পাসওয়ার্ডের ফেয়ারওয়েল

আমরা এখন ডিজিটাল সমাজের নাগরিক। তাই আমাদের নতুন ঠিকানা। পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করা এই ঠিকানা। কিন্তু এই পাসওয়ার্ড মনে রাখা এক বিষম ঝক্কি। আজকের দিনে অনলাইনে পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার গল্পটা সবার জানা। এই গল্পের উপসংহারে ট্যুইস্ট আছে। পাসওয়ার্ডহীন দুনিয়ার সেই ট্যুইস্ট তুলে ধরলেন বিশ্বজিৎ দাস

Must read

ধনদৌলতের লোভে কাশিম পাগল হয়ে ছুটেছিল গুহার উদ্দেশ্যে। সেই গুহার সামনে দাঁড়িয়ে কাশিম চিৎকার করে বলেছিল— ‘চিচিং ফাঁক’। এটাই ছিল তার গুহাতে ঢোকার পাসওয়ার্ড। গুহা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর লাখ লাখ ধনরাশি বস্তার মধ্যে পুরে নিয়েছিল। নিজের লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিল সেই সকল সোনার গয়না, হীরে-জহরত-পাথর। নিজের মন এবং বস্তাভর্তি ধন-সম্পদ নেওয়ার পর ফিরে এসেছিল গুহার দরজার দিকে। কিন্তু লোভের বশে আত্মহারা হয়ে ভুলে গিয়েছিল গুহা খোলার মন্ত্র। নিজের মনের ভুলে আউড়েছিল— আলু ফাঁক, মুলো ফাঁক, পটল ফাঁক। কিন্তু আসল মন্ত্র গিয়েছিল ভুলে।
এ যেন আজকের দিনে অনলাইনে পাসওয়ার্ড ভুলে যাওয়ার গল্প। মার্জিনা-আবদুল্লায় কাশিম আলির থেকে ধন দৌলতে ভর্তি গুহার কথা জানার পর গিয়েছিল সেই গুহায়। জেনে গিয়েছিল গুহার মুখ খোলার মন্ত্র চিচিং ফাঁক এবং বন্ধ হওয়ার মন্ত্র চিচিং বন্ধ।

আরও পড়ুন-স্বামীর মা-বাবাকে সেবা করা স্ত্রীরও দায়িত্ব : হাইকোর্ট

পাসওয়ার্ড : ডাউন মেমরি লেন
১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কের গবেষক রে টিমলিনসন একটি ইলেকট্রনিক মেসেজ পাঠান। সরকারি নেটওয়ার্ক থেকে নিজের ডেস্কটপ কমপিউটারে পাঠানো সেই ম্যাসেজে কি-বোর্ডের উপর সারির লেটারগুলো পরপর লেখা ছিল— ‘Q, W, E, R, T, Y, U, I, O, P’ এটাই ছিল ই-মেলের দুনিয়ায় প্রথম বীজ রোপণ। এর সাত বছর পর ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানী শিবা আয়াদুরাইয়ের হাতে তৈরি হয় ই-মেলের আজকের আধুনিক ভার্সান— জি-মেল। যে মডার্ন ই-মেল দেখি তার কাঠামো। ফোল্ডার, ইনবক্স, সেন্ডবক্স এইসব। ১৯৭৮-এ আয়াদুরাই ইলেক্ট্রনিক মেল সাজিয়ে তোলার পরেই ই-মেলের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ে মানুষ।
কমন পাসওয়ার্ড
বহুদিন পর্যন্ত একসঙ্গে অনলাইন না থাকলে একজনের মেল অন্যজন পেতেন না। সেই বাধা কাটতে লেগে গেল আর ১৩টা বছর। গত ৪-৫ দশকে ই-মেল অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। পার্সোনালাইজড ভার্সন এসেছে। কোম্পানির নামে, এমনকী ব্যক্তিগতভাবেও সেই ডোমিন নিয়েই ই-মেল চালাচালি হচ্ছে এখন। আবার এমন ই-মেলও এসেছে যেখানে মেল পাঠাতে বা পড়তে দু’পক্ষেরই কমন পাসওয়ার্ড প্রয়োজন, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই ধরনের মেল ব্যবহার হয়।

আরও পড়ুন-রোগীর পরিজনদের জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগ, অ্যাম্বুল্যান্সে বাধ্যতামূলক প্যানিক বাটন

তবে ই-মেল যতই বদলাক, কখনওই তা ফ্রি ফ্রম পাসওয়ার্ড হয়নি। এখনও পুরোপুরি সেটা পাসওয়ার্ড-নির্ভর। আর এই পাসওয়ার্ড নিয়েই হাজারো গন্ডগোল। নেট দুনিয়ায় কড়া নাড়ছে এক নিঃশব্দ বিপ্লব। মেল বলুন বা অন্যকিছু— ইন্টারনেটে পাসওয়ার্ডের যুগ শেষ হয়ে গেল বলে মনে করা হচ্ছে।
পাসওয়ার্ড-পাস কী : উত্তরণের গল্প
গুগল, অ্যামাজন ও মাইক্রসফট তাবড় সংস্থাগুলো ই-মেলের বিকল্প পথে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। মুখ দেখিয়ে হাতের ছাপে লগ-ইন, পাসওয়ার্ডের বদলে বায়োমেট্রিক এন্ট্রি। এদের কেউ কেউ চাইছে ই-মেলের বদলে নিরাপদ কোনও পদ্ধতি, আবার কেউ চাইছে সব সমস্যার মূলে যে— সেই পাসওয়ার্ডকেই পাকাপাকিভাবে বিদায় করতে। পাসওয়ার্ডের জায়গায় গুগল এনেছে ‘পাস কি’। ফিঙ্গার প্রিন্ট, ফেস স্ক্যান করে লগ-ইন করার প্রযুক্তি। মাইক্রসফট একই প্রযুক্তি নিয়ে প্রায় তৈরি। কিন্তু বায়োমেট্রিকেও তো তথ্য চুরি করে প্রতারণা হচ্ছে!

আরও পড়ুন-

তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়োমেট্রিক লগ-ইনের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা কম। কারণ একই সঙ্গে হাত ও মুখের মাধ্যমে লগ ইনের অপশন ভাঙা প্রায় অসম্ভব। ‘ইনফোসিস’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নন্দন নিলেকানির বক্তব্য চমকে দেওয়ার মতো— ‘এখন পাসওয়ার্ডের জঙ্গলের থেকে সামনে এগোনোর সময় পাসওয়ার্ডের বিকল্পগুলি অনেক সুরক্ষিত। আগামী দু’বছরে ৫০ কোটি ভারতীয় পাসওয়ার্ড ব্যবহার ছেড়ে দেবেন’। ল্যাপটপ, ডেস্কটপ খুলতে পাসওয়ার্ড। অফিস মেলে, পার্সোনাল মেলে পাসওয়ার্ড, এমনকী অনলাইন ব্যাঙ্কিং লেনদেনেও পাসওয়ার্ড। পাসওয়ার্ডের জঙ্গলই বটে। গড়ে ভারতীয়দের ৪টি ই-মেল অ্যাকাউন্ট। কর্পোরেট চাকুরেদের গড়ে ৫-৮টি ই-মেল অ্যাকাউন্ট। চাকরি বদলালে ই-মেল এবং পাসওয়ার্ড বদলায়। নিরাপত্তার জন্য নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলও করতে হয়। পাসওয়ার্ডের চক্কর থেকে বেরোতে বিকল্প হল গুগলের ‘পাস কি’, মাইক্রসফ্টের ‘টিভা’, কিংবা অ্যামাজনের ‘ফেস কি’। ভারতের নিজস্ব নন পাসওয়ার্ড সিস্টেমও তৈরি। ভারতের স্টাটার্ব সংস্থা কসমস পাসওয়ার্ড-ফ্রি ই-মেল সিস্টেম তৈরি করে ফেলেছে।
নিঃশব্দ বিপ্লব
টু-ওয়ে অথেনটিক পাসওয়ার্ড ফ্রি ই-মেল। মুখের ছবি ও আঙুলের ছাপ দিয়ে ই-মেল খোলা যাবে। দুটিই ম্যাচ না করলে ই-মেল খুলবে না। এই প্রযুক্তি পাসওয়ার্ডের থেকে অনেক নিরাপদ বলে দাবি। গুগল, অ্যামাজন বা মাইক্রোসফট প্রত্যেকের প্রযুক্তি প্রায় একই রকম। বিশেষজ্ঞদের দাবি, যেকোনও পাসওয়ার্ড হ্যাকে সর্বোচ্চ ৩ মিনিট সময় লাগে। ৭০% পাসওয়ার্ড ১০ সেকেন্ডে হ্যাক করা সম্ভব। বায়োমেট্রিক পাসওয়ার্ড হ্যাক করা তুলনায় অনেক কঠিন। সাইবার সিকিউরিটি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে কাজ করা কোম্পানিগুলোর দাবি, বিশ্ব জুড়ে প্রতি মিনিটে গড়ে ৯৭১টি পাসওয়ার্ড-এর উপর অ্যাটাক হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ৩৮০টি পাসওয়ার্ড হ্যাকও হচ্ছে। বেশিরভাগ সময় গ্রাহক ঘুণাক্ষরে কিছু বুঝতে পারছে না। তথ্য-প্রযুক্তি মহলও বলছে, পাসওয়ার্ড হ্যাক করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চুরি হচ্ছে। কোটি কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে। তাই পাসওয়ার্ড যুগ থেকে বেরিয়ে অন্য জগতে পা রাখতেই হবে। ই-মেলের দুনিয়ায় এক নিঃশব্দ পথ পরিবর্তনের সময় এটা।

আরও পড়ুন-​দরিদ্র-মেধাবীদের ১৫০০ কোটির বৃত্তি রাজ্যের

ভেঙে মোর ঘরের চাবি
এখন আর গুগলের জমানায় পাসওয়ার্ড মনে রাখতে হবে না। বা পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নেওয়ার ভয় পেতে হবে না। গুগল এ ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছে। নিয়ে এসেছে পাসওয়ার্ড-এর পরিবর্তে ‘পাস কি’ যা সবচেয়ে নিরাপদ উপায়ে কোনও অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে লগ ইন করতে শেখায়। এর সাহায্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করা যাবে। ফিঙ্গার প্রিন্ট সেন্সর, ফেসিয়াল রেকগনেশন এবং স্ক্রিন লকের মাধ্যম। যাঁদের গুগল অ্যাকাউন্ট আছে তাঁরা সকলেই পাসওয়ার্ড ছাড়া লগ ইন করতে পারবেন। গুগলের এই ‘পাস কি’ পুরনো পাসওয়ার্ডের ধারণাকে আমূল বদলে দেবে। কারণ পাসওয়ার্ডের ব্যবহারকারীদের নানা ঝুঁকি সামলাতে হয়। জটিল পাসওয়ার্ড মনে রাখা যেমন কঠিন তেমনই পাসওয়ার্ড আবার বেহাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এদের তুলনায় ‘পাস কি’ অনেক বেশি সহজ ও নিরাপদ। ফলে এখন আর কোনও পাসওয়ার্ড ব্যবহারকারীকে তাঁর পোষ্যের নাম, তাঁর জন্মদিন বা বহুল ব্যবহৃত পাসওয়ার্ড ১ ২ ৩ আর ব্যবহার করতে হবে না। তবে গুগলের এই চাবি তৈরি করেছে ফিডোঅ্যালাইন্স, অ্যাপেল ও মাইক্রোসফট। ডকুসাইন, কায়াক, সফিফাই— এগুলির ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে ‘পাস কি’ চালু হয়েছে। এই ফিচার ব্যবহার করতে চাইলে ব্যবহারকারীকে g.co/passkeys সাইটে যেতে হবে। তারপর গুগল Work Spece-এ অ্যাডমিনিস্টাররা তাদের অ্যাকাউন্টে ‘পাস কি’ এনাবেল করে দেবে। তবে পাসওয়ার্ড এবং টু স্টেপ ভেরিফিকেশন অপশন এখনও থাকবে গ্রাহকদের জন্য। তবে হয়তো ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে পাসওয়ার্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

পাসওয়ার্ড যুগের অবসান
বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন অ্যাকাউন্টে পাসওয়ার্ড মনে রাখা খুবই কঠিন। কিন্তু এই কাজ করতে যাঁরা হাঁপিয়ে উঠেছেন তাঁদের জন্য রয়েছে সুখবর। মেটা, গুগল এবং অ্যাপেলের পর এবার ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজনেরও রয়েছে স্বস্তির খবর। অ্যামাজন, ব্রাউজার এবং মোবাইল শপিং অ্যাপে ‘পাস কি’ চালু হয়েছে। এখন তাঁরা অ্যামাজন সেটিংস-এ একটি ‘পাস কি’ সেট করতে পারেন এটি তাঁদের ডিভাইস আনলক করার জন্য মুখ, আঙুলের ছাপ ও পিন ব্যবহার করতে দেয়। ‘পাস কি’ লেখা বা অনুমান করা যাবে না— একটি পাসওয়ার্ডের বিপরীতে, একটি ‘পাস কি’ লেখা বা অনুমান করা যায় না। যা হ্যাকারের দ্বারা ‘পাস কি’ অনুমান করা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। সংবাদ সংস্থা আইএএনএস-এর মতে, সংস্থাটি জানিয়েছে যে, ‘যখন কোনও গ্রাহক তাঁদের ডিভাইসে ‘পাস কি’ ব্যবহার করে, এটি প্রমাণ করে যে তাদের ডিভাইস নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং তারাই কেবল এটি আনলক করতে সক্ষম। গ্রাহকদের আর অন্য পাসওয়ার্ড মনে রাখার বা নাম, জন্মদিন, ইউজারের নাম পাসওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়ে চিন্তা করতে হবে না। ‘পাস কি’গুলি পাসওয়ার্ড বা এককালীন কোডের চেয়ে বেশি সুরক্ষিত— গ্রাহকরা অ্যাপ এবং সাইটগুলিতে সাইন ইন করতে ‘পাস কি’ ব্যবহার করতে পারেন। যেভাবে তাঁরা একটি আঙুলের ছাপ, ফেস স্ক্যান বা লক স্ক্রিন পিন দিয়ে তাঁদের ডিভাইস আনলক করেন, এখানেও তাই করতে হবে। কোম্পানি জানিয়েছে যে, ‘পাস কি’গুলি টেক্সট মেসেজে পাসওয়ার্ড এবং ওয়ান-টাইম কোডের তুলনায় ফিশিং আক্রমণের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ, যা তাদের আরও নিরাপদ বিকল্প করে তোলে।

আরও পড়ুন-এআই যেন নতুন আঙ্গিকের এক কবিতা

স্বপ্ন দেখব বলে
দিনে দিনে এই ডিজিটাল যুগে পাসওয়ার্ডের গুরুত্ব ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন উপায়ের সাহায্য নিয়ে ছলচাতুরির বলে আপনার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার চেষ্টা চালাচ্ছে হ্যাকাররা।
আর সেই কারণেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাসওয়ার্ড সেট করার সময় জনপ্রিয় পাসওয়ার্ডগুলি ব্যবহার না করাই ভাল। পাসওয়ার্ডের ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেলে জীবন হবে আরও নিরাপদ। এটিএম থেকে ই-মেল প্রতিটি পদক্ষেপে রয়েছে পাসওয়ার্ড। এবার তাই পাসওয়ার্ডের ছুটি, নতুন যুগের সূচনা। আমাদের ডিজিটাল সংস্কৃতিতে শুরু হবে নতুন ঐতিহ্য। পাসওয়ার্ডহীন পৃথিবীতে আবার আমরা স্বপ্ন দেখব ডিজিটাল সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্যের। পাসওয়ার্ডহীন দুনিয়ার স্বপ্ন দেখব আমরা।

Latest article