একজন আদর্শ চিকিৎসক

বেশকিছুদিন কার্মাটারে কাটিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। হয়ে উঠেছিলেন আদিবাসী মানুষদের বন্ধু। প্রয়োজনে করতেন চিকিৎসাও। সামাজিক ব্যাধির পাশাপাশি দূর করেছেন শারীরিক ব্যাধিও। ২৯ জুলাই ছিল তাঁর প্রয়াণ দিবস। ঈশ্বর-স্মরণে ডঃ জয়ন্ত কুশারী

Must read

ঈশ্বরের কাছে মানুষ কৃতজ্ঞ। এবং তা আবহমান কাল থেকে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। সে কথা সে মুখ ফুটে বলেও। কখনও একান্তে। কখনও সর্বসমক্ষে। তবে এই মিথ এবার ভাঙলেন অন্য এক ঈশ্বর। এখানে ঈশ্বর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন বড় মাপের এক মানুষ (ম্যান)-কে। বিশ্বাস হচ্ছে না? কী বলছেন? ঈশ্বর তো অমূর্ত। তিনি কথা বলবেন কী করে? তাও আবার (মানুষের কাছে) কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন। আরে বাবা, স্বপ্নাদেশ কিংবা দৈববাণী। এ হয় নাকি? এখানেও তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন, আর কেউ তা আাড়ি পেতে শুনলেন। ডায়েরিতে লিখলেন। আর পরে তা প্রকাশ করলেন। এই কথা এখন এখানেই থাক। কেননা, কথায় কথা বাড়ে। তাই তাঁর কৃতজ্ঞতার ভাষাটি হুবহু তুলে দিলাম। কারণ, আপনাদের বিশ্বাসভঙ্গের কারণ হব না বলে।

আরও পড়ুন-ডায়মন্ড হারবারের আজ নতুন লড়াই

‘I am greatfull to that great man. That great man is Samuel Hahnemann.
এই ঈশ্বর যে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (শর্মা) অর্থাৎ বিদ্যাসাগর, তা বুঝি বলার অপেক্ষা রাখে না। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে তাঁর এই কৃতজ্ঞতা এখন সে বিষয়ে আসা যাক। অগাস্টের ১২ তারিখ। সালটা ১৮৭৪। দুরারোগ্য কলেরায় আক্রান্ত সাঁওতাল পরগনার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) কার্মাটাঁড়ের হরিজনপল্লির অশ্বিনী হেমব্রম। টানা তিনরাত ঠায় জেগে ওষুধ-পথ্যি, সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে এদিনই সুস্থ করে তোলেন বিদ্যাসাগর। তাঁর সম্বল বলতে ছিল শুধু মহাত্মা হ্যানিম্যানের ‘Organon of Medicine’ বইটি। আর হোমিওপ্যাথি ওষুধ। রোগের লক্ষণ এবং কারণ-এর সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে ওষুধ-পথ্যি দিতে চিকিৎসার এই সহায়ক গ্রন্থটি রোগ নিরাময়ে ব্রহ্মাস্ত্রের মতো কাজ করেছিল। আর ঠিক সময়ই উল্লেখিত কৃতজ্ঞতাসূচক মন্তব্যটি করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অস্ফুট স্বরে উচ্চারিত কথাগুলি শোনেন তাঁরই সহোদর ভাই শম্ভুচন্দ্র। সেই সময় তিনি ওখানে দাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। পরে তিনি তাঁর ডায়েরিতে আনুপূর্বিক লিপিবদ্ধ করেন। ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহকে।
‘ডাকটরবাবু গো আমায় বাঁচান না ক্যানেএএ? হামি যে বাঁচতে চাই। মরণ যে বড়ওও কঠিন, বড়ওও কঠোর। হামি মরতে চাই না। মরণ বড়ও ডঅর লাগে গো ডাকটরবাবু। ডাকটরবাবু হামি মরদের মতো বাঁচব। খুন-পসিনা এক করে খাটব। বিমার অউর বেরোজগারি মরদ্ কো মরণ কি বরাবর লে যাতা হ্যায়। আমায় বাঁচান না ক্যানেএএ?’ এই ছিল বিদ্যাসাগরের প্রতি অশ্বিনী হেমব্রম-এর আর্জি।

