২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। গ্রামোন্নয়নের ‘সোশ্যাল অডিটে’ সাফল্যের দিক থেকে প্রথম পাঁচে পশ্চিমবঙ্গ। তাও কেন আর্থিক বঞ্চনা? উত্তর এড়াচ্ছে মোদি সরকার। মঙ্গলবার দিল্লির জাতীয় সম্মেলনে প্রশংসিত হল বাংলা। সম্মেলন শেষে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী গিরিরাজ সিংকে প্রশংসিত বাংলার বঞ্চনা নিয়ে প্রশ্ন করতেই, সাফ জবাব এল, ‘ছাড়ুন ও সব প্রশ্ন! অন্য বিষয়ে কোনও জিজ্ঞাসা আছে কি?’
আরও পড়ুন-বক্সার জঙ্গলে পর্যটকের ক্যামেরায় ধরা পড়ল বিরল ইন্ডিয়ান ঢোলের ছবি
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। ১০০ দিনের প্রকল্পের বকেয়া, বাংলা আবাস যোজনার বকেয়া-সহ বাংলার সমস্ত বকেয়া আটকে রাখার প্রতিবাদে বাংলা থেকে ৫০ লক্ষ মানুষের ক্ষোভের চিঠি পৌঁছে গেল দিল্লিতে।
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। কুৎসিত-নির্লজ্জ-নোংরা রাজনীতি ইডির : দিল্লির কর্মসূচির দিনেই ফের তলব অভিষেককে— সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
বস্তুত, কেন্দ্রের নির্লজ্জ প্রতিহিংসার রাজনীতি সব দিক থেকেই স্পষ্ট। টাকা দেব না আবার প্রতিবাদও করতে দেব না। প্রতিবাদ করতে গেলেই প্রতিবাদের দিনই কলকাতায় আটকে রাখার জন্য নির্লজ্জ ইডি-র সমন। ইডির সমন অন্য দিনও তো দেওয়া যেত। কিন্তু তা করা যাবে না। দোহাই দেওয়া হচ্ছে আদালতের। আদালত তো ৩ তারিখে ডাকতে বলেনি! তবু ওই আন্দােলনের দিন ডাকতেই হবে। কিছুদিন আগেও ১৩ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া ব্লক কোয়ার্ডিনেশন কমিটির বৈঠক অনেক আগে ধার্য করা হলেও এবং অনেক আগে থেকে এই কমিটির সদস্য হিসাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতির আগাম নিশ্চয়তা সত্ত্বেও ওই দিনটিতে অভিষেককে ডাকা হল। কার্যত প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও তার দল।
আরও পড়ুন-পুজোর আগেই বেতন দেওয়ার উদ্যোগ রাজ্য সরকারি কর্মীদের
প্রশ্ন করুন— পশ্চিমবঙ্গের পাওনা ১০০ দিনের টাকা কেন গত প্রায় ২ বছর বন্ধ রাখা হয়েছে? উত্তর : দুর্নীতির জন্য। পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া আবাস যোজনার টাকা কেন বন্ধ করা হয়েছে? উত্তর : দুর্নীতির জন্য। প্রশ্ন করুন : কতখানি দুর্নীতি হয়েছে? কতটুকু দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে? অন্য রাজ্যে দুর্নীতির জন্য টাকা বন্ধ হয়েছে কি? উত্তর : নো কমেন্ট। অন্য রাজ্যের দুর্নীতির প্রসঙ্গে আসা যাক।
প্রধানমন্ত্রী কৃষক সম্মাননিধি, সংক্ষেপে পিএম কিসান চালু হয়েছিল ২০১৯ সালে। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টে ধরা পড়ে বিজেপি সরকার পরিচালিত অসমে ২৩ লক্ষ ৩৩ হাজার ৮৬৪ জন পিএম-কিসান প্রকল্পের আর্থিক সাহায্য পেয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে ১১.৭২ লক্ষ সুবিধাভোগী ভুয়ো। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যেই স্পষ্ট অসমে ৫০ শতাংশের বেশি ভুয়ো কৃষক পিএম-কিসানের টাকা পেয়েছে। শুধু অসমে এই প্রকল্পে দুর্নীতি ঘটেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার। এ-বিষয় নিয়ে অসমের হাইকোর্টে মামলা হলেও অসমে ‘পিএম কিসান’ প্রকল্প বন্ধ হয়নি। ২০২৩ সালেও অদ্যবধি অসমে ৮ লক্ষের বেশি কৃষক এই প্রকল্পের টাকা পেয়েছে।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে ট্রেনের সামনে ঝাঁপ মহিলার
