ভাস্কর ভট্টাচার্য: অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। বাউন্ডুলে না হলেও আমোদ ফুর্তিতেই কাটত তার সময়। বন্ধবুান্ধবদের সঙ্গে হই-হুল্লোড় সুরাপান, ক্লাব, মধ্য রাতে বাড়ি ফেরা এ সবই ছিল তার নিত্য নৈমিত্তিক অভ্যাস। বন্ধুদের কাছেও তাই সে ছিল খুবই জনপ্রিয়। দেদার খরুচে। সাধারণ মেধা নিয়ে ছোট ব্যবসা করাই ছিল তার দৈনন্দিন জীবন। সে ছিল কলেজের ড্রপ আউট বয়। কলেজের পড়া শেষ করতে পারেনি। মন চায়নি।
পড়াশোনা কেন কোনওদিনই সে অঙ্ক বা সে রকম জটিল কোনও বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায়নি। কেউ তাকে তেমন বিদ্বজ্জন বলেও মনে করতেন না। কিন্তু কোথা থেকে যেন কী হয়ে গেল। পরিশ্রমী সেই সাধারণ ব্যবসায়ী যুবকই একদিন বনে গেলেন স্বনামধন্য গণিতবিদ। যাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ল নানা দেশের প্রান্তে-প্রান্তে, তাঁকে নিয়ে রচিত হল গল্পগাথা। এমনকী ম্যাথমেটিক্যাল কনসেপ্টে তাঁর আঁকা ছবিও প্রদর্শিত হয়েছে প্রদর্শশালায়।
আরও পড়ুন-রোনাল্ডো আনফিট, ইঙ্গিত কোচের
কেউ-কেউ তাঁকে নিয়ে গবেষণাও করেছেন। পৃথিবীতে অনেক আশ্চযর্ময় ঘটনা ঘটে। অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনাও সত্য হয়ে ওঠে। তেমনই একজন পরিশ্রমী সেলসম্যানের গণিত বিশারদ হয়ে ওঠার কাহিনিটিও আজ সত্য। নিষ্ঠুর দুর্ঘটনাই তাঁকে রীতিমতো গণিতজ্ঞ করে তুলল। এও এক গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানীদের এই বিষয়টি নিয়ে চর্চার অন্ত নেই। বড় আঘাত বা বড় ধরনের কোনও স্ট্রোক বা ব্রেন ইনজুরি থেকে সেরে ওঠার পর কেউ-কেউ জিনিয়াস হয়ে উঠেছেন। যাকে বলা হয় অ্যাকোয়োড স্যাভান্ট
তাহলে একটু খুলেই বলা যাক এই গণিতবিদের কথা। সেটা ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরের এক মধ্যরাত।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে নারী নির্যাতনের নমুনা!
অন্যান্য দিনের মতোই সেই সুঠাম সুন্দর যবুক সুরাসক্ত হয়ে বের হচ্ছেন একটি রেস্তোরাঁ থেকে। আচমকা দুই আততায়ী তাঁকে লক্ষ্য করে আঘাত করল তাঁর মাথায়। সঙ্গে-সঙ্গে অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেলেন ৩১ বছরের সেই তরুণ যবুক। যখন জ্ঞান ফিরল তখন তাঁর যেন এক নতুন জন্ম হল। এই বাস্তব পৃথিবীর সব কিছুকেই দেখতে শুরু করলেন গাণিতিক ভাবে। ঘর বাড়ি, চেয়ার টেবিল, চামচ সব কিছেুতই তিনি খুঁজে পেলেন জ্যামিতিক আকার। ওই রাতের ঘটনার পর শুধু পথঘাট নয়, বাড়ির বিভিন্ন আকৃতির বস্তুগুলো তাঁর মনোযোগ আকষর্ণ করল।
তিনি যেন এক ঘোরের মধ্যে দেখতে থাকলেন সেইসব বস্তু। দরজা, জানলা, ঘরের মেঝে, বাড়ির ছাদ, দেওয়াল কিছুই বাদ গেল না। সবই তিনি আয়তাকার, বর্গক্ষেত্রাকার, ত্রিভজুাকার বা বত্তৃাকার রূপে দেখতে শুরু করলেন। এমনকী কোনও সংখ্যা দেখলেই তাঁর মানসপটে বর্ণময় রঙিন হয়ে ওঠে। তিনি এমনই এক ঘোরের মধ্যে পড়লেন যে সব কাজকর্ম মাথায় উঠল। বন্ধ করে দিলেন বাড়ির বাইরে যাওয়া। গণিত বিষয়ক যা কিছু হাতের কাছে পেতেন মন দিয়ে তা পড়ে ফেলেন। পদার্থবিদ্যার যে-কোনও বিষয়ই পড়ার জন্য মন ছটফট করত।
আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্স মোকাবিলায় টাস্কফোর্স গঠন
ভগ্নাংশ ও পাই সংক্রান্ত অঙ্কগুলো তাঁকে মোহাবিষ্ট করে রাখতই শুধু না, অন্য কোনও বিষয়েই যেন তাঁর কোনও খেয়াল নেই। তাকে আকৃষ্ট করল এক অন্য জগৎ। তিনি বুঁদ হয়ে উঠলেন সেই জগতের প্রতি। বিনা স্কেল, কাঁটাকম্পাসে আঁকতে শুরু করলেন অনেক অবিশ্বাস্য জ্যামিতিক ছবি। তিনি বোঝাতে চাইলেন তাঁর ভাষা, মনের মধ্যে জমে থাকা প্রতিভার ছবি ফুটে উঠল সেইসব জ্যামিতিক ছবির মধ্য দিয়ে। অন্য কোনও কিছুই তাঁর আর মনে পড়ে না। সাধারণ থেকে হয়ে উঠলেন অসাধারণ এক গণিতবিদ। এক সময় আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে ফিনল্যান্ডেও পাড়ি জমিয়ে ছিলেন এই গণিতের আকর্ষণেই।
আরও পড়ুন-চাপের কাছে মাথা নত নয়, ফের বললেন সঞ্জয়
বিজ্ঞানীদের পরিভাষায় মাথায় আঘাতজনিত কারণে সৃষ্ট এই রোগ বা সমস্যাটি অ্যাকোয়োড স্যাভান্ট সিনড্রোম নামে পরিচিত। অকস্মাৎ মাথায় আঘাত জনিত কারণে কোনও-কোনও মানুষ গণিত, ছবি আঁকা, সংগীতে বা অন্য কোনও বিষয়ে প্রতিভাধর হয়ে ওঠেন। এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে কম নেই। সেই তালিকায় আজ তাঁর নামও উচ্চারিত, তিনি জেসন পেজিট। ধীরে-ধীরে সস্থু হয়ে তিনি গণিতের শিক্ষকও হয়ে উঠেছেন।
এবং একই সঙ্গে ওয়াশিংটনে তিনি তিনটি দোকান চালাচ্ছেন। লিখেছেন আত্মজীবনী ‘স্টার্ক বাই জিনিয়াস’। তাঁর আঁকা ছবি আমেরিকার ফাইন আর্ট এগজিবিশনে রক্ষিত। তিনি একজন লেকচারারও, যাঁর মূল বিষয় হল ‘বিউটি অফ ম্যাথমেটিক্স’। এ যদি হয় জেসন পেজিটের কাহিনি তাহলে শোনা যাক আরেক জিনিয়াস কবি ও শিল্পী মানুষের কথা। তাঁরও ছোটবেলা কম রোমাঞ্চকর নয়।
আরও পড়ুন-সামান্য ঝাড়ুদার থেকে এসবিআইয়ের জেনারেল ম্যানেজার পদে প্রতীক্ষা
শৈশবে তিনি শুধু মাদকাসক্তই নন, তার সঙ্গে ছিল হেরোইন আসক্তিও, এবং এক অর্থে সমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন একজন ক্রিমিনাল হিসেবেও। কিন্তু জীবনের অধের্কেরও বেশি সময় পার করে ৫১ বছর বয়সে হঠাৎ তাঁর এমন বড় ধরনের স্ট্রোক হল যে তাঁর শরীরের অংশের সঙ্গে মাথার দুই অংশের ফ্রন্টাল লোব ও টেম্পোরাল লোব-এর কাযর্ক্ষমতাও গেল থেমে। যখন তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন তখন তাঁর কথা বলার শক্তি নেই, পা চলে না, খাবার কথা মনে থাকে না। কিন্তু কী করে যেন চিকিত্সায় একদিন সাড়া মিলল। তিনি ক্রমশ হাঁটতে পারলেন, কথা বলতে পারলেন, কিন্তু চিন্তা ও চেতনায় এল এক বিপুল পরিবর্তন। ড্রাগের নেশার মতোই তিনি কবিতার প্রতি নেশাসক্ত হয়ে উঠলেন। কবিতার নেশায় বুঁদ হয়ে উঠলেন। তিনি লিখছেন, আই রোট, দ্য মোর আই ওয়ান্টেড টু রাইট, ইট ওয়াজ লাইক এ ড্রাগ। শুধু কবিতার নেশাই নয়, ছবি আঁকার প্রতিও হয়ে উঠেছিল তাঁর আকণ্ঠ নেশা। দিনে প্রায় ১৯ ঘণ্টা ছবি আঁকা আর লেখালেখির মধ্য দিয়েই কাটত তাঁর। তিনি শিল্পী ও কবি টমি মুগ। তাঁকে নিয়েও চিকিত্সকদের গবেষণার অন্ত নেই। সারা পৃথিবীতে এমন প্রতিভাবানদের নিয়েই গবেষণা আজও অব্যাহত। উল্লেখ্য, গত ২০১৪ সালে এই শিল্পী কবি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।