আরও পড়ুন-‘আরও কিছু পরিকল্পনা আছে, সেগুলি কার্যকর করতে হবে’, জিতেও উন্নতির বার্তা রোহিতের

এরই মাঝে বারচারেক শরীর উজাড়-করা বমি করল অশ্বিনী। আর ছিল বারে-বারে পায়খানা। বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া শরীরটাকে কোনওভাবেই সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি আর পরিবেশ কোনওটাই ছিল না ঊনবিংশ শতকের সাঁওতাল পরগনার এই গণ্ডগ্রামে। নিকটে বা দূরে কোনও আত্মীয়ও নেই অশ্বিনীর। স্বজন বলতে বউ। সেও বছর চারেক আগে মারা গেছে। আর শিবরাত্রির সলতে অবশিষ্ট পুত্রসন্তানটি এনকাউন্টার হয়েছে ব্রিটিশ শাসকের কাছে। শাসকবিরোধী কার্যকলাপে। দেশদ্রোহিতার অজুহাতে। স্বদেশি হওয়ার অপরাধে। তরতাজা যুবক পু্ত্রসন্তানটিকে পিতা অশ্বিনী খুইয়েছে অতি সম্প্রতি। মাস দুয়েক আগে।

আরও পড়ুন-চিহ্নিত হবে হাতি করিডর বনে বাড়বে পাহারা চালু হেল্পলাইন, হাতির তাণ্ডব ঠেকাতে ব্যবস্থা

‘ঈশওয়র (ঈশ্বর, এখানে ঈশ্বরচন্দ্রকে) মানে তো গুডু। গুডু আমাদের ভাষায় সাঁওতালিতে ঈশ্বরকে। অওর গুডু-র গুডু হোলো মরাং গুডু (প্রধান ঈশ্বর)। ডাকটর বাবু, ও হি মরাং গুডু অ খাড়া হ্যায় আপন্ কো পাশ। আপন্ কো বাঁচানে কে লিয়ে। জিন্দেগি অওর মওত উনকো হাত মে-ই হোতা হ্যায়। মুঝে স্রেফ্ এক্ মওকা দিজিয়ে। আপন্ কো বাঁচনে কে লিয়ে।’ অশ্বিনী ওই রুগ্ন শরীরে থেমে থেমে অন্তরের শ্রদ্ধা উজাড় করে দিল হিন্দি মেশানো ভাঙা ভাঙা বাংলায়।
শম্ভুচন্দ্র তাঁর ডায়েরিতে লিখছেন, ‘১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাস থেকে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ পর্যন্ত মোটামুটি স্থায়ীভাবে দাদা ছিলেন সাঁওতাল পর গনার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) কার্মাটারে। এখানের হরিজনপল্লিতে একটি বাড়ি কিনে বসবাস করতেন। মূলত সহজ-সরল, সৎ-অকপট, অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত, স্বচ্ছ-কর্মঠ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন দাদা।’

আরও পড়ুন-পুরস্কৃত শিশুসাহিত্যিক

তিনি আরও বলছেন, ‘পরবর্তীকালে সহায়সম্বলহীন এই মানুষগুলির আত্মার আত্মীয় হয়ে যান। এবং এদের চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে। এদের কাছে তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ মারাং গুডু। ডাকটর বাবু বা ডাকটর-সাব ছাড়াও কেউ বলতেন, বাবা। কেউ-বা জেঠা। আবার কেউ বলতেন কাকা। বাড়ির বৈঠকখানাটি ছিল তাঁর চেম্বার। রোজ রোগী দেখতেন নিয়ম করে। ছুটির দিনও। ভোরবেলা থেকে বেলা ১০টা পর্যন্ত। মাঝে কোনও বিরতি ছিল না। তারপর গ্রন্থ রচনার কাজ। গাছ-পালার পরিচর্যা। আর রান্না-বাড়ার কাজ। এরপরই খাওয়াদাওয়ার জন্য সময় পেতেন। সে সময়টুকুও যেন ওই কোনওমতে সব কাজ থেকে একটু একটু কেটে নেওয়ার সময়। টেনটুনে যেটুকু বের করা যেত।
কেননা, বিকেল থেকে রোগীদের বাড়িতে গিয়ে রোগী দেখা আর চিকিৎসা-সংক্রান্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর নেওয়া। যা চলত মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। শুধু কি তাই, ওষুধের সঙ্গে দুধ-সাগু-বার্লি-চিনি-বাতাসা-সহ প্রয়োজনীয় পথ্যও দিতেন বিনা পয়সায়।’

