ-বিদেশে। ১৯২২ সালে তাঁর ছবির প্রদর্শনী আয়োজিত হয় কলকাতায়। ১৯২৭ সালে লন্ডনের ‘উইমেন্স আর্ট ক্লাব’-এ হয়েছিল আরও একটি প্রদর্শনী। পেয়েছিল দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা। বিদেশে গিয়েছিলেন তাঁর পুত্র। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মায়ের আঁকা অনেকগুলো ছবি। সেই ছবিগুলো নিয়ে হইহই পড়ে গিয়েছিল। বেশকিছু ছবি বিক্রি হয়েছিল। বিশ শতকের এমন একটা সময়ে এইসব ঘটছিল, যখন চিত্রকলায় মেয়েদের উপস্থিতি খুব একটা দেখা যেত না।
আরও পড়ুন-বৃক্ষজননী
আত্মপ্রতিকৃতি
নিজের আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন সুনয়নীদেবী। করেছিলেন ওয়াশ-পদ্ধতির ব্যবহার। এই পদ্ধতি তিনি অবনীন্দ্রনাথের কাছে কিছুদিন শিখেছিলেন। ছবিটি দর্শকদের মধ্যে সমাদৃত হয়েছিল। বহু নারীর প্রতিকৃতি দেখা গিয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে। রং-তুলির মাধ্যমে সাদা ক্যানভাসে মেয়েদের জীবনকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন ভারতীয় মেয়েদের জীবনের কথা, ঘরের কথা। সেইসব নারী যেন কোলাহল থেকে দূরে থাকা কেউ। নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা। একাকী। ঠাকুরবাড়ির বারান্দা-লাগোয়া একটি ঘরে সুনয়নীদেবী মগ্ন থাকতেন নিজের সৃষ্টিতে। তখন বাইরের হই-হট্টগোল তাঁকে ছুঁতে পারত না। তিনি এঁকে যেতেন একটার পর একটা ছবি। যদিও নিজের ছবি নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। বিন্দুমাত্র চিন্তা করতেন না প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য নিয়ে। ঘর-সংসার সামলে তিনি মেতে থাকতেন আপন সৃষ্টির খেয়ালে। রঙের আড়ম্বর ছিল না তাঁর ছবিতে। লেগে থাকত নির্মল প্রশান্তি। তাকালেই চোখের আরাম।
আরও পড়ুন-নবজোয়ার যাত্রা থেকে অভিষেকের উপলব্ধি
পটচিত্রের প্রভাব
পুরাণ, মহাকাব্য, রূপকথা, নকশিকাঁথা, আরব্য রজনীর গল্প নিয়ে ছিল সুনয়নীদেবীর ছবির জগৎ। বিভিন্ন ছবিতে দেখা যেত কালীঘাটের পটচিত্রের প্রভাব। চরিত্রদের আধবোজা, টানা-টানা চোখ ও লম্বা ভুরু, এক অন্যমাত্রা এনে দিয়েছিল।
দেড় দশকের শিল্পী-জীবন
তাঁর শিল্পী-জীবন ছিল মাত্র দেড় দশকের। স্বামীর মৃত্যুর পর রং-তুলির জগৎ থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছিলেন। এই সরে আসার স্বাধীনতা তিনি আগেও নিয়েছিলেন। যেভাবে একদিন ছেড়ে দিয়েছিলেন সেতার। ডুবে গিয়েছিলেন রং-তুলির জগতে। সেইভাবেই রং-তুলি তুলে রেখে বেছে নিয়েছিলেন নির্জন জীবন। ১৯৬২-র ২৩ ফেব্রুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে সুনয়নীদেবীর প্রয়াণ হয়।
আরও পড়ুন-আক্রমণাত্মক তৃণমূলনেত্রী, প্রবল আত্মবিশ্বাসী অভিষেক
গুণমুগ্ধ
সেই সময় ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হত তাঁর আঁকা ছবি। বহু বরেণ্য ব্যক্তিত্ব তাঁর শিল্পকর্ম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সুনয়নীদেবী এঁকেছিলেন মেহের বানু খানমের ছবি। সেই ছবির প্রশংসা করেছিলেন নজরুল। চিত্রশিল্পী যামিনী রায় প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর আঁকা ছবি দেখে। বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বিভিন্ন সময় সুনয়নীদেবীর আঁকা নিয়ে মত প্রকাশ করেছেন। বেশকিছু বই ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে ভারতীয় চিত্রকলায় তাঁর অবদান নিয়ে লেখা। আজও তিনি বহু নারীর আদর্শ, অনুপ্রেরণা।