রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (Rokeya Sakhawat Hossain) নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে অধিক পরিচিত বাঙালি মননে। তাঁর আবির্ভাবে নারীরা পেয়েছিল মাথা তুলে বাঁচার অধিকার। তিনি ছিলেন উভয় বাংলার মুসলিম নারীসমাজের আলােকবর্তিকা, জাগ্রত বিবেক। ভারতের মুসলিম সমাজ যখন অশিক্ষা ও কুসংস্কারের আঁধারে নিমজ্জিত, অবরােধ ও অবজ্ঞায় এদেশের নারীসমাজ যখন জর্জরিত, সেই তমসাচ্ছন্ন যুগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো একজন মহীয়সী নারীর আবির্ভাব না ঘটলে এদেশের পর্দানশীন মুসলমান সমাজে নারীশিক্ষা ও নারীজাগরণ সম্ভবপর হত না। তিনি ছিলেন একাধারে চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক।
পিতা আরবি ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন, শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। রোকেয়ার (Rokeya Sakhawat Hossain) দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা। বড় দুই ভাইয়ের নাম মোহাম্মদ ইব্রাহিম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের। দুজনেই ছিলেন বিদ্যানুরাগী। আর বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী। রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গঠনে বড় দু’ভাই ও বোন করিমুন্নেসার যথেষ্ট অবদান ছিল। এ পরিবারে পর্দাপ্রথা এত কঠোর ছিল যে পরিবারের নারীরা ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও চাকরানি ছাড়া অন্য কোনও স্ত্রীলােকের সামনেও বের হতেন না। মাত্র পাঁচ বছর বয়স থেকেই রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকেও পর্দা প্রথা মেনে চলতে হত। তাঁর শিক্ষাজীবন তেমন সুখকর ছিল না। শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। পিতা আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল। রােকেয়ার পরিবারে স্ত্রীলােকদের একমাত্র কোরআন শরিফ ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেওয়া হত না। পরিবারের লােক উর্দু ভাষায় কথা বলত। পুরুষেরা বাইরে ফারসি ও বাংলা পড়ত। পরিবারের প্রথা অনুযায়ী রােকেয়াকে বাড়িতেই কোরআন শরিফ পড়তে দেওয়া হয়। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে কলকাতায় বসবাস করার সময় একজন মেম শিক্ষয়ত্রীর কাছে তিনি কিছুদিন লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনদের ভ্রুকুটির জন্য তাও বন্ধ করে দিতে হয়।
মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে পিতার এরূপ আচরণ রোকেয়াকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। পড়াশোনার জন্য রােকেয়ার মন ছটফট করতে থাকে। তার বড় দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অধ্যয়ন করার সুবাদে ভাইদের সহায়তায় তিনি বাড়িতে পড়াশোনার সুযোগ লাভ করেন। পিতা বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার ঘােরবিরােধী বলে রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দিনের বেলায় পড়াশােনার সুযােগ পেতেন না। সেজন্য রাত্রিতে পিতা ঘুমালে ভাইসাবেরা বােনকে পড়াতেন এবং লিখতে শেখাতেন। এভাবে ভাইয়ের কাছে রােকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গােপনে লেখাপড়া শিখতে লাগলেন।
১৮৯৮ সালে বিহারের ভাগলপুর নিবাসী উর্দুভাষী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, তদুপরি সমাজসচেতন, কুসংস্কারমুক্ত এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। রোকেয়ার শৈশব কাল কষ্টে কাটলেও বৈবাহিক জীবন ছিল আনন্দের। কারণ স্বামীর সাহচর্যে এসেই রোকেয়ার জ্ঞানচর্চার পরিধি বিস্তৃত হয়। উদার ও আধুনিক মুক্তমনের অধিকারী স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া দেশি-বিদেশি লেখকদের রচনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন এবং ক্রমশ ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তার সাহিত্যচর্চার সূত্রপাতও ঘটে স্বামীর অনুপ্রেরণায়। কিন্তু স্বামীর সেই আশীর্বাদ বেশি দিন রোকেয়ার ভাগ্যে জোটেনি। কোমল বন্ধুর ন্যায় নরম হাতটি রোকেয়াকে ছেড়ে ওপারে পাড়ি জমান। ১৯০৯ সালের ৩ মে স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলেন। স্বামীর মৃত্যু এবং ইতিপূর্বে তাঁদের দুটি কন্যাসন্তানের অকালেই মারা যাওয়া— সব মিলিয়ে রোকেয়া নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন।
আরও পড়ুন-রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকেই সাকেতের হয়রানি, নির্বাচন কমিশনে প্রতিবাদ জানাল তৃণমূল
