ভাস্কর ভট্টাচার্য: তিনি শিল্প ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রণকারকদের একজন। বিশেষ করে মুদ্রিত কাঠের নকশাগুলিকে ফাইন আর্ট এবং শিল্প ইতিহাসের এক নতুন ধারায় নিয়ে আসেন। তাঁর মূল খ্যাতি প্রিন্ট এবং গ্রাফিক্স শৈলীর উপর নির্মিত হয়েছিল। ধর্মীয় বিষয় ও প্রতিকৃতি রচনায় ইতালির রেনেসাঁসের এই শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।
বাবা সোনার ব্যবসায়ী। ধনকুবের। অনেকগুলি সন্তান। তাদের মধ্যে এই সন্তানটি যেন একটু বেশি অন্যরকমের। একটু বেশি শিল্পমনস্ক। যেকোনো কাজের মধ্যেই শিশুকাল থেকেই এই ছেলে খুঁজে পেত শিল্প সুষমা।
আরও পড়ুন-করোনা আক্রান্তদের চাঙ্গা করতে নয়া উদ্যোগ হ্যালো, মহকুমাশাসক বলছি
একসময় বাবা নকশাদার দরজা প্রস্তুতকারক হিসেবে ব্যবসা শুরু করলেন। সেই ব্যবসায় পুত্র মাত্র ১৩ বছর বয়সে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে যোগ দিলেন। বাবার কর্মশালায় একজন ব্যতিক্রমী ড্রাফটসম্যান হিসেবে নিজের প্রতিভা তুলে ধরলেন। এই শিশুর প্রতিভা দেখে বাবাই উৎসাহী হয়ে ১৫ বছর বয়সে শিশুকে চিত্রশিল্পী মাইকেল ওলগেমুটের অধীনে শিক্ষা নিতে পাঠালেন। তারপর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি । বিশ্বের দরবারে নিজেকে একজন স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি আগে। এই শিল্পীর নাম অ্যালব্রেক্ট ড্যুর। জন্ম ২১ মার্চ ১৪৭১ জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে।
আরও পড়ুন-পড়ুয়াবন্ধু পুলিশের অভিনব ‘কৌশিশ’ নিখরচায় পরীক্ষা প্রস্তুতি–তালিম
মন শুধু ছবি আঁকতে চায়। শিশুবেলা থেকে সেই দিকেই চোখ । কখনো পাথরের উপর খোদাই, কখনও তামা বা লোহার ওপর আঁকি-বুকি। বাবাও কি জানতেন একদিন এই শিশু গোটা জার্মান-সহ ইউরোপে, ইতালিতে ঝড় তুলবেন। শিল্পের শেকড় ধরে নাড়িয়ে দেবেন। এক নবধারার উদ্ভাবক হয়ে বেঁচে থাকবেন শিল্পের ইতিহাসে। ছবির দুনিয়ায়। জলরঙে আনবেন নবজাগরণ। চিহ্নিত হবেন এক নবযুগের উদ্ভাবক হিসেবে ।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে শিল্পীর হাতেখড়ি সেখান থেকে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছে তাঁর পরিচিতি। তিনি শিল্পী মুদ্রাকর গণিতবিদ থেকে অনেক নামে পরিচিত। এই শিল্পীর নাম অ্যালব্রেক্ট ড্যুর (১৪৭১-১৫২৮)।
জন্ম জার্মানির নুরেমবার্গ। নুরেমবার্গ থেকে ইতালি। ইতালি থেকে আবার নুরেমবার্গ ফিরে এসেছিলেন জীবনের শেষদিকে। চলমান শিল্পের ইতিহাস হয়ে।
আরও পড়ুন-ফোন করলেই বাড়িতে হাজির হবেন স্বাস্থ্যকর্মী
মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বানিয়ে ফেললেন আত্মপ্রতিকৃতি। মুগ্ধ বিস্মিত সবাই। পরবর্তীকালে এই শিল্পী কত মূর্তি যে খোদাই করেছেন তার হিসেব নেই । তবে তিনি যে লুভর মিউজিয়ামে রয়েছেন তার সংবাদ আছে ।
শুধু মূর্তি গড়া এটা এমন কিছুই নয়, যে কারণে গোটা বিশ্ব জার্মানিতে জন্ম নেওয়া এই শিল্পীকে মনে রাখবে, এবং চর্চিত হবেন তা হল তুলি আর জলের মিশ্রণ ঘুমন্ত পৃথিবীর দরজা খুলে এক নতুন বার্তা দিয়েছেন। বলা হয়, তার হাত ধরেই ইউরোপে জলরঙে আঁকা নৈসর্গিক চিত্র বা ল্যান্ডস্কেপের সূচনা হয়েছিল। জলরংয়ে পাহাড়, নদী, বন , অরণ্য বন্যপ্রাণীর ছবি এঁকে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন সে সময়ের শিল্পকলা সমালোচকদের। সেদিন ইউরোপে ‘নবজাগরণ।’ শিল্পের নতুন উদ্ভাবনে।
আরও পড়ুন-গ্রামের মেয়েরা বাঁচিয়ে রেখেছে টুসু-পরবকে
