বাবাসাহেব আগেই বলেছিলেন

ক'দিন আগেই দেশ জুড়ে পালিত হয়েছে আম্বেদকর জয়ন্তী। সেই আবহে, ভারতীয় সংবিধানের রূপকারের হুঁশিয়ারির বিষয়ে মনে করিয়ে দিলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

গত ১৪ এপ্রিল আসমুদ্রহিমাচলে পালিত হল বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের ১৩২ তম জন্মজয়ন্তী। বাবাসাহেবের অবদান কেবল সংবিধানের খসড়া নির্মাণে তাঁর দুর্দান্ত ভূমিকায় সীমায়িত নয়, ভারতকে এক প্রাণবন্ত চনমনে গণতন্ত্র তৈরিতে সাহায্যের ব্যাপারেও তাঁর অবদান অতুলনীয়।
সংবিধানের খসড়া তৈরির যাত্রাপথ ছিল ১১ মাস ১৭ দিনের। সেই খসড়া কমিটির প্রারম্ভিক ভাষণ আম্বেদকর দিয়েছিলেন ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৬-এ। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‍‘আমাদের অন্তিম ভবিষ্যৎ (ultimate future) নিয়ে আমাদের অসুবিধা নেই। আমাদের অসুবিধা হল কীভাবে এই অসমসত্ব (heterogenous) জনগণ কোনও বিষয়ে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আর ঐক্যের পথে এগিয়ে চলবে।’ তাঁর পরামর্শ ছেড়ে, স্লোগানবাজি পরিহার করে, ভীত প্রদর্শনকারী কথাবার্তা ছেড়ে আমরা বিরুদ্ধবাদীদের বিষয়েও সহিষ্ণু হই, তারা যাতে আমাদের সঙ্গে ঐক্যের পথে সহযাত্রী হয়, সেইমতো ব্যবস্থা নিই। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের বিষয়ে তিনি এডমুন্ড ব্রুককে উদ্ধৃত করে বলেন, বলপ্রয়োগে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে কোনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। একবার বল প্রয়োগ তা ভবিষ্যতেও প্রয়োগ করার প্রয়োজন পড়বে। আর যে জাতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে জয় করতে হয় সেই জাতিকে শাসন করা যায় না (… a nation is not governmed which is perpetually to be conquered)।

আরও পড়ুন-নববর্ষে সরগরম বইপাড়া

তিনি সেদিনই সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই গুরুগম্ভীর দর্শনকে উপেক্ষা করলে আমাদের ভুগতেই হবে। স্পষ্টতর ভাষাতে সেদিনই তিনি জানিয়ে দেন, যদি কেউ ভেবে থাকে বল প্রয়োগ করে মুসলমানকে দমিয়ে রাখা যাবে, তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দিয়ে সংবিধান মানানো যাবে, তবে সে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে যুদ্ধ করে মুসলমানদের জয় করার কথা ভাবছে।

আরও পড়ুন-ফুল পাখি প্রজাপতি বন্ধু, গাছবাড়ি দেবে শীতল আশ্রয়, বজবজে প্রকৃতির পাঠশালা

২৫ নভেম্বর, ১৯৫০-এ সংবিধানের খসড়া গ্রহণের লগ্নে তিনি বলেন, ‍‘আমরা একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রস্তুত করেছি, কিন্তু গণতন্ত্রের কার্যকারিতা যারা সংবিধানটি নিয়ে কাজ করবে তাদের পরমত সহিষ্ণুতার ওপর নির্ভরশীল, তাদের আপস সমঝোতার ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা ছিল তাঁর। তাই সতর্ক করেছিলেন একথা বলে যে, হয়ত ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের কাঠামোটা বহাল রইল কিন্তু আসলে একনায়কতন্ত্র দেখা দিল। ‍‘It is quite possible for this new born democracy to retain its form but give place to dictatorship in fact.’ ধস যদি দ্বিতীয়বার নামে তবে বিপদের আশঙ্কা যেমন বেশি থাকে, ঠিক তেমনই যদি ভারত দ্বিতীয়বারের জন্য গণতন্ত্র হারায় তবে আগের তুলনায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

আরও পড়ুন-বহু মানুষের অপেক্ষা, গরমে হয়রানি, বিতর্কে জনরাজভবন ব্রাত্য রইলেন জনতাই

আম্বেদকরের বক্তব ছিল পরিষ্কার। স্বাধীনতা-উত্তর সংবিধান শাসিত ভারতবষর্ষে সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষার উপায় হিসেবে তিনি প্রথমেই সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে একদিকে যেমন রক্তক্ষয়ী বিপ্লবাত্মক পথ পরিহারের কথা বলেছেন, অন্যদিকে তেমনই আইন অমান্য, সত্যাগ্রহ কিংবা অসহযোগ আন্দোলনের মতো উপায় অবলম্বন করতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ, তিনি মনে করতেন, সংবিধানসম্মত উপায়ে আর্থ-সামাজিক দাবিদাওয়া না মিটলে তবেই লোকে অসাংবিধান পন্থা অবলম্বনের যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। আর তখনই গণতন্ত্র ভেঙে পড়ে।

আরও পড়ুন-মেহুল প্রত্যর্পণে বড় ধাক্কা খেল কেন্দ্র, সিবিআই, ইডির ব্যর্থতা

আম্বেদকর সাংবিধানিক গণতন্ত্র রক্ষার্থে আরও একটি বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেছেন। ব্যক্তি যত সৎ, যত বড় দেশপ্রেমিক, যত মহাত্মাই হোন না কেন, তাঁর প্রতি মুগ্ধতা কিংবা আনুগত্যের নিদর্শনস্বরূপ তাঁর পাদপদ্মে গণতন্ত্রের ফলে লব্ধ স্বাধীনতা সমর্পণ করা অযৌক্তিক। তাঁর ভাষায়, ‍‘There is nothing wrong in being grateful to greatmen… But there are limits to gratefulness.’
ভারতে ভক্তিপ্রাবল্যে হুড়োহুড়ি আর বীরপুজো ঘিরে বাড়াবাড়ি কোনও নতুন বিষয় নয়। আম্বেদকর মনে করতেন, আধ্যাত্মিক জীবনে ভক্তিমার্গের তাৎপর্য মোক্ষলাভের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে ভক্তিমার্গ অবলম্বন কিংবা বীরপূজা নিছক পাগলামি, যা আদতে রাজনৈতিক জীবন উন্নততর করার পরিবর্তে আরও অবনত করে তোলে এবং স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে।

আরও পড়ুন-বহু মানুষের অপেক্ষা, গরমে হয়রানি, বিতর্কে জনরাজভবন ব্রাত্য রইলেন জনতাই

নিছক রাজনৈতিক গণতন্ত্রে আস্থা ছিল না বাবাসাহেব আম্বেদকরের। তিনি এর বদলে সামাজিক গণতন্ত্রের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, জীবনচর্যায় স্বাধীনতা, সাম্য আর সৌভ্রাতৃত্বের শিকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হলে, গণতন্ত্রের ভিত মজবুত হয়।
তিনি জানতেন, জাতিভেদ প্রথা শাসিত ভারতবর্ষে সৌভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলা সহজ নয়। জাতিতে জাতিতে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে রেষারেষী থাকবেই। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর ভারতীয়দের কাঁধে যে গুরুদায়িত্ব চেপেছে, সেটার কারণেই বিভেদযুক্ত সমাজে বিদ্বেষবিষ নাশ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। আজকের ভারতে আম্বেদকরের এই সতর্কতামূলক বাণীগুলো বিস্মৃত হলে আমরা আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার সুবাসটাই হারিয়ে ফেলব, এ-কথা ভুললে চলবে না।

Latest article