আরও পড়ুন-পুরস্কৃত শিশুসাহিত্যিক

শম্ভুচন্দ্র লিখছেন, ‘রোগপীড়িত আর্ত মানুষের চিকিৎসা, সেবা-শুশ্রূষার বিষয়ে দাদা যে কতটা তন্নিষ্ঠ ছিলেন তার একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। রাজনারায়ণ বসু তখন দেওঘরে অবস্থান করছেন। কথা ছিল দাদা সেখানে যাবেন। একটি বিশেষ কাজে। নির্দিষ্ট দিন কেটে গেল। তারপরও ২-৩ দিন পেরিয়ে গেল। কোনও দিন কথার খেলাপ করেননি এমন মানুষ যখন সেখানে গেলেন না, তখন স্বাভাবিকভাবে উদ্বিগ্ন হলেন রাজনারায়ণ। রাজনারায়ণ তাঁর উদ্বিগ্নতার কথা ব্যক্ত করলেন দাদাকে। পত্র মারফত। পত্র মারফত তিনিও শ্রীবসুকে জানালেন তাঁর এই উদ্বিগ্নতা বোধের যথেষ্ট কারণ আছে। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেই বলছি, অশ্বিনী হেমব্রম। বছর ৬৪-র কলেরা রোগাক্রান্ত যমে-মানুষে টানাটানি করা এক রোগীর চিকিৎসা-পরিষেবায় দিন-রাত ব্যাপৃত। তাকে সুস্থ না করে যাওয়াটা বোধকরি সঙ্গত মনে করি না।

আরও পড়ুন-পুরস্কৃত শিশুসাহিত্যিক

রাজনারায়ণ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন। অশ্বিনী হেমব্রমের চিকিৎসা-পরিষেবা আর বিশেষ কাজে দেওঘরে যাওয়ার কাজ দুটির গভীরতার জল মাপলেন। একই সঙ্গে একজন আদর্শ চিকিৎসকের আদর্শ আচরণ বিধির পাঠ নিলেন রাজনারায়ণ। দাদাকে দেওয়া শ্রীবসুর পরের পত্রের পরতে পরতে ছিল উল্লেখিত লব্ধ অনুভূতির বিমুগ্ধ অক্ষরবিন্যাস।
এই বিমুগ্ধতা থেকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জেগেছিল সহোদর শম্ভুচন্দ্রেরও। শম্ভুচন্দ্র লিখছেন, ভোর থেকে বেলা ১০টা পর্যন্ত চেম্বারে কেবল থিকথিক-করা রোগীর কালো-সাদা-কটা চুলের মাথাগুলি আর রোগ উপশম করে হাসিমুখে তাদের বাড়ি ফেরা। বিকেল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত তাঁর রাউন্ডে যাওয়া। এককথায় রোগীদের বাড়িতে গিয়ে রোগ ও রোগীর পর্যবেক্ষণ। পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুসারে ওষুধ-পথ্য দিয়ে রোগীকে সারিয়ে তোলা, ডাক্তারের এই সাফল্য কোনও বুট-হ্যাট-কোট-টাই পরা ডাক্তারের নয়। নয় কোনও প্রথাগত ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের। এই সাফল্য ধূতি-চাদর তালতলার চটি-পরা শিখাধারী (টিকি) এক ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের। এই সাফল্য আদর্শ চিকিৎসকের যোগ্যতাসম্পন্ন এক মহামানবের। কী অপূর্ব রসায়ন! কী অভূতপূর্ব ঘটনা! যা প্রত্যক্ষ করলেন বিশ্ব চরাচর! সচরাচর না-ঘটা ঘটনার সাক্ষী হলেন সহৃদয়-সামাজিকেরা। আর সাক্ষী থাকল সমকাল।

আরও পড়ুন-প্রয়াত নির্মলা মিশ্র, শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

ব্যর্থতার জন্য তিনি পিছু হটেছেন এমন ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটেনি। তবে জীবন যেখানে জড়িত একটি স্পর্শকাতর বিষয়েও চূড়ান্ত সাফল্য কী করে সম্ভব? কোন মন্ত্রবলে? সরাসরি প্রশ্ন এবার দাদাকে। পরক্ষণেই তিনি রহস্য উন্মোচন করলেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে বলছে, Eagle’s eye. Lion’s heart. Mother’s hand. রোগ নিরূপণে আর রোগীর পর্যবেক্ষণে ঈগল পাখির চক্ষুদ্বয়ের মতো তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীল চোখদুটি হতে হবে। রোগকে নির্মূল করতে আর রোগীকে উপশম দিতে সিংহের কঠিন হৃদয় সুলভ হৃদয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে চিকিৎসায়। অবশেষ রোগীর সেবাযত্ন। এই যত্নআাত্তি মা তাঁর হাত দিয়ে যতটা ভাল করতে পারেন ততটা আর কেউ পারেন না। রোগীর সেবাযত্নের ক্ষেত্রেও মাতৃসুলভ এই গুণটিকে নিতে হবে। উল্লেখিত গুণগুলির অধিকারী হতে হবে একজন ডাক্তারকে।
এখন স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন মনে জাগে, বীরসিংহ কিংবা কলকাতা ছেড়ে সমাজসেবার কাজের ক্ষেত্র হিসাবে তিনি সুদূর কার্মাটাঁড়কে বেছে নিলেন কেন?

আরও পড়ুন-শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পদক্ষেপ, বৈঠক ডাকলেন ব্রাত্য

পারিবারিক জীবন এবং চারপাশের পৃথিবীটা যখন ভীষণভাবে তাঁর কাছে প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি সকলের থেকে অনেক দূরে শান্তির খোঁজে কার্মাটাঁড়ে চলে যান সমাজসেবার কাজে। শেষ জীবনে মোটেই সুখে কাটেনি তাঁর। জ্যেষ্ঠ সন্তান একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্রের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরেই মারা যান স্ত্রী দীনময়ীদেবী। নিঃসঙ্গ বিদ্যাসাগর একটু নির্জনতার সান্নিধ্যের জন্য বড়ই আকুল হয়ে পড়েছিলেন। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতার ঘাত-প্রতিঘাতে নাগরিক জীবনের পরিসরে বীতশ্রদ্ধ বিদ্যাসাগর গ্রামের গার্হস্থ্য দৈনন্দিনেও অনেক অশান্তিতে আহত হন।
কার্মাটাঁড়ে হরিজনপল্লিতে তিনি পাঁচশো টাকায় আমবাগান সমেত প্রায় ১৪ বিঘা জায়গা কেনেন। এখানেই একটি ছোট বাড়ি তৈরি করেন। নাম দেন ‘নন্দন কানন’ রাতের স্কুল চালানোর জন্য মাঝখানে একটি হলঘর, একপাশে শোবার ঘর। অন্যপাশে পড়ার ঘর। বাগানের দেখভালের জন্য কালী মণ্ডল নামে একজন মালিও রাখেন। এখানে বসেই তিনি ‘সীতার বনবাস’, ‘বর্ণপরিচয়’-এর তৃতীয় সংস্করণের প্রুফ দেখেন।
কার্মাটাঁড় জায়গাটি ছিল সাঁওতাল প্রধান। তাদের সারল্যে মুগ্ধ হয়ে বিদ্যাসাগর বাকি জীবনটা সেখানেই কাটাবেন স্থির করেছিলেন। তা অবশ্য হয়নি। মাঝে মাঝে তাঁকে কলকাতায় আসতে হয়েছে। মৃত্যুও হয় কলকাতা শহরে। সহজ-সরল আদিবাসী মানুষদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এলাকার আদিবাসীদের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে তাদের কাছে জীবনদাতা ঈশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। হরিজনপল্লিতে উপস্থিত থেকে তিনি নিজের হাতে কলেরা রোগীর চিকিৎসা-শুশ্রূষা সারিয়ে তুলেছেন। শীতকালে কার্মাটাঁড়ে হাড়কাঁপানো ঠান্ডা। তখন মোটা চাদর কিনে গরিব মানুষের মধ্যে বিতরণ করতেন। কখনও কলকাতা গেলে তাদের জন্য বিভিন্নরকম ফল নিয়ে আসতেন। \