নতুন জলরংয়ের ব্যবহার দেখে উদ্বুদ্ধ সেদিন শুধু শিল্পানুরাগী নয় ইঞ্জিনিয়ার, মানচিত্র আঁকিয়ে থেকে সার্ভেয়ার সকলেই বাহবা দিয়েছিলেন। কারণ জলরংয়ে আঁকা বিস্তীর্ণ পটের ছবি দেখে দেখে নতুন নতুন ঐতিহাসিক স্থানের সন্ধানে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে মানুষ ইতালি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিল। তাঁরই দেখানো পথে অনেক শিল্পী হাতে রং তুলি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি নিসর্গ চিত্র বন্যপ্রাণী ধর্মীয় চার্চ থেকে অনেক রোম্যান্টিক জায়গার ছবি এঁকে বিক্রি করতেন । সেসব ছবি ধনী পরিবারে সম্ভ্রান্ত দেওয়ালে টাঙানো হত। ড্যুরের দেখানো পথেই শিল্পী দিলেওন্তি (Dilehanti )-র সেদিন লক্ষ লক্ষ টাকায় ছবি বিক্রি হয়েছিল। ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম গিলপিন (William Gilpin)-এর জলরঙে আঁকা ‘ পিকচার্স কিউ’ তো আজও সমান সমাদৃত। যেখানে নানান উল্লেখনীয় জায়গা, ধর্মস্থান, গির্জা, বিখ্যাত মানুষ, প্রভৃতির ছবি দিয়ে সিরিজ তৈরি করে সেই সব ‘পিকচারস কিউ’ বিক্রি হত। এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে ব্রিটিশ শিল্পীরা সাদরে গ্রহণ করে গড়ে তুলেছিলেন ‘ন্যাশনাল আর্ট’। সেই দলে ভিড়েছিলেন টমাস গেইন্সবার্গ, জন রবার্ট কোজেন্স, ফ্রান্সিস টাউনে, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো বিখ্যাত সব শিল্পীরা। সেদিন তাঁরই দেখানো পথে দান্তের ‘ইনফার্নো’ জলরঙে সচিত্র হয়ে নতুন রূপ নিয়ে প্রকাশিত হল। চারদিকে এই বইয়ের প্রচার। এক কথায় জার্মান থেকে ব্রিটিশ সমস্ত শিল্পী সেদিন ড্যুরের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে নিজেরাই নেমে পড়লেন নতুন ধারায়, নতুন মাধ্যমে কাজ করতে।
আরও পড়ুন-নিয়ম ভেঙে প্রচার গ্রেফতার বিজেপি বিধায়ক
জলরংয়। পল স্যান্ডবিকে (Paul Sandby)-কে ব্রিটিশ জলরঙের জনক বলা হয়ে থাকে। যিনি এই জলরঙের ছবি এঁকে গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শতাধিক ঐতিহাসিক ধর্মীয় এবং নৈসর্গিক প্রাকৃতিক ছবি এঁকে কোটিপতি হয়েছিলেন তখনকার দিনে। ১৮০৪ সালে গঠিত হয়েছিল ওয়াটার কালার সোসাইটি। পরবর্তীতে রয়্যাল ওয়াটার কালার সোসাইটি নামে পরিচিত হয়েছিল ১৮৩২ সালে।
জলরংয়ে ছবি আঁকার জনপ্রিয়তা এতই বেড়ে গেল যে সেই সময়ে নানা প্রান্ত থেকে জলরঙের ছবি আঁকা শেখার বইও বের হতে থাকল। জন রাসকিন এর তৈরি ‘দ্য এলিমেন্টস অফ ড্রয়িং’ বেরল ১৮৫৭ সালে। তারপর ছবির দুনিয়ায় নানা রঙের খেলা। চিত্রশিল্পের ইতিহাসে নতুন রংয়ের ইতিহাস। সেই পথ অনেক বিস্তৃত। কিন্তু একথা বলতে দ্বিধা নেই ড্যুরের দেখানো পথেই ছবির দুনিয়ার জয় জয়াকার ঘটেছিল সেদিন। আজও এই রঙিন ছবির দুনিয়ায় তিনি জ্বলজ্বল করছেন।
আরও পড়ুন-জলরঙে নবজাগরণ এনেছিলেন অ্যালব্রেক্ট ড্যুর
দুনিয়ায় এখন অনেক মাধ্যম জলরং, তেলরং, চারকোল ইত্যাদি। সেই পথ ধরেই মুঘল পিরিয়ডে ছবি আঁকায় এসেছিল নতুন ধারার ঢেউ। তারপর নানা রকম ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রংয়ের ব্যবহার।
প্রাচীন যুগের গুহাচিত্র থেকে ইজিপ্টেও নানান চিত্রকরের সন্ধান মেলে। তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করতেন। ভারতবর্ষে অজন্তা ইলোরা থেকে কোনারকের মন্দির ছাড়িয়ে খাজুরাহোর ভাস্কর্য তার নানা প্রতিফলন দেখা যায়। এসেছে পোড়ামাটির ভাস্কর্য। রং ও ভাস্কর্যের ইতিহাস সুবিস্তৃত। দীর্ঘ তার বিবর্তনের কাহিনি।
জলরংয়ে ড্যুর নতুন দিগন্ত খুলে দেবার আগে খোদাই ভাস্কর্যেও এক বিরাট অবদান রেখেছিলেন। সোনার ব্যবসায়ী অ্যাস্টেন কোবেরগার সোনার ব্যবসা ছেড়ে প্রকাশনায় নেমেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন ‘নুরেমবার্গ ক্রনিক্যাল’। যেখানে ড্যুরের করা খোদাইচিত্র ছাপা হয়েছিল। আর তৈরি হয়েছিল অ্যাপোক্যালিপ্স সিরিজ ‘নাইট (Night) ডেথ অ্যান্ড দ্য ডেভিলস’, সেন্ট জেরম অ্যান্ড স্টাডি’, ‘মেলানকোলিয়া’ পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে।