ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই যেসব সুন্দরী রানিদের কথা আমরা জানতে পারি তাঁদের মধ্যে মারি আঁতোয়ানেত, সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চি, প্রথম এলিজাবেথ, ক্লিওপেট্রা, মেরি, নেফারতিতি প্রমূখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা সবাই এক-এক রকম ভাবে ইতিহাসের পাতা দখল করে রয়েছেন, এঁদের কৃতকর্মের কথা আমরা কম-বেশি প্রায় সবটাই জানি। প্রত্যেকেই অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। আর এঁদের রূপচর্চার পেছনে রয়েছে অনেক না-জানা রহস্য, যেগুলো সত্যিই বিস্ময়কর।
আরও পড়ুন-যে লেখিকা ম্যাজিক জানেন, জোয়্যান রোওলিং
ফ্রান্সের শেষ রানি ছিলেন মারি আঁতোয়ানেত। তাঁর পুরো নাম Maria Antonia Josepha Johanna। তিনি ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুই-এর পত্নী ছিলেন। ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২ নভেম্বর অস্ট্রিয়া ভিয়েনায় হফবুর্গ প্যালেসে জন্মগ্রহণ করেন মারি আঁতোয়ানেত। তিনি হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের শাসক সম্রাজ্ঞী মারিয়া তেরেসা এবং পবিত্র রোমান সম্রাট প্রথম ফ্রান্সিস-এর কনিষ্ঠ কন্যা।
মারি আঁতোয়ানেত ছিলেন প্রচণ্ড সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী। ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনি প্রতিদিন একটি ফেসপ্যাক ব্যবহার করতেন। সেই ফেসপ্যাকের মিশ্রণে থাকতো কনইয়াক মদ, লেবুর রস, ডিম এবং গুঁড়ো দুধ। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে রানি পায়রা সেদ্ধ করা জল দিয়ে তৈরি একটি ফেস ক্লিনার ব্যবহার করতেন। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর রানি সেটা দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতেন। এই পায়রা সেদ্ধ করা জলটা বোতলে ভরা থাকতো… আর বোতলগুলোর গায়ে যে লেভেল লাগানো থাকত, তাতে লেখা থাকত Eau Cosmetique de pigean এবং আরও লেখা থাকত যে প্রতিটি বোতলের মিশ্রণ তৈরি করতে আটটি করে পায়রা ব্যবহার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-তিন কবির গান
মারি আঁতোয়ানেত যে পোশাক একবার ব্যবহার করতেন, সেই পোশাক আর দ্বিতীয়বার তিনি পরতেন না এবং দিনে তিনবার করে তিনি পোশাক বদল করতেন। আর এভাবে পোশাকের পেছনে তিনি বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করতেন, সেটার হিসেব অনুযায়ী বর্তমান বাজারে সেই মূল্য ছিল চল্লিশ লক্ষ মার্কিন ডলার।
সেই সময় ফ্রান্সে শিরাকে নীল রঙে রাঙিয়ে তোলাটা ছিল একটা জনপ্রিয় ফ্যাশন। সেই সময় ফ্রান্সের নারীদের রোগা এবং শুকনো হওয়াটা ফ্যাশনের তালিকায় পড়ত। আর কে কত রোগা সেটা বোঝাতে তাঁরা তাঁদের নিজেদের শিরাগুলো ওকে নীল রঙের পেন্সিল দিয়ে এঁকে বোঝাত। আর এটা ছিল পুরুষদের আকৃষ্ট করার একটা দিক। মনে করা হয় যে রানি মারি আঁতোয়ানেতও এই ফ্যাশনের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। ষোড়শ লুই-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর, তিনি ফ্রান্সের কুইন কনসর্ট হন। প্রথমদিকে তিনি ফরাসিদের কাছে প্রিয় হলেও তাঁর নিজের অত্যধিক খরচ এবং বহুগামিতার জন্য পরে ফরাসিদের কাছে অপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি অলংকার, পোশাক, রূপচর্চা, জুয়া, ঘোড়দৌড়ে বাজি ইত্যাদি জিনিসের পেছনে প্রচুর ব্যয় করতেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে তাঁর জন্যই ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে ছিল এবং তারপরেই ফরাসি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল।
আরও পড়ুন-চা নিয়ে চর্চা: পেশার জায়গা দিচ্ছে টি ম্যানেজমেন্ট কোর্স
ফরাসি বিপ্লবে ষোড়শ লুই-এর শিরশ্ছেদের পর রানি মারি আঁতোয়ানেতের বিচার হয়। এবং বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাঁকে। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ১৬ অক্টোবর তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
উত্তর ইতালির সেরা সুন্দরী বলে মনে করা সিমোনেত্তা ভেসপুচ্চিকে। তিনি এতটাই সুন্দরী ছিলেন যে বত্তিচেল্লি-সহ ফ্লোরেন্সের অনেক চিত্রশিল্পীর মডেল ছিলেন তিনি। ১৪৮০-এর মাঝামাঝি সময়ে বত্তিচেল্লির আঁকা ‘দ্য বার্থ অফ ভেনাস’-এ ভেনাস রূপে আঁকা নারীই হচ্ছেন ভেসপুচ্চি। সেই সময়ে ইতালি ও নারীরা ভেসপুচ্চিকে অনুসরণ করে রূপচর্চা করতেন। নিজেদের মুখ অতিরিক্ত ফর্সা অর্থাৎ সাদা করার জন্য তারা মুখে জোঁক লাগিয়ে রাখতেন। এর ফলে জোঁকগুলো মুখের রক্ত শুষে নিয়ে মুখকে আরও ফ্যাকাশে করে তুলত। যারা জোঁক ব্যবহার করতেন না তাঁরা মুখে পাউরুটির টুকরোর সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ ও ভিনিগার মিশিয়ে সেই মিশ্রণটি ফ্রেশপ্যাক হিসাবে ব্যবহার করত। ভেসপুচ্চি স্বর্ণকেশী ছিলেন। সেসময় তাঁর মতন সোনালি চুল অনেক ইতালিয়ান নারীরাই চাইতেন। আর সেই কারণে তাঁরা নিজেদের চুলে নিজেদেরই মূত্র ব্যবহার করে চুলের রং হালকা করতেন। মাত্র ২২ বছর বয়সে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে এই ইতালিয়ান সুন্দরী মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-সেরা লিস্টন-কিয়ান, মঞ্চে অমর একাদশের পরিবার
রানি মেরি, যাঁকে কুইন অফ স্কটস বলা হত তিনি জন্মগতভাবে খুব একটা সুন্দরী ছিলেন না। তাঁর চিবুকটা ছুঁচলো ছিল এবং নাকটা স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা লম্বাটে ধরনের ছিল, কিন্তু যেহেতু তিনি রানি ছিলেন সে কারণে তার ধারণা ছিল মোহময়ী সুন্দরী না হলে রানি হিসেবে তাঁকে মানাবে না। আর সেই কারণেই তিনি তার চেহারাকে আকর্ষণীয় করার জন্য হোয়াইট ওয়াইনপূর্ণ বাথটবে গা ভেজাতেন। আর এই পদ্ধতিই আজকের ভাইনো থেরাপি রূপে পরিচিতি।
পোপ ষষ্ঠ আলেকজান্ডারের কন্যা ছিলেন লুক্রেজিয়া বর্জিয়া। তিনি এতটাই মোহময়ী রূপের অধিকারিণী ছিলেন যে অসংখ্য উপন্যাস, চলচ্চিত্র এবং চিত্রকর্মে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সবথেকে আকর্ষণীয় ছিল তাঁর চুল। আর সেই চুলের যত্নে তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতেন যা ছিল সময়সাপেক্ষ। বর্জিয়া জন্মগতভাবে সোনালি চুলের অধিকারিণী ছিলেন না। তবে তাঁর পছন্দের সোনালি চুল বানানোর জন্য তিনি লেবুর রস এবং একপ্রকার ক্ষার চুলে লাগাতেন। এরপর সারাদিন ধরে রৌদ্রের মধ্যে বসে সেই চুল শুকোতেন তিনি। আর এই চুলের পরিচর্যার জন্য তিনি বহু ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনাও বাতিল করে দিতেন।
আরও পড়ুন-৫ দিনের দিল্লি সফরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী
বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সেরা সুন্দরী ছিলেন সম্রাজ্ঞী জো পোরফাইরোজেটিনা। তবে শোনা যায় তিনি যখন তরুণী ছিলেন তখন নাকি তিনি ততটা আকর্ষণীয় ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি অসামান্য সুন্দরী হয়ে উঠেছিলেন। ষাট বছর বয়সেও তাকে তরুণী মনে হত। আর এই সুন্দরী হয়ে ওঠার পেছনের যে কাহিনি জানা যায়, সেটি হল ,শুধুমাত্র তার রূপচর্চার জন্যই রাজপ্রাসাদের ভেতরে আস্ত একটা কসমেটিক গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছিল। আর সেখানে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হত সেগুলো যেমন দামি ছিল ঠিক তেমনি সেখান থেকে যে প্রসাধনী সামগ্রীগুলো তৈরি করা হত সেগুলোও প্রচুর ব্যয়বহুল ছিল। আর এই প্রসাধনী সামগ্রীগুলোর ক্রেতা ছিলেন একমাত্র সম্রাজ্ঞী জো পোরফাইরোজেটিনা।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে শুভেচ্ছা বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
রূপচর্চার জন্য বিখ্যাত আরেকজন হচ্ছেন রানি প্রথম এলিজাবেথ। প্রথম এলিজাবেথের সময়ে সবথেকে জনপ্রিয় প্রসাধনী সামগ্রীটির নাম ছিল ভেনেসিয়ান সেরুজ। এই প্রসাধনীটি তৈরি হত সীসা এবং ভিনেগার মিশিয়ে। তখনকার যুগের নারীরা তাঁদেরকে আরও বেশি করে ফর্সা দেখানোর জন্য এই প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। শোনা যায় রানি এলিজাবেথ নাকি এই প্রসাধনী ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৎকালীন সমগ্র নারীকেই ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। আর তার কারণটা হচ্ছে মাত্র ২৯ বৎসর বয়সে তাঁর স্মল পক্স হয়েছিল। তার ফলে তাঁর সারা শরীরে গুটি গুটি দাগে ছেয়ে যায়। আর এই দাগকেই ঢাকার জন্য তিনি যখন লোক সম্মুখে যেতেন তখন বেশি বেশি করে এই প্রসাধনীটি ব্যবহার করতেন। এই প্রসাধনীটি তিনি এতটাই বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতেন যে মেকআপ ছাড়া তাঁকে যদি কেউ দেখতেন তা হলে চিনতে পারতেন না!
আরও পড়ুন-রাজস্থানে ভেঙে পড়ল যুদ্ধ বিমান, মৃত ২
মিশরের রানি ক্লিওপেট্রার নাম আমরা সকলেই জানি। কৃতকর্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অসামান্য রূপও সকলের চর্চার বিষয় ছিল। তাঁর রূপচর্চা পুরোটাই রাজকীয় ছিল। ক্লিওপেট্রা স্নান করতেন গাধার দুধ দিয়ে। প্রতিদিন গাধার দুধ দুইয়ে একটি বিশাল পাত্র পূর্ণ করতেন তাঁর দাস-দাসীরা। সেই দুধ যখন টকে যেত তখন রানি ক্লিওপেট্রা সেই দুধের মধ্যে নামতেন এবং সেই দুধ দিয়ে স্নান সারতেন, তিনি মনে করতেন এই টকে-যাওয়া গাধার দুধে স্নান করলে চামড়ায় ভাঁজ পড়ে না। তবে এই দুধই ক্লিওপেট্রার চামড়ার সুরক্ষার কাজে আসত। কারণ টকে-যাওয়া দুধ ধীরে ধীরে ল্যাকটিক অ্যাসিডে পরিণত হত এবং চামড়ার উপরিভাগের মরাকোষ ঝরিয়ে ফেলত এবং তার ফলে চামড়া হত কোমল ও দাগহীন। এ-ছাড়াও ক্লিওপেট্রা লাল রংয়ের লিপস্টিক লাগাতে পছন্দ করতেন। আর নিখুঁত লাল রং পাওয়ার জন্য ওর মধ্যে গুবরে পোকার অন্ত্র শুকিয়ে চূর্ণ করে নিয়ে মেশাতেন। আর এ-ছাড়াও তিনি চোখের নিচে কুমিরের শুকনো মলের চূর্ণ ব্যবহার করতেন।
আরও পড়ুন-রবীন্দ্রনাথ তপোবন শিক্ষার সঙ্গে মিশিয়ে ছিলেন পশ্চিমী শিক্ষার রঙ
মিশরের আরেক রহস্যময়ী সুন্দরী রানী ছিলেন নেফারতিতি। নেফারতিতি মানে সৌন্দর্যের আগমন। তিনি ছিলেন সত্যিই অসামান্য সুন্দরী। রূপচর্চার পেছনে অনেক অর্থ এবং সময় ব্যয় করতেন তিনি। নেফারতিতির মাথার চুলের সঙ্গে পুরো গায়ের রোম কামিয়ে ফেলেছিলেন। চুলের বদলে তিনি পরচুলা ব্যবহার করতেন। চোখে সুরমা লাগাতেন। এই সুরমা সীসার আকরিক গ্যালেনা থেকে তৈরি হত। এ-ছাড়াও তিনি যে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন তার উপাদান ছিল বিষাক্ত ব্রোমিন ম্যানাইট। মনে করা হয় এগুলোই তাঁর স্বাস্থ্যহানির জন্য দায়ী।