কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আলো ও অন্ধকার

স্টিফেন হকিং থেকে শুরু করে এলন মাস্ক— বিশ্বের শীর্ষ কয়েকজন বিজ্ঞানী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এটি একসময় হয়তো মানব প্রজাতির জন্য একটি হুমকি হয়ে উঠতে পারে। সত্যি কি তাই? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলো অন্ধকার নিয়ে লিখলেন সৌরভকুমার ভূঞ্যা

Must read

এক আশ্চর্য আবিষ্কার
বিজ্ঞানের আশ্চর্যজনক আবিষ্কারের অন্যতম হল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এটি এমন এক প্রযুক্তি যার দ্বারা একটি কম্পিউটার সিস্টেম মানুষের মতো ভাবনাচিন্তা করে নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কাজ করতে পারে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। বর্তমানে তা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে অনেক মহল থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো মানুষকেও ছাড়িয়ে যাবে। এমনকী মানবজাতির বিনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে। ভবিষ্যতে কী হবে তা বলবে সময় কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে আমাদের জীবন ও সভ্যতাকে অনেক সমৃদ্ধ করে চলেছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আরও পড়ুন-বইমেলার ছবি

আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কে রয়েছে অসংখ্য নিউরন বা স্নায়ুকোষ। মস্তিষ্কের কোটি কোটি স্নায়ুকোষ একত্রিত হয়ে গঠন করে নিউরাল নেটওয়ার্ক বা স্নায়ু-জালক। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি তথ্য সংগ্রহ করে। নিউরন-বাহিত হয়ে সেই তথ্য মস্তিষ্কে পৌঁছয়। মস্তিষ্ক সেই তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজের জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়। বিজ্ঞানীরা মানব শরীরের অনুরূপ কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। এখানে কৃত্রিম স্নায়ু জালকের মাধ্যমে যন্ত্র শিক্ষালাভ করে। সেই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে মানুষের মতো কাজ করতে পারে।

আরও পড়ুন-পাসওয়ার্ডের ফেয়ারওয়েল

কীভাবে কাজ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা, চিকিৎসা থেকে গবেষণা, সর্বত্রই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ব্যবহার। এটি মানুষের শ্রম ও সময়ের সাশ্রয় ঘটাচ্ছে। পাশাপাশি অনেক বেশি নিখুঁতভাবে কাজ করতে পারে। অবসর কিংবা ক্লান্তি যা মানুষের কর্মের তারতম্যের অন্যতম ফ্যাক্টর, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন না থাকায় তা নিরলসভাবে যেমন কাজ করতে পারে তেমনি ক্লান্তিজনিত কারণে কর্মদক্ষতার হ্রাস বা ভ্রান্তি ঘটার মতো ব্যাপার থাকে না। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ চেষ্টা করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরও বেশি উন্নত করার।
ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে গ্রাহক পরিষেবার পাশাপাশি জালিয়াতি ধরতে সাহায্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় কিংবা সার্জারির ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্টারনেট ও সমাজমাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আশ্চর্যজনক ব্যবহার। এই প্রযুক্তি প্রয়োগ করে চালকবিহীন গাড়ি চলছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। দেশের নিরাপত্তার কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার মহাকাশ গবেষণাতেও এর উপস্থিতি চমকে দেওয়ার মতো। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ভারতের রোভার বিক্রমের সফল অবতরণের পেছনে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উল্লেখযোগ্য অবদান। এভাবে হিসাব করলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাজের চমকপ্রদ তথ্য আমাদের সামনে হাজির হবে।

আরও পড়ুন-এআই যেন নতুন আঙ্গিকের এক কবিতা

এই প্রসঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কথা না বললে নয়। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারি। কোনও একটি ইন্দ্রিয়ের বিকলাঙ্গতা আমাদের জীবনে অনেক জটিলতা ও বিড়ম্বনা সৃষ্টি করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এইসব ক্ষেত্রে অভাবনীয় কাজ করছে।
এআই-এর অভাবনীয় সাফল্য
অন্ধত্ব মানুষের জীবনে ভয়ঙ্কর অভিশাপ। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে এই ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। এক্ষেত্রে বলা যায় বায়োনিক আই (Bionic Eye)-এর কথা। এখানে মানুষের রেটিনায় একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস বসানো হয়। চোখের ওপর থাকে বিশেষ ক্যামেরা যুক্ত একটি চশমা। ক্যামেরা ছবি তোলার পর বিশ্লেষণ করে সেটি রেটিনার ডিভাইসে পাঠায়, যা পার্শ্ববর্তী সজীব কোষকে উদ্দীপিত করে। ফলে একজন দৃষ্টিহীন মানুষ দেখার ক্ষমতা লাভ করে। আলফা মস (Alpha Mos) নামক কোম্পানি ইলেকট্রনিক টাং তৈরি করেছে। এর মধ্যে এমন সব সেন্সর রয়েছে যা খাবারের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করে স্বাদের অনুভূতি দিতে পারে। ডলবি ল্যাবরেটরি (Dolby Laboratory) এমন এক অ্যালগোরিদম আবিষ্কার করেছে যা নির্দিষ্ট কণ্ঠস্বর কিংবা যান্ত্রিক সুরকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারে। এই প্রযুক্তি শ্রবণশক্তিহীন মানুষদের শোনার ক্ষমতা দান করে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি (Stanford University)-র ব্যুরো রিসার্চ গ্রুপ কৃত্রিম ত্বক আবিষ্কার করার কথা ঘোষণা করেছে যা হবে অনেকটা সত্যিকার ত্বকের মতো এবং এর মধ্যেকার সেন্সর সত্যিকার ত্বকের মতো বিভিন্ন অনুভূতি বহনে সক্ষম হবে।
বর্তমানে উন্নত কৃত্রিম অঙ্গ তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তির সেন্সর লাগানো থাকে যা চাপ, তাপমাত্রা, পেশির নড়নচড়ন প্রভৃতি শনাক্ত করতে পারে। কৃত্রিম অঙ্গে লাগানো সেন্সর তথ্য সংগ্রহ করে যা স্নায়ুতন্ত্রের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছয়। ফলে এই সকল কৃত্রিম অঙ্গ অনেকটা স্বাভাবিক অঙ্গের মতো কাজ করতে পারে। অ্যাটম লিম্ব (Atom Limb) নামে একটি আমেরিকান কোম্পানি এই বছরের মধ্যে মন নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম অঙ্গ আবিষ্কার করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন। দাবি করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমতা মানুষের শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কবে তার মৃত্যু হবে সেটাও বলে দিতে পারে!

আরও পড়ুন-১১ হাজারেরও বেশি পাড়ায় পাড়ায় বৈঠক

আশঙ্কায়
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে একটি কম্পিউটার নিমেষের মধ্যে সুন্দর সুন্দর গল্প, কবিতা, বিভিন্ন আর্টিকেল লিখতে পারে। এইক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় ওপেন এআই (Open AI)-এর চ্যাটজিপিটি নামক জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশনটির কথা। Transformer Based Large Language Model (LLM) GPT4-এর ওপর ভিত্তি করে এটি বানানো। এটি যে কোনেও সৃষ্টিশীল লেখা লিখতে পারে। প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কোডিং করতে পারে। মানুষের সঙ্গে গল্প করতেও পারে। এমনই আরও কিছু LLM Model হল Google-এর LaMDA, Meta-এর LLaMA প্রভৃতি।
এককথায় বলার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনে অভাবনীয় সাহায্য করছে। তবে প্রত্যেক জিনিসের মতো এরও কিছু খারাপ দিক আছে। যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিনে দিনে নিজেকে উন্নত করছে, আশঙ্কা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তা মানুষকে ছাড়িয়ে যাবে, মানব অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে আনবে। স্টিফেন হকিং তেমন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একদিন হয়তো এমন স্তরে পৌঁছবে যখন মানুষের সাহায্য ছাড়াই সে নিজের উন্নতি ঘটাতে পারবে। ক্যালিফোর্নিয়ার মেশিন ইন্টেলিজেন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও গবেষক এলিয়েজার ইউডকভস্কি বলেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যদি অতি বুদ্ধিমত্তায় (ASI) পৌঁছতে পারে তা মানুষের পক্ষে খারাপ। এর ফলে পৃথিবীর সকল মানুষের মৃত্যু হবে। প্রসঙ্গত বলার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিজে নিজে বাংলা শিখে নিয়েছে। গবেষকদের মতে নিজের প্রয়োজনে ইন্টারনেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাংলা শিখেছে। এই ব্যাপারটি মানুষের মনে ভয়ের সৃষ্টি করেছে। অধ্যাপক টবি ওয়ালশ আশঙ্কা করেছেন ২০৬২ সাল নাগাদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমকক্ষ হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন-আমেরিকায় পড়তে গিয়ে দিঘার ছাত্রের রহস্যজনক মৃ.ত্যু

আজকাল যুদ্ধক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ড্রোন শত্রুর গোপন তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করছে। পাশাপাশি এটির স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে কাজ করার ক্ষমতা রয়েছে। সন্ত্রাসবাদীরা এই দিয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালাতে পারে। এলন মাস্কের মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুদ্ধক্ষেত্রে আণবিক বোমার থেকেও মারাত্মক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়বাড়ন্তের কারণে বিভিন্ন সেক্টরে কর্মীর প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। হিসেব করলে এর আরও অনেক নেতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া যাবে।
এই প্রসঙ্গে বলার, নতুন প্রযুক্তিকে আমাদের স্বাগত জানাতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভাল-মন্দ দুই-ই আছে। মূল ব্যাপার হল, কোন উদ্দেশ্যে আমরা তাকে ব্যবহার করছি। পারমাণবিক বোমার ভয়ঙ্কর ক্ষমতার কথা জেনেও পৃথিবীর অনেক দেশ এটি তৈরি করছে। তবে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারে কিছু নীতি নির্দেশিকা আছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তেমনই একটা সীমারেখা থাকলে তা অনেকটাই নিরাপদ হবে। কৃত্রিম প্রযুক্তি ব্যবহারে এক ক্ষেত্রে বেকারত্ব বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে প্রযুক্তি, গবেষণা প্রভৃতে সেক্টরে প্রভূত চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

আরও পড়ুন-রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীই ঘুরিয়েছেন অর্থনীতির চাকা : স্নেহাশিস

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যতই অসাধারণ, আশ্চর্যজনক কাজ করুক এখনও পর্যন্ত মানুষের হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো প্রতিস্থাপিত করতে পারেনি। এমন কিছু সূক্ষ্ম দক্ষতার কাজ আছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা করতে পারবে না। তার জন্য মানুষের প্রয়োজন হবে। যে সমস্ত কাজে মানবিক গুণাবলির প্রয়োজন সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। সব থেকে বড় কথা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষ নিয়ন্ত্রিত। তাকে কাজ করতে গেলে মানুষকেই কমান্ড দিতে হয়। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাশ মানুষের হাতে রয়েছে। তাই মানুষকে সে ছাপিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা বোধহয় সঠিক নয়। তবে সত্যি যদি কোনওদিন মানুষের কমান্ড ছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে তাহলে তা হবে ভয়ঙ্কর।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আমরা বাদ দিতে পারব না। একে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। মানুষই এর সৃষ্টিকর্তা। মানুষকেই এমন কিছু করতে হবে যাতে করে এই প্রযুক্তি কোনওদিন তার স্রষ্টাকে যেন ছাপিয়ে যেতে না পারে। অর্থাৎ একটি লাগাম পরানোর ব্যবস্থা করতে হবে, যার রাশ মানুষের হাতে থাকবে।

Latest article