চর্চায় অপকীর্তির জমানা

গণতন্ত্র ধ্বংসের অপর নাম মোদি-শাসিত হিন্দুস্তান। উত্তর-পূর্বে মণিপুরের মা কাঁদছে, ওদিকে দক্ষিণে নির্বাচন কেন্দ্রের পুনর্বিন্যাস নিয়ে বদমায়েশি চলছে। লিখছেন পুর্ণেন্দু বসু

Must read

ভয়ঙ্করের খেলা চলছে মণিপুরে। তার জন্য দায়ী সংঘ পরিবার—একথা এখন জলের মতো পরিষ্কার। খুন, দাঙ্গা, অগ্নিসংযোগ, উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার। তবুও দেশের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চুপ। এখনও পর্যন্ত মোদি সাহেব একবারের জন্যও মণিপুরের অত্যাচারিত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারলেন না। তিনি দারুণ ব্যস্ত! তাঁর ব্যস্ততা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে।

আরও পড়ুন-পুজোর মধ্যে ডাকা যাবে না অভিষেককে, ইডিকে স্পষ্ট বার্তা হাইকোর্টের

জি-২০ সম্মেলন, মহিলা সংরক্ষণ আইন, রামমন্দির ইত্যাদির কৃতিত্ব প্রচারে তিনি অতি-ব্যস্ত। দেশের মৌলিক সমস্যা নিয়ে তাঁর ভাবার সময় নেই। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারির সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে মোদি মাহাত্ম্য প্রচারে দল এবং সঙ্ঘ পরিবার কোমর বেঁধে নেমেছে। মোদির নেতৃত্বে বিশ্বদরবারে ভারতের মর্যাদা কতখানি বৃদ্ধি পেল, মহিলাদের জন্য একমাত্র তিনিই যে মহান কর্তব্য সম্পন্ন করলেন, ইত্যাকার প্রচারে এখন মুখরিত ভারতের আকাশ-বাতাস। আর তারই মধ্যে হিন্দুত্ববাদী প্রচারে, সংখ্যালঘুদের প্রতি ঘৃণাবর্ষণে বিরামহীন কার্যকলাপ যত গুরুত্ব পাচ্ছে, সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে সরকারের ভাবনা তার ধারে-কাছে নেই। এরই পাশাপাশি ভারতীয় রাজনীতির আকাশে নানা সঙ্কটের আভাস ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। একদিকে ‘ডিলিমিটেশন’ অন্যদিকে কাশ্মীরে সংরক্ষণের জট— এ সবই বিজেপির ভোট বাড়াবার কৌশল, আইনের আড়ালে কার্যকর হচ্ছে।

আরও পড়ুন-রাজভবনের গেটের সামনে রাতভর ধর্নায় থাকবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, নিশানায় রাজ্যপাল

প্রথমেই আসা যাক ডিলিমিটেশনের কথায়। এ-বিষয়ে আলোচনা যথেষ্ট কম হচ্ছে। ‘ডিলিমিটেশন’—যার অর্থ জনসংখ্যার ভিত্তিতে লোকসভার রাজ্যভিত্তিক আসনের পুনর্বিন্যাস। বিষয়টি এমনই যে, এর মাধ্যমে ভারতীয় গণতন্ত্রকে পাল্টে দেওয়ার আশঙ্কা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ এমনই এক ঘটনা, যা ঘটতে চলেছে উত্তর ভারতের হিন্দুবলয়ে খুশির জোয়ার এবং দক্ষিণ ভারতে বিপন্নতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। এর ফলে বাড়তে চলেছে জনসংখ্যার নিরিখে লোকসভা ও বিধানসভার আসন সংখ্যা। এতে জনসংখ্যা যে প্রদেশে বেশি সেই প্রদেশগুলিতে লোকসভায় আসন যেভাবে বাড়বে, কম জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাজ্যের তুলনায় তা বেশি হবে। ফলে গোবলয়ের ক্ষমতা, অন্য রাজ্যগুলি, বিশেষ করে দক্ষিণের রাজ্যগুলির থেকে বেড়ে যাবে। এটা একেবারে অবধারিত ভাবেই ঘটবে। তখন, আইন পাশের ক্ষেত্রেই হোক বা যে-কোনও সংসদীয় কার্যক্রমের ক্ষেত্রেই উত্তর ভারত যা চাইবে, দক্ষিণ ভারতকে তা মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। দক্ষিণ ভারতের উন্নয়নশীলতার কারণে সেখানে জনসংখ্যার হার হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। এই ভাল কাজের্যে জন্য তারা ‘শাস্তি’ পাবে! যারা জনসংখ্যা হ্রাসে অসফল তারা পুরস্কৃত হবে। পশ্চিমবঙ্গও জনবহুল গোবলয়ের অন্তর্গত নয়। এ বিষয়ে তেমন আলাপ-আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। ডিলিমিটেশনের ফলে কেবল উত্তর-দক্ষিণের ভেদই বাড়বে না, রাজনীতির মানচিত্রে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনাও বাড়বে। হিন্দুত্ব বলয় বলে যে অঞ্চল পরিচিত, সেখানে যে রাজনীতি অনেকটা জনপ্রিয়, তা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনীতিকেও অনেকাংশে গ্রাস করে ফেলছে। এতে বিজেপির বিরাট লাভ। অর্থাৎ এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিপদই ঘটবে না। গণতান্ত্রিক রাজনীতি চেহারাটাও অনেকখানি পাল্টাবে।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে অরাজকতা: তোলা না পেয়ে ৭কিমি রাস্তা খুঁড়লেন বিজেপি বিধায়কের সঙ্গী

