আত্মজাগানিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ

কোনও ভেদ নেই শ্রীচৈতন্য এবং শ্রীরামকৃষ্ণে! দুর্লভ এই চেতনা ঠাকুর প্রদান করেছেন নানা সময়ে, নানাভাবে। তিনি যেন মহাপ্রভুর আলোয় আলোকিত। আশ্চর্যের বিষয় দু’জনের জন্মতারিখ একই। ১৮ ফেব্রুয়ারি। গতকাল ছিল সেই দিন। শ্রীরামকৃষ্ণের ইষ্ট-পথের সন্ধানে পূর্বা সেনগুপ্ত

Must read

নিঃস্তব্ধ জনপদ! গ্যাসের বাতির ম্লান আলোয় ছুটে চলেছে ঘোড়ার গাড়ি! বাইরে অমলিন জ্যোৎস্নাস্নাত পৃথিবী আর গাড়ির অভ্যন্তরে এক ব্যক্তির অমলিন পূতচরিত্র মাধুরী, সহাস্যবদন জ্যোৎস্নার মতোই নির্মল! চোখের কোণে তাঁর হাসি, কিন্তু চোখ দুটি কোন অজানা লোকে বিহরমান! সুন্দর রক্তাভ ঠোঁট দুটি ঈষৎ কম্পিত, অমৃত বিতরণের জন্য উন্মুখ! মানুষটি অমৃতলোকের থেকে হঠাৎ–ই খসে পড়া এক উজ্জ্বল নক্ষত্র! তাঁর অন্তরের কিছুটা এ-জগতে কিছুটা আজানা-জগতে! গাড়ি ছুটে চলেছে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাড়ির দিকে! রানি রাসমণি নির্মিত দেবালয়ের বাসিন্দা ইনি! রানিমার সাধের দেবী ভবতারিণীর পুজারি ‘ছোট ভটচায’।

আরও পড়ুন-চৈতন্যের আলো

অনন্তলোকে বিচরণশীল এক কালীসাধক! রূপের সঙ্গে নিরাকারের সাধনায় সমভাবে পটু! ব্রাহ্মণের চাল-কলা-বাঁধা পেশা ত্যাগ করে তিনি বিচিত্র সাধনে তৎপর! দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীতে খুলেছেন এক আধ্যাত্মিক গবেষণাগার! সেই গবেষণায় জগতের প্রতিটি ধর্মমত, ধর্মপথ, ধর্মীয় আচার পরীক্ষিত, সাধিত হয়েছে! সাধনা সম্পন্ন করে পৃথিবীর কাছে তুলে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত বাক্য! ‘মত-ই পথ’— ‘যত মত তত পথ’। গদাধর চট্টোপাধ্যায় থেকে প্রকাশিত হয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস রূপে। ভক্তদের কাছে তিনি অতি আদরের ঠাকুর। তিনি ভক্ত বৎসল, ভক্তবিলাসী! ভাগবত, ভক্ত, আর ভগবান— তিনে এক একে তিন!— এই তাঁর উপলব্ধি!

আরও পড়ুন-শৈবতীর্থ তারকেশ্বরে শিবরাত্রির পুজো দিলেন দূরদূরান্তের মানুষ

নগর কলকাতার চারদিকে তখন নানা ধর্মীয় ভাবনার উত্থান, আলোচনা, তর্ক–বিতর্ক, সভা–সমিতির আয়োজন। চিরায়ত ধর্ম কি আমাদের সত্যই ধারক হয়ে ছিল, নাকি আবহমান কাল থেকে প্রচলিত বিশ্বাস একেবারেই যুক্তিহীন! ঈশ্বর কি প্রতীকে আবদ্ধ? না কি তিনি রূপহীন, অসীম, অনন্ত গগনবিহারী এক অস্তিত্ব! এই দ্বন্দ্বসংকুল বাতাবরণের মধ্যে, নগরের প্রান্তে, সুরধুনীর তীরে দেবালয় প্রাঙ্গণে এক সাধক তীব্র সাধনায় মগ্ন! দিন শেষ হয়, কান্নায় ফেটে পড়েন সাধক! ‘মা একটা দিন শেষ হয়ে গেল, তবু তুই দেখা দিলিনি?’ মাটিতে মুখ ঘষে চলেন! লোকে ভাবে, ‘আহা রে, এর বোধহয় সদ্য মাতৃবিয়োগ হয়েছে!’ কিন্তু এই মা যে যোগ-বিয়োগের পার! তিনি সংযুক্ত রয়েছেন হৃদয়ে হৃদয়ে! অজানা–আপনলোকে! এই অজানা অনাগতের প্রতি এইরূপ তীব্র আকাঙ্ক্ষা কোন সাধারণের পক্ষে সম্ভব? কোলাহলমুখর নগর-ব্যস্ততায় আবর্তিত! সকলেই নিজের কাজে মগ্ন, এটা করতে হবে, সেটা করা চাই! কারও কি খেয়াল পড়ে জীবিতকালের দিনগুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে? এই জাগ্রত বিবেক নিয়ে, জাগ্রত চেতনার অধিকারী হয়ে বাঁচে ক’জন? গুটি কয়েক! যাঁদের উদ্দেশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ‘মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য, ঈশ্বর লাভ, ঈশ্বর লাভ, ঈশ্বর লাভ!’ ‘বিশ্বাস কর, ঈশ্বর আছেন, মাইরি বলছি!’ ‘এই যেমন তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, ঠিক তেমন করে তাঁকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়!’ কিন্তু এত শুনেও বিশ্বাস আসে কই! এই বিশ্বাস বৃদ্ধির জন্যই আত্ম-জাগানিয়া সংগীত হয় ভগবানের কণ্ঠে! ‘কি আর বলি, তোমাদের চৈতন্য হোক!’ কল্পতরুর দিন কাশীপুরে চৈতন্য হওয়ার আশীর্বাদ প্রদানের আগেও শ্রীরামকৃষ্ণ বেশ কিছুবার এই আশীর্বাদবাক্য উচ্চারণ করেছেন। এই আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো নিজের ঈশ্বরত্বও প্রকাশ করেছেন বহুবার।

আরও পড়ুন-বিএসএফের গুলিতে মৃত্যু

মধ্য-কলকাতার কলুটোলায় একটি বৈষ্ণবদের ‘শ্রীচৈতন্যসভা’ বা ‘হরিসভা’ছিল। একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ ভাগনে হৃদয়কে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেই সভায়! সভায় যে ভক্তগণ উপস্থিত হতেন তাঁরা নিজেদের মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের একান্ত ভক্তরূপে জানতেন। তাই তাঁরা সভাকক্ষে শ্রীচৈতন্যের জন্য বিশেষ একটি আসন পেতে রাখতেন। ঐ আসন ‘শ্রীচৈতন্যের আসন’ বলে চিহ্নিত হত। সেই আসনে কাউকে বসতে দেওয়া হত না। মনের ভাব— আমাদের পাঠ-সংকীর্তনে স্বয়ং প্রভু অংশগ্রহণ করছেন। তাঁকে চর্ম-চক্ষুতে দেখা না গেলেও তিনি আছেন। মহাপ্রভুর উপস্থিতিতে একান্ত বিশ্বাসী ছিলেন হরিসভার ভক্তকুল। সভার মুখ্য বিষয় হল হরিনাম সংকীর্তন ও ভাগবত পাঠ! ঠাকুর যখন উপস্থিত হলেন তখন ভাগবতপাঠ চলছে। উপস্থিত সকলে একাগ্রমনে সেই সুমধুর আলোচনা শুনে চলেছেন। ঠাকুরও এই সময়ে প্রবেশ করে সমবেত শ্রোতার সঙ্গে বসে নীরবে ভাগবতপাঠ শুনতে লাগলেন। ভক্তগণ মহাপ্রভুর সম্মুখেই রয়েছেন এইভাবে ‘শ্রীচৈতন্যর আসনে’র সম্মুখে পাঠ-পুজো করতে লাগলেন। সকলেই সেই আসন প্রণাম করে সভায় অংশগ্রহণ করছেন। এদিকে ভাগবতের অনুপম কথা শুনতে শুনতে শ্রীরামকৃষ্ণ বিহ্বল হয়ে গেলেন! এরপরেই হঠাৎ সকলকে অবাক করে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং ভাবস্থ হয়ে চৈতন্য-আসনের দিকে ছুটে চললেন। অবশেষে সেই আসনের উপর দাঁড়িয়ে সমাধিমগ্ন হলেন। তাঁর জ্যোতির্ময় মুখ ও প্রেমে পূর্ণ হাসি, উত্তোলিত দুই বাহু দেখে সকলের মনে হল, ইনিই চৈতন্যদেব! সকলে উচ্চস্বরে হরিনাম করতে লাগলেন। হরিনাম শ্রবণ করতে করতে কিছুক্ষণ পর বাহ্যজ্ঞান হলে শ্রীরামকৃষ্ণও ভক্তসঙ্গে কীর্তনে মাতলেন। এইভাবে মহাপ্রভু ও হরিনাম সংকীর্তনের পর সকলে তৃপ্ত মনে ঘরে ফিরলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রেমমুখ ও কীর্তনান্দে মাতোয়ারা রূপ দেখে সকলেই প্রাণে-প্রাণে অনুভব করলেন ইনি মহাপ্রভুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন।

আরও পড়ুন-ইংল্যান্ডের কাছে হার ভারতের

শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্যে কোনও ভেদ নেই! দুর্লভ এই চেতনা ঠাকুর প্রদান করেছেন নানা সময়, নানাভাবে। যাঁরা সেই চেতনা লাভ করেছেন তাঁরা ভাগ্যবান। যাঁরা লাভ করেছেন তাঁরা অনায়াসে পেয়েছেন, সেই কৃপাদানের কোনও শর্ত ছিল না। গিরিশ ঘোষের নাট্যালয়ে ‘শ্রীচৈতন্য’ জীবনী অভিনীত হবে। মূল চরিত্রে নটী বিনোদিনী । ঠাকুর নাটক দেখেছেন এবং তার সঙ্গে নটীকে দেখে বলেছেন, ‘আসল–নকল’ এক দেখলুম। এখানেই শেষ নয়, তিনি তৎকালের সমাজে অপাঙক্তেয় বারবনিতাকে আশীর্ব্বাদ করলেন ‘তোমার চৈতন্য হোক’ বলে। শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনে কাশীপুরের বাগানবাড়িতে সেই গঙ্গাসংলগ্ন শহরতলির ঝিম-ধরা বিকেলের আলোয় চৈতন্য দানের আশীর্বাদ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তিনি এর আগেও বহুবার বহুভাবে মানুষের চৈতন্যলাভের কামনায় আশীর্বাদ উচ্চারণ করেছেন। বহুবারই তিনি আত্মপরিচয় ঘোষণা করেছেন বহু ভাবে। তিনি নিশ্চিত নিত্য–কল্পতরু! এই ১ জানুয়ারির আশীর্বাদ কি তবে কোনও বিশিষ্টতা দাবি করতে পারে না? নিশ্চিয়ই পারে! কারণ, এই সময়ই তিনি বহুজনকে, নিজের গৃহী-পার্ষদদের সমবেতভাবে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক— উভয় চাহিদাই তৎক্ষণাৎ পূর্ণ করেছিলেন। কাশীপুরে এই দিনই তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন বা ‘হাটে হাঁড়ি ভাঙলেন’— যে রাম, যে কৃষ্ণ— ইদানীং তিনিই শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর অবতার রূপটি ছদ্মবেশী রাজার মতো হেঁয়ালি ছিল এতকাল, সেদিন তা স্পষ্ট হয়েছিল আর তার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল জগতের উদ্দেশ্যে মহানবার্তা ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। তিনি ছিলেন চৈতন্য–জাগানিয়া ফকির–বাউল–সন্ন্যাসী! যিনি শুকনো সন্ন্যাসীর রূপ ত্যাগ করে হয়েছিলেন প্রেমস্বরূপ ভক্তদরদি! তিনি রসের ঈশ্বরকে বশ করেছিলেন, থেকেছিলেন রসে-বশে! লোচনদাস ‘গৌর পদাবলী’তে বাস্তবিকই বলেছেন, ‘আর এক নাগরী বলে, এ দেশে না রবো।

আরও পড়ুন-সাগরদিঘি তৃণমূলেরই : ফিরহাদ

রসের মালা গলায় দিয়ে দেশান্তরী হবো।
এ দেশে কবাট দিলে সে দেশে তো পাই।
বাহির গাঁয়ে কাজ নাই সই ভিতর গাঁয়ে যাই।।’
তিনি দুই দেশের মধ্যেখানে ‘ভাবমুখে’ রয়েছিলেন। এ-দেশ ও-দেশ— দু-দেশেই ছিল অনায়াস বিচরণ! ভিতর গাঁয়ের খবর তিনিই এনে দিয়েছেন নগর কলকাতার ব্যস্ত মানুষদের কাছে। উৎসবমুখর জনপদ জেনেছিল আরেকটি দেশ আছে, আর তা আছে আমাদের অন্তরে, একান্তে ডুব দিয়ে তাঁকে লাভ করতে হয়। যে রূপসাগরের আহ্বান তিনি দিয়েছিলেন সেই সাগরে যাওয়ার পথই শ্রীরামকৃষ্ণের ইষ্ট-পথ! নতুন বছরের শুভক্ষণে সেই পথে যাত্রার আহ্বানই তিনি করেছেন।

Latest article