সংসদ হোক বা বসতি, জনতার বিরোধিতা গুঁড়িয়ে দেবে বুলডোজার

অতঃপর বুলডোজার আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরম ও পরম অস্ত্র হয়ে উঠল। বিরোরোধিতার আঁচ পেলেই বুলডোজার নামিয়ে গুঁড়িয়ে দাও। সংখ্যালঘুদের বসতি হোক বা সরকারের বিরোধী পক্ষ, সবার জন্য ওই একই ডোজ। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু

Must read

হ্যাঁ, সংসদেও বুলডোজার! না, সংসদ চত্বরে ও তার চারপাশে নতুন সংসদভবনের নির্মাণকাজে বুলডোজার ব্যবহারের কথা বলছি না। বলছি, সংসদের অধিবেশন চলাকালীন ‘বুলডোজার’-নীতি প্রয়োগের কথা। এই যন্ত্রটি ইমারত থেকে সাধারণ ঘর-বাড়ি বা বস্তির ঝুপড়ি উচ্ছেদে ব্যবহার হয়। তাই বুলডোজার এক ভীতিজনক যন্ত্র। যা মানুষকে আতঙ্কে নিমজ্জিত করে। ঠিক একই উপায়ে দেশের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে বিরোধীরা যাতে সরকারি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারে, তার জন্য চালু হয়েছে সাংসদদের সাসপেন্ড করার বুলডোজারি নীতি। বিরোধিতা চলবে না। বিরোধিতা করলে সংসদের বাইরে বের করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে মার্শালদের এবং সুরক্ষা বাহিনীকে। সেরকম পরিস্থিতি হলে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হবে গণতন্ত্রের মন্দিরের সিংহ দরজার বাইরে।

আরও পড়ুন-অরণ্যভূমিতে গড়ে উঠবে মহিলাদের নয়া জীবন-জীবিকা

বিষয়টা একটু খুলেই বলা যাক। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের অগ্নিপথ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে উত্তরপ্রদেশের আলিগড় জেলায় বেকার যুবকদের বিক্ষোভ-কর্মসূচি চলাকালীন অশান্তির বাতাবরণ তৈরি হয়। অশান্তি থামাতে শুরু হয় জেলা পুলিসের ফ্ল্যাগ মার্চ। সেখানে পুলিসের সঙ্গে ছিল চলমান বুলডোজার। জুন ২০, ২০২২-এর একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। উত্তরপ্রদেশের বুলডোজার ব্যবহারের ঘটনা মানুষের স্মৃতিতে প্রবলভাবেই উপস্থিত ছিল। যা ছিল ভীতির প্রতীক। পুলিশের ফ্ল্যাগ মার্চে বুলডোজার থাকায় সেই ভীতিই জনমানসে (পড়ুন মুসলিম যুবকের মধ্যে) প্রভাব বিস্তার করে।
এ-বিষয়ে বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমকে জানায় যে এ-ব্যাপারে তাদের কোনও ধারণা নেই। কিছু নিচুতলার ‘অত্যুৎসাহী’ পুলিশকর্মীরা এরকম করে থাকতে পারেন।

আরও পড়ুন-শিল্পপার্কে কাজ দেখলেন মন্ত্রী

একইভাবে পুলিশকর্তারা এবং বিজেপি ও সংঘ পরিবার ১২ জুন ও ১৫ জুন উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া উচ্ছেদ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলতে থাকে যে, এটা হচ্ছে একটা পাল্টা জবাব। কীসের পাল্টা? কাদের পাল্টা? বলা হয় বিজেপি মুখপাত্র নবি মহম্মদ সম্পর্কে যা বলেছেন, তার বিরুদ্ধে মুসলমানরা প্রতিবাদ করছেন। কেন তাঁরা প্রতিবাদ করবেন? অর্থাৎ সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মগুরু সম্পর্কে অপমানজনক কথা বললে, তার প্রতিবাদ করা যাবে না। তেমন ঘটলে মুসলিম বস্তি, দোকান বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হবে। দেশে যেন কোনও আইন নেই, মানুষের সাংবিধানিক অধিকার বলে কিছুর অস্তিত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করা হচ্ছে।
কোথাও কোথাও উচ্ছেদকর্ম সমাধা করার পর ‘হিন্দুত্ববাদী যোদ্ধারা’ এই বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য আনন্দে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে প্রকাশ্যে বুক বাজাচ্ছে।

আরও পড়ুন-বঙ্গোপসাগরে ফের নিম্নচাপ

ঘটনাচক্রে বিজেপি চাপে পড়ে দলের মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে নবি মহম্মদের নামে কুকথা বলার জন্য নিন্দা ও শৃঙ্খলাভঙ্গকারী হিসেবে শাস্তির ব্যবস্থা করে। অথচ উত্তরপ্রদেশ কর্তৃপক্ষ ও শাসকদল বিজেপি চিৎকার করে বলছে, উক্ত বিষয়ে মুসলিমদের প্রতিবাদ করার কোনও অধিকার নেই। সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা বিশেষ করে জনৈক মৃত্যুঞ্জয় কুমার প্রকাশ্যে বলছেন, এই ধরনের শক্তিপ্রয়োগ করা হচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ভীতি সঞ্চারের জন্য। ভয় দেখানো হচ্ছে সেইসব উদারমনস্কদের যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কথা বলে।
এই বর্বর বুলডোজার-কাণ্ড তথা মুসলিম উচ্ছেদের ঘটনায় চারদিকে সমালোচনা শুরু হয় এবং বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কোর্ট, আইন মেনে কাজ করতে বলে, ১৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের পরেও বে-আইনি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটতে থাকে।
এই বুলডোজার-কাণ্ড, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে যেভাবে ঘটেছে তা আসলে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর সংখ্যাগুরু হিন্দুত্ববাদীদের সার্বিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যেই। হিন্দুত্ববাদীরা মনে করে এদেশে সংখ্যালঘুরা নাগরিক অধিকার পাওয়ার উপযুক্ত নয়। পেলেও তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এবং এ-বিষয়ে বিজেপি বড় মাপের দ্বিচারিতা করে চলেছে। উপরে এক ধরনের কথা, নিচে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আচরণ। সংঘীরা এ-কথাই বলতে চাইছে এবং বলছে যে, দিকে দিকে শাহিনবাগ হতে দেওয়া যাবে না। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তিস্তা শেতলবাদের মতো অবস্থা হবে। হয় রাষ্ট্রদ্রোহ, নয়তো সন্ত্রাসী ষড়যন্ত্র বলে যে কোনও প্রতিবাদকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। এটাই বুলডোজার নীতি। যা কেবল ভাঙে। জোড়ে না কখনও।

আরও পড়ুন-সংগীতে নিবেদিত নির্মলা

সংসদে এই একই নীতি কার্যকর করা হচ্ছে। যার মূল কথা, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তোমরা (বিরোধীরা) সংখ্যালঘু। আমরা যা বলব, সেটা মেনে নিতে হবে। প্রতিবাদ চলবে না। শাসকের বিরুদ্ধে কোনও শব্দ প্রয়োগ করা যাবে না, তা শাসকরাই বলে দেবে। প্রতিবাদ করলে, শাসকের বেঁধে দেওয়া গণ্ডির মধ্যে না থাকলে বিরোধীদের সংসদ থেকে বহিষ্কার করা হবে। সংসদ কক্ষে প্রবেশাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। সংসদীয় রীতি-নীতির যে-যে ব্যাখ্যা বিজেপি বা সরকার পক্ষ দেবে— সেটাই মাথা পেতে মানতে হবে। কোনও বিতর্ক চলবে না। মূল্য-বৃদ্ধির মতো দেশজোড়া সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলে তা মানা হবে না। বিরোধীদের কথা গ্রাহ্য না হলে, তাঁরা সজোরে তাঁদের দাবি উত্থাপন করতে পারবে না। সরকার পক্ষের বা চেয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলেও পদে পদে বাধা। এবারের বর্ষাকালীন অধিবেশনে সাংসদদের সাসপেন্ড করার ক্ষেত্রে সংখ্যার বিচারে রেকর্ড হয়েছে। ২৭ জনকে সাসপেন্ড করা এর আগে হয়নি। এখানেও সেই সংখ্যাগুরু শাসকের চোখ-রাঙানি-বুলডোজার, সংখ্যালঘু বিরোধীপক্ষের অধিকার হরণ করছে।

আরও পড়ুন-সংগীতে নিবেদিত নির্মলা

গেরুয়া শিবিরের শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে, অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে এবং কেন্দ্রীয় এজেন্সি-সিবিআই, ইডি ইত্যাদিকে ব্যবহার করে, ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার রূপে ব্যবহারের মাধ্যমে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক সংখ্যালঘুদের বশীভূত করার যে ব্যবস্থাকে পাকা করতে চাইছে, তা সবদিক থেকেই গণতন্ত্র ও সংবিধান-বিরোধী। যা চলছে, তা মধ্যযুগীয় শাসনপ্রণালী। এর সঙ্গে আধুনিক গণতন্ত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। সংখ্যালঘুর অধিকার— সে সংসদে হোক বা সমাজে— সেটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাণ। তাকেই হত্যা করতে চাইছে গেরুয়া সরকার, সংঘপন্থী হিটলারি সরকার।

Latest article