আমরা জানি, ডিলিমিটেশন একটা সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। প্রতিবার জনগণনার পরেই আসন পুনর্বিন্যাস ঘটলেও গত পঞ্চাশ বছরে লোকসভা ও বিধানসভার আসনের মোট সংখ্যার কোনও হেরফের হয়নি। যেমন পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ৪২ ও বিধানসভা আসন ২৯৪ থেকে গিয়েছে। জনসংখ্যার হেরফের অনুযায়ী তাদের চেহারা পাল্টেছে, কিন্তু সংখ্যা পাল্টায়নি। পঞ্চাশ বছর পর এবার যেহেতু আসনসংখ্যাই বাড়তে চলেছে, গালমাল সেখানেই। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মহিলা সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে এই ডিলিমিটেশনকে জুড়ে দেওয়ার এক প্রবল প্রয়াস চলছে। এই প্রয়াসের একটা কারণই হল, মোট আসন সংখ্যার বৃদ্ধি। যার ফলে পুরুষ আসন খুব বেশি কমবে না ধরে নিয়েই পুরুষতান্ত্রিক হিন্দুত্ব বলয়ের নেতাদের বিষয়টিতে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। তাই, একথা বলা ভুল হবে না যে, ডিলিমিটেশনই হতে চলেছে শাসক বিজেপির একটা বড় হাতিয়ার। এটা হতে চলেছে ক্ষমতায় টিকে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তরূপী একটা কু-কৌশল। ভারতের গণতন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্র বদলাবার পথটি শাসকরা পাকা করছে। পাকা করছে একদলীয় শাসনের রাস্তাটিও।