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (Rokeya Sakhawat Hossain) সাহিত্যচর্চা শুরু হয় তাঁর স্বামীর হাত ধরেই। তাঁর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় রোকেয়ার জ্ঞানার্জনের পথ অধিকতর সুগম হয়। সাহিত্যিক হিসেবে তৎকালীন যুগের প্রেক্ষাপটে রোকেয়া ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা। তাঁর প্রথম লেখা ঠিক কবে কোথায় প্রকাশিত হয় তা নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেন তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯০৩ সালে ‘নবনূর’ পত্রিকায়। আবার অনেকেই মনে করেন প্রথম লেখা ‘পিপাসা’ (মহরম) প্রকাশিত হয় ইংরেজি ১৯০২ সালে ‘নবপ্রভা’ পত্রিকায়। এরপর একে একে লিখে ফেলেন মতিচূর-এর প্রবন্ধগুলো এবং সুলতানার স্বপ্ন-এর মতো কল্পবিজ্ঞানকাহিনি। ১৯৫০ সালে প্রথম ইংরেজি রচনা ‘সুলতানাজ ড্রিম’ বা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ মাদ্রাজ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় ছাপা হয়। সেই সূত্রে তিনি সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
স্বামী ও কন্যাসন্তানের মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ রোকেয়া স্বামীর অনুপ্রেরণাকে বুকে ধারণ করে নিজেকে নারীশিক্ষা বিস্তার ও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। মাত্র পাঁচ মাসের মাথায়, স্বামীর দেওয়া অর্থে পাঁচটি ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে ১৯০৯ সালে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’ স্কুল স্থাপন করেন। সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার কারণে স্কুল বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরে কলকাতায় চলে আসেন। হার না মানা মহীয়সী এই নারী স্বামীর প্রতি অগাধ ভালবাসার টানে ১৯১১ সালের ১৫ মার্চ আবারও চালু করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। মাত্র আটজন ছাত্রী নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি চার বছরের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে ১০০ জনে পৌঁছতে সক্ষম হন। ১৯৩০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি পুর্ণাঙ্গ উচ্চবিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয় পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি রোকেয়া জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে, তিনি মুসলিম বাঙালি নারী সংগঠন আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারীশিক্ষা-বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩০ সালে বেঙ্গল মুসলিম কনফারেন্সে রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বিবৃতি দেন— যা সেই যুগের প্রেক্ষাপটে একটি দুঃসাহসিক কাজ ছিল।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগ্রামী জীবনের সঙ্গে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জীনের প্রভূত মিল পাওয়া যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রের জন্য একটা ইতিহাস রচনা করেছেন। নারী সমাজের কল্যাণে তিনি নয়া নজির সৃষ্টি করেছেন। সাধারণ মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন। উদার মনের পরিচয় দিয়ে অফুরন্ত কাজ করছেন তিনি মানুষের কল্যাণে।
অন্যদিকে, শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের দুর্দশা রোকেয়া নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন বলেই তা নিরসনের জন্য পথে নেমেছিলেন। রোকেয়া মুসলিম মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য ১৯১৭ সালে আনজুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। অনেক বিধবা মুসলিম মহিলা এই সমিতি থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন, অনেক দরিদ্র মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে, অনেক অভাবী মেয়ে সমিতির মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেছে, সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত অসহায় এতিমরা আশ্রয় ও সহায়তা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, কলকাতার মুসলিম নারী সমাজের বিকাশের ইতিহাসে এই সমিতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এসবের অনুষঙ্গে বর্তমান রাজ্য সরকারের কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রভৃতি প্রকল্পের সার্থক রূপায়ণের প্রসঙ্গ স্মরণীয়।
তিনি বাঙালি মুসলিম নারীজাগরণে এবং নারীকল্যাণে বড় দায়িত্ব পালন করেছিলেন— বাঙালির ঘরে ঘরে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মতো রাজকন্যারাই ফিরে ফিরে আসুন।