দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো শেষ। এই ক’দিন ফুরসত মেলেনি একফোঁটা। চলেছে একটানা রাত জাগা, অনিয়ম, দেদার খানাপিনা। মেগা পুজোর পর বিসর্জনের বাজনা বাজতে না বাজতে তড়িঘড়ি লক্ষ্মীপুজোও হাজির। সব মিলিয়ে এতদিন শুধু রসেবশে ছিলেন বাঙালি। সকালে লুচি তো দুপুরে পোলাও-মাটন কিংবা বিরিয়ানি, আবার রাতে ফিশফ্রাই, কাটলেট। সেই সঙ্গে বিজয়ার মিষ্টিমুখ। আর উপোস-কাপাস একটানা খালিপেট, শেষে পেট ভরে খিচুড়ি বা লুচি, সুজি, পায়েস খাওয়া। নিয়মের একেবারে যাকে বলে দফারফা। এই ক’দিনে কম করে তিন থেকে চার কেজি ওজন তো বেড়েছেই। তেল, মশলাদার খাবারে বেড়েছে পেট এবং জমেছে টক্সিন। চোখের কোলে কালির পরত, মুখে-চোখে ক্লান্তির ছাপ। মুটিয়ে যাওয়া চেহারা। কমিয়ে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। উৎসব তো আসে-যায় কিন্তু এর মাঝেই আমাদের দৈনন্দিন রুটিনগুলোকে সব ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। তাহলে এবার কী করণীয়।
আরও পড়ুন-জাতীয় অ্যাক্রোবেটিক ৭ পদক পূর্বস্থলীর ছেলেমেয়েদের
আসলে আমরা যখন ভূরিভোজ খাই বা অনিয়মের খাবারগুলো রসিয়ে খাই তখন পাকস্থলীতে গিয়ে সেই খাদ্য সঠিক পরিপাক হয় না। একটু বিশদে বললে আমাদের শরীরে অন্নবহ স্রোত যা কিনা অন্নকে বয়ে নিয়ে এবং পুরীষবহ স্রোত যা মল বয়ে নিয়ে যায়— এই দুটোকে মিলিয়ে তৈরি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেম বা জি-আই সিস্টেম। এই জিআই সিস্টেমের যে অংশে খাবারগুলো পাক হয় সেটা হল পাকস্থলী বা স্টমাক। আর যেখানে আমাদের খাদ্য মেটাবলিজম হয় সেটা হল মুলত লিভার বা যকৃৎ আর গ্রহণী বা ডিওডিনাম। সেই স্টমাক বা পাকস্থলিতে কিন্তু এই ক’দিন খাদ্য ঠিকমতো পরিপাক হয়নি। কিছুটা হয়েছে, আর বেশিরভাগটাই অপক্ক অন্নরস তৈরি হয়ে সিস্টেমে থেকে গেছে, অর্থাৎ পাক না হওয়া খাবার বা অর্ধপক্ব খাবার যাকে আন ডাইজেস্টেড ফুড মেটিরিয়াল বা কাইল বলা হয় তা তৈরি হয়েছে। এই কাইল যখন তৈরি হয় সেই মুহূর্তেই কোনও বড় সমস্যা আনে না কিন্তু পরবর্তীতে এর থেকেই শুরু হয় ক্রনিক আমাশা, গ্যাস্ট্রাইটিস, পেটফাঁপা, ম্যাল অ্যাবজর্বশন সিনড্রোম, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম ইত্যাদি সমস্যা। তাই অনেকেরই দেখা যায় পুজোর পরে পেট ঠিক নেই বা শরীর খারাপ। কারণ শরীরের ভিতরে নানাধরনের সমস্যা শুরু হয়।
আরও পড়ুন-পাটাপুজো করে রাস উৎসবের ঢাকে কাঠি পূর্বস্থলীতে
পুজোর সময় বেশিরভাগই দিন-রাত এক করে ঠাকুর দেখেন প্রত্যেকে, আর সঙ্গে চলতে থাকে ভূরিভোজ। কখনও আবার দুটো খাবারের মাঝে অনেকটা গ্যাপও পড়ে। খেতেই ভুলে যান অনেকে। যখন খাবার কথা মনে পড়ে তখন দেখা গেল ঘড়িতে হয় বিকেল পাঁচটা না হয় রাত একটা। আর পুজোগন্ডার দিনে ফুড অপশন মানেই তেল-মশলাদার চর্বিযুক্ত খাবার, জাঙ্ক ফুড, কোল্ড ড্রিঙ্ক, আইসক্রিম। একটা সুন্দর উৎসবের অজুহাতে স্বাস্থ্যের কথা ভুলে যান। ফলে যা হওয়ার তাই হয়।
পুজোর সময় একটানা অত পরিমাণে গুরুপাক খাবার হজম করবার মতো অগ্নিবল বা জঠরাগ্নি বা পাকশক্তি আমাদের থাকে না অথচ শরীরকে আমরা চাপিয়ে দিতে থাকি মনের সুখে। ফলে ম্যাল ডাইজেস্টেড ফুডপ্রডাক্ট তৈরি হয়। যেটা জমতে জমতে কয়েকদিন পরে তার রি-অ্যাকশন শুরু হয়। অপক্ক অন্নরস বা আম তৈরি হয়। এই অন্নরস বিভিন্ন জটিল রোগ শরীরে ডেকে নিয়ে আসে। কাজেই প্রথমেই দরকার এই অপক্ব অন্নরসকে পাক করা। তাই এখন থেকে হালকা, সুপাচ্য লঘু খাবার খাওয়া শুরু করুন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে গড়া পুরুলিয়া মেডিক্যালে বাড়ল পরিষেবা