২০২০ সালে কেন্দ্রের একই রিপোর্টে দেখা গিয়েছে বিজেপি পরিচালিত উত্তরপ্রদেশে ২১ লক্ষ ভুয়ো কৃষক পিএম কিসানের অর্থ পেয়েছে। তথাপি অদ্যবধি বিজেপি পরিচালিত উত্তরপ্রদেশে পিএম কিসান প্রকল্প বন্ধ হয়নি। এমনকী উভয় রাজ্যে সব ভুয়ো কৃষক মুক্ত করে পিএম কিসান প্রকল্প চালানো হয়নি। এখনও এই প্রকল্পে অনেক ভুয়ো কৃষক এই সুবিধা পাচ্ছে।
শুধু পিএম কিসান নয়, প্রতিটি ফ্লাগশিপ প্রকল্পে বিভিন্ন রাজ্যে দুর্নীতির বহর ভূরি ভূরি। তবে ডবল ইঞ্জিনের সরকার যে সব রাজ্যে রয়েছে সেখানে দুর্নীতির মাত্রা বেশি। সম্প্রতি অগাস্ট মাসে মধ্যপ্রদেশে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় বড় আকারের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হল। গত বছর ২২ নভেম্বর অসমেও এই প্রকল্পের বড় দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-দিল্লি থেকে বিজেপির ‘জমিদারি’ হটানোর ডাক দিলেন অভিষেক
বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বিভিন্ন ফ্লাগশিপ প্রকল্পে বড় আকারের দুর্নীতির দৃষ্টান্ত পাওয়া গেলেও সেই সব রাজ্যে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা কখনও বন্ধ হয়নি এবং সেই দুর্নীতি মুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও ধারাবাহিকভাবে কোনও প্রকল্প সেই রাজ্যগুলিতে বন্ধ হয়নি।
তাই দুর্নীতির ধুয়ো তুলে, অথচ প্রমাণ করা যায়নি, পশ্চিমবঙ্গে একাধিক প্রকল্পের টাকা কেন্দ্র কতদিন ধরে বন্ধ করে রেখেছে।
মোদি সরকার পশ্চিমবঙ্গে ১০০ দিনের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে ২০২১-’২২ অর্থবছর থেকেই। ২০২১-’২২ সালে পশ্চিমবঙ্গের জন্য এই প্রকল্পে দীর্ঘ ৭৫০০ কোটি টাকার মধ্যে এই বছর রাজ্যকে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৭৪৪ কোটি টাকা। কার্যত শুধুমাত্র গত অর্থবছরেই ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্ত্রের কাছে প্রাপ্য ৭৫০০ কোটি টাকার মধ্যে রাজ্যকে দেওয়া হয়নি ৫৭৫৬ কোটি টাকা। বর্তমান অর্থবছরেরও (২০২৩-’২৪ সালে) ৮ মাস হতে চলল একটি কানাকড়ি রাজ্যকে দেওয়া হয়নি। ফলে বর্তমান বছরের পুরো প্রাপ্য ধরলে শুধুমাত্র ১০০ দিনের প্রকল্পে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের পাওনা ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। শুধুমাত্র দুর্নীতির ধুয়ো তুলে রাজ্যকে এই টাকা দেওয়া হয়নি। অথচ দুর্নীতির কোনও তথ্যই কেন্দ্রীয় সরকার পেশ করতে পারছে না।
আরও পড়ুন-বিজেপি শাসিত অসমে বাল্যবিবাহ আইন ভাঙায় গ্রেফতার সহস্রাধিক