আরও পড়ুন-তিন মহিলার ফাঁসি

কার্মাটাঁড় স্টেশনের সঙ্গেও তাঁর নানান স্মৃতি জড়িত। একদিন এক যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে কুলি কুলি বলে চেঁচাচ্ছিলেন। বিদ্যাসাগর কুলি সেজে সেই যাত্রীর মালপত্র বহন করেছিলেন। পরে সেই যাত্রী বিদ্যাসাগরের পরিচয় পেয়ে খুবই লজ্জিত হয়েছিলেন।
এখন কার্মাটাঁড়ে বিদ্যাসাগরের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলির হালহকিকত জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমেই বলি, কার্মাটাঁড় আজ বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত। আর স্টেশনটিও তাঁরই নামাঙ্কিত। স্টেশনটি ভিনরাজ্যে বিদ্যাসাগরকে আগলে রেখেছেন বাঙালি সমাজ। বিদ্যাসাগর স্মৃতি রক্ষা সমিতি তৈরি করে ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রাম কার্মাটাঁড়ে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ভিটে-মাটি, আমবাগান আর তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংরক্ষিত করে রেখেছেন প্রবাসী বাঙালিরা। শুধু সংরক্ষণ নয়, বিদ্যাসাগরের নামাঙ্কিত স্কুল, লাইব্রেরি চালানোর পাশাপাশি গরিব মানুষের জন্য হোমিওপ্যাথির চেম্বার খুলে চিকিৎসা পরিষেবাও চালু রেখেছেন তাঁরা। বিদ্যাসাগরের জীবদ্দশায় তিনি ঠিক যেমনটা করতেন তাঁর সাধের ‘নন্দন কানন’-এ বসে ঠিক সেই ভাবেই চলছে সমাজসেবা।

আরও পড়ুন-নবান্নে নিরাপত্তা: বসছে স্মার্ট গেট, ঢুকতে বিশেষ কার্ড

এ তো গেল তাঁর শারীরিক চিকিৎসা পরিষেবা তথা সমাজসেবার কথা। এখন আসা যাক, তাঁর সামাজিক দুরারোগ্য ব্যাধিগুলিকে নির্মূল করতে চিকিৎসকের ভূমিকা পালনের বিষয়ে।
আনুমানিক এগারো শতক থেকে ক্রনিক দুরারোগ্য সামাজিক ব্যাধিটি হল, অকালবৈধব্য আর পুরুষের বহুবিবাহের ফলে মাতৃজাতির দুর্বিষহ জীবন। মেয়েরা লেখাপড়া করলে বিধবা হয়। অশিক্ষার অন্ধকার গ্রাস করেছিল সমগ্র জাতিকে। প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। নেই পাঠ্যপুস্তক। নেই নীতিশিক্ষামূলক গ্রন্থ। সংস্কৃত ব্যাকরণ দুর্বোধ্য হয়ে যাচ্ছে। তার মেদের ভারে। সুখপাঠ্য অনুবাদ সাহিত্য নেই। পয়সার অভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষেরা অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান জোগাড় করতে পারছে না। লেখাপড়া করতে পারছে না। পড়াশোনার ইচ্ছে থাকলেও এহেন সামাজিক ব্যাধিগুলিকে সমাজ থেকে উপড়ে ফেলতে তিনি সমর্থ হন। একেবারে একক প্রচেষ্টায়। পদে পদে প্রবল বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে।

Latest article