আলাদা করে কষ্টসাধ্য ডায়েটের প্রয়োজন নেই। এখন প্রচুর জল খান কারণ সিজন চেঞ্জ হতে শুরু করেছে। এই সময় একে শরীর ডি-হাইড্রেটেড হয়ে আছে। জল না খেলে আরও বাড়বে। যেটাই খাচ্ছেন অল্প করে বারবার খান, এতে শরীর হালকা থাকবে। দুপুরে ভাতপাতে সিম্পল শুক্তো রাখুন। বিয়েবাড়ির মতো শুক্তো নয়, বাড়ির মতো। সজনেডাঁটা, সয়াবিন, পেঁপে, গাজর দিয়ে জিরে-ঝোল খেতে পারেন, পেট ঠান্ডা হবে, খুব উপকার পাবেন। পেঁপে-কুমড়োর তরকারি বা হালকা ফোড়ন দিয়ে পাঁচমিশালি তরকারি। ছোট মাছের কালোজিরে ঝোল। পাঁচফোড়ন দিয়ে পাতলা মুসুর ডাল বা মসুর ডাল সেদ্ধ, মুগ ডাল সেদ্ধ ইত্যাদি খান দুপুরে। আর বিরিয়ানি পোলাও নয়, এবার সাদা ভাত খান। কাঁচাপোস্ত বাটা খান, পেট ঠান্ডা হবে। সময় সাশ্রয় করতে হলে ডাল-চাল হালকা ফুটিয়ে পেঁয়াজ, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে পাতলা খিচুড়ি করে খান। এর সঙ্গে দুপুরে ঘুমোবেন না। দুপুরে ঘুমোলে শ্লেষ্মার প্রকোপ হয়। রাতে ঠিক সময়মতো শুতে যান।
আরও পড়ুন-উত্তর কাশ্মীরে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত পুলিশ, তিন দিনের মধ্যে তৃতীয় টার্গেট হামলা
পাতলা চায়ের লিকার চিনি ছাড়া খান। বিস্কুটটা বাদ দিন। মিষ্টি এখন আর একেবারেই নয়। বিশেষ করে কড়া ভাজা মিষ্টি খাবেন না। ছানার মিষ্টি খাওয়া যেতে পারে। শুধু হালকা পাতলা খাবারই খেতে হবে, সেই সঙ্গে একবেলা করে উপোস দিলে মন্দ হবে না। উপোস করলে জল খেয়ে যেতে হবে। তাতে ক্যালরি ব্যালান্স হয়ে যাবে।
সকালে আবার ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ, হাঁটা, জগিং, দৌড়নো, সাইকেলিং শুরু করুন। এইভাবে ধীরে ধীরে অনিয়ম থেকে নিয়মে ফিরতে হবে।
যাঁদের ইতিমধ্যেই পেট ঠিক নেই, শরীরে সমস্যা শুরু হয়েছে তাঁরা পরিপাক ক্রিয়াকে ঠিক করতে হরীতকী, সৈন্ধব, শ্যুঁট, জোয়ান সমপরিমাণে অর্থাৎ দশ গ্রাম করে মিশিয়ে একসঙ্গে গুঁড়ো করে রোজ দেড় থেকে দু’গ্রাম গরম জলে মিশিয়ে দুপুরে ও রাতে খান। এতে টক্সিন ক্লিয়ার হবে। গ্যাসের সমস্যা কমবে, অপক্ব অন্নরস পাক হবে, ওজন কমবে শরীরটা অনেক ঝরঝরে হবে।
আরও পড়ুন-৪ সপ্তাহের জন্য অন্তর্বর্তী জামিন চন্দ্রবাবু নাইডুর
গোলমরিচ, শুকনো আদা বা শুঁঠ, বমানি, পিপুল সব সম পরিমাণে বা একগ্রাম করে নিয়ে গরম জলে দিয়ে খাবার পরে খেলে মুখের হারানো রুচি ফিরবে এবং গ্যাস ফর্মেশন হবে না, শরীরের টক্সিন অনেকটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
ডালিমের খোসার গুঁড়ো, সৈন্ধব লবণ, জিরে গুঁড়ো, শুঁট মিশিয়ে সকালে রাতে খাবার আগে দু’বার খেলে বদহজম, পেট ফেঁপে থাকলে রোধ হবে।
লিভারের সমস্যা রয়েছে যাঁদের বা ফ্যাটি লিভার আছে, পুজোয় প্রচুর অনিয়ম করেছেন তাঁরা কালমেঘের বড়ি একটা করে খালিপেটে রোজ খাওয়া শুরু করুন।
আরও পড়ুন-কেরালার ধারাবাহিক বিস্ফোরণের অভিযুক্তর ২৯শে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেফাজত
অনেকেই প্রচুর উল্টোপাল্টা খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। তাঁরা জগিং, হরীতকীর গুঁড়ো এক চামচ গরম জলে বা ইসবগুল এক চামচ জলে গুলে রাতে শোয়ার আগে খেতে পারেন।
দুর্গাপুজো এবার ছিল অক্টোবরের শেষে। শহরে না হলেও শহরতলি বা গ্রামে হালকা ওয়েদার চেঞ্জ ধরা পড়ছে। মাথায় হিম পড়েছে অনেকেরই কিন্তু টানা ঘোরাঘুরি, আইসক্রিম, কোল্ডড্রিঙ্ক খাওয়ার ফলে বেশ সর্দি- কাশি ধরে গেছে তাই এখন পিপুলচূর্ণ খান রোজ গরম জলে এক চামচ।
তুলসীর রস খাওয়া যেতে পারে।