আবার যোজনার টাকা বন্ধ করা হয়েছে আরও অনেক আগে থেকে। গত বছর বেশ কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রের নির্দেশে এবং কেন্দ্র কর্তৃক একাধিকবার তদন্ত টিম ঝাড়াই বাছাই করার পরও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রায় ১১ লক্ষের মতো বাড়ি নির্বাচন করা সত্ত্বেও ৯ মাস হতে চলল একটি টাকাও কেন্দ্র থেকে আসেনি, অথচ রাজ্যের ভাগের অংশ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজ্যের কোষাগার থেকে বাড়তি খরচ হয়েছে। তবুও কেন্দ্র তার অংশের টাকা দিচ্ছে না। অথচ ১৬০টি কেন্দ্রীয় দল গত দেড় বছরে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পরিদর্শন করা সত্ত্বেও রাজ্যের একাধিক প্রকল্পের টাকা বহুদিন বন্ধ করে রেখেছে। রাজ্য বারবার রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। তৎসত্ত্বেও কোনও অর্থই কেন্দ্র দিচ্ছে না। কেন্দ্র দুর্নীতির কোনও প্রমাণ দিতে পারছে না, অথচ টাকা বন্ধ করে রেখেছে। কেন্দ্রের সমস্ত শর্ত মানা সত্ত্বেও কার্যত প্রতিহিংসার জন্য টাকা বন্ধ করে রেখেছে। ১০০ দিনের প্রকল্প-সহ একাধিক প্রকল্পের বহু সুবিধাভোগী বহুদিন ধরে চরম বঞ্চনার সম্মুখীন।
আরও পড়ুন-গরিবকে ভাতে মেরে প্রতিহিংসা কেন্দ্রের, দিল্লিতে এসেই প্রতিবাদ ওদের
কার্যত, কেন্দ্রের কাছে বহুবার বহুদিন ধরে বকেয়া টাকা মেটানোর দাবি জানিয়ে আসছে রাজ্য সরকার। কিন্তু কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কোনওভাবে কর্ণপাত না করায় কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে রাজ্য থেকে বাধ্য হয়ে দিল্লির রাস্তায় শামিল হতে হচ্ছে বঞ্চিতদের।
ইতিমধ্যে ৫০ লক্ষের বেশি চিঠি পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের দফতরে। দিল্লির মেগা ধরনা-কর্মসূচির জন্য আগামী ২ ও ৩ তারিখে দলের সর্বস্তরের সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রী, জেলা সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য-সহ আরও বহু মানুষ প্রতিবাদে শামিল হতে দিল্লি যাচ্ছেন। বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও বিজেপির পুলিশ দিল্লির রামলীলা ময়দান-সহ ধরনা-কর্মসূচির অনুমতি বাতিল করে দিয়েছে। দিল্লির পাশাপাশি গোটা বাংলা জুড়ে প্রতিবাদ দিবস পালন করবে দলীয় নেতৃত্ব।
আরও পড়ুন-শুরু থেকেই বাধা, বানচালের চেষ্টা, পুলিশের লাঠি, এল জলকামানও
এজেন্সি দিয়ে প্রতিবাদের আওয়াজ বন্ধ করার শত চেষ্টা সত্ত্বেও অভিষেক এজেন্সির বাধা উপেক্ষা করে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঞ্চিতদের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেনই। জানিয়েছেন জনগণের শক্তিকে স্বাগত জানাই। আমাদের হকের টাকা আদায় করতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রাজ্যের বিরুদ্ধে কেন্দ্রের অন্যায় এবং অবৈধ অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে দিল্লিতে পৌঁছবে বাংলার বঞ্চিতদের একমাত্র গর্জন ‘হকের টাকা ফেরত চাই এখনই’।