আরও পড়ুন-অভিনব পন্থা, ইনস্টাগ্রাম রিল দেখে অপরাধীকে গ্রেফতার পুলিশের

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, ‘জম্মু ও কাশ্মীর তফসিলভুক্ত জনজাতি সংরক্ষণ (সংশোধনী), ২০২৩’ বিল। বোঝা যাচ্ছে, শাসকরা কাশ্মীরে বিধানসভা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঠিক সময় বুঝে কাশ্মীর নিয়ে চার-চারটি বিল সম্প্রতি আইনসভায় পৌঁছেছে। বিলগুলির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সেই রাজ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই অঞ্চলটির চরিত্রে বড় মাপের পরিবর্তন করতে চায় শাসকরা। ‘সংরক্ষণ’ বিলটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানের তফসিলভুক্ত জনজাতির যে তালিকা রয়েছে, সেটা পুরোপুরি জাতীয় তালিকা নয়, বরং তা প্রদেশভিত্তিক কিংবা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলভিত্তিক। তাই, কোনও অঞ্চলের জনজাতি কে বা কারা, সেটা ঠিক করেন বা সঠিক হিসাবটা দেওয়া সম্ভব সেই অঞ্চলের শাসন যাঁদের হাতে রয়েছে তাঁদের পরামর্শক্রমে। হরিয়ানা, পাঞ্জাব, দিল্লি বা পুদুচেরির ক্ষেত্রে এমন তালিকা নেই। ১৯৮৯ সালের আগে জম্মু ও কাশ্মীরেও এমন তালিকা ছিল না। ১৯৮৯ সালে সেখানে প্রথমবার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি হয়। ১৯৯১ সালে সেটি আবার সংশোধিত হয়। সেই তালিকাই এবার সংসদে নতুনভাবে সংশোধিত হল। এতে চারটি নতুন জনজাতির নাম যুক্ত হয়েছে। এখন সংখ্যাটি দাঁড়াল ১৬। এটা ধরে নেওয়া যায়, এর ফলে এই জনজাতির সমর্থন পেতে পারে বিজেপি। সেখানে ভোট হলে জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার ৯০টি আসনের মধ্যে সংরক্ষিত আসনগুলি আসবে বিজেপির পক্ষে। ডিলিমিটেশনের ফলে জম্মুর আসন সংখ্যা বেশখানিক বাড়বে, গুজ্জর, পাদ্দারি, নাগসেনা জনজাতির সমর্থন ক্ষমতার ভারসাম্য বিজেপির দিকে হেলিয়ে দেবে— এটাই বিজেপির হিসাব। এ সবই বিজেপি করছে হিসাব কষে।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের বঞ্চনার প্রতিবাদে অভিষেকের নেতৃত্বে ‘রাজভবন চলো’ অভিযানে উপচে পড়া ভিড়

আর সমস্যা এখানেই। সংরক্ষণ একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার কারা কতটা পেতে পারে, তার বিচার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। তা হওয়া উচিত জটিল সমাজতাত্ত্বিক ও ইতিহাসভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে। ভোট পাওয়ার কূটকৌশল দিয়ে তা হওয়া উচিত নয়। আঞ্চলিক জনজাতির ক্ষেত্রে সংরক্ষণকে একটা অস্ত্র ধরে নিয়ে বিজেপি একাধিক ক্ষেত্রে তার ব্যবহার করে চলেছে। সর্বত্র তার সুফল মেলেনি। মণিপুর তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বাস্তবে মণিপুরের ঘটনা এটা বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, সংরক্ষণের এই হাতিয়ারটি নির্বিচারে ব্যবহার করলে তা আক্ষরিক অর্থেই আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে গোটা জনসমাজকে। বিজেপি এর থেকে কোনও শিক্ষা নেয়নি। মণিপুর পর্বের পর তাই শুরু হতে চলেছে সংরক্ষণের কাশ্মীর পর্ব। ভারতে বহু সংখ্যক জনজাতি এবং তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান রয়েছে বিপুল বৈচিত্র্য ও নানা জটিলতা। তাই একথা বলা প্রয়োজন যে, সংকীর্ণ স্বার্থে পরিচালিত এই নির্বাচনী এঞ্জিনিয়ারিং দেশ জুড়ে ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ডেকে আনছে। ডেকে আনবে।

আরও পড়ুন-আজ শুরু বিশ্বকাপ, লর্ডসের উত্তাপ ফিরছে মোতেরায়

পশ্চিমবঙ্গে আদিবাসী সাঁওতাল এবং কুর্মি সমাজের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বিজেপি। দুই সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ লাগিয়ে ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের সুবিধা করে নেওয়ার এই বিপদকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মানুষ অনেকটা সামলে নিয়েছেন। বিজেপি এ রাজ্যে জাতপাতের রাজনীতিকে আমদানি করে যে বিপদ তৈরি করছে, তা আগুন নিয়ে খেলারই নামান্তর। এই কাজ তারা করছে অনেকটা গোপনে। ভোট এলেই জাতপাত-ধর্ম নিয়ে বিজেপির কার্যকলাপ ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিন্তু এখন আইন করে এই বিভাজনের রাজনীতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। বিজেপির ভোটের ভবিষ্যৎ ভাল নয়। তাই যেনতেনপ্রকারে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিজেপি মরিয়া। এ-সবের বিরুদ্ধে বিরোধী শক্তিকে সর্বোতভাবে পথে নামতে হবে। গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষার লড়াইকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এটা বোঝা দরকার যে আসন সমঝোতা একটা বিষয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্র ধ্বংস করার যে চাল বিজেপি চালছে তাকে বানচাল করতে না পারলে দেশেরই ক্ষতি। সেই ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না।

Latest article