বিরোধী পক্ষ চায় না বিজেপি

বিরোধীশূন্য অগণতান্ত্রিক আবহ কায়েম করতে চাইছে বিজেপি। চক্ষুলজ্জার আগলটুকুও আর রাখছে না, নয়া ভারতের নামে বিরোধী কণ্ঠস্বরহীন একপাক্ষিক শাসনতন্ত্র কায়েম করতে চাইছে তারা। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতার মুখোশ টেনে ছিঁড়লেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

বিরোধীশূন্য সংসদ মোদি-শাহের ভারি পছন্দ। তবে বিরোধী সাংসদরা যদি দেখতে, শুনতে এবং কথা বলতে না পারেন, তবে সেরকম সাংসদদের বিরোধী আসনে দেখতে চায় বিজেপি। শুধু শাসক দল বিজেপি নয়, আশ্চর্যের কথা, লোকসভায় অধ্যক্ষ এবং রাজ্যসভায় উপরাষ্ট্রপতিও এমন প্রবণতাকেই উৎসাহিত করছেন। লক্ষ্য করার বিষয়, রাজ্যসভার মেয়াদ ফুরোতে বসল, অথচ রাজ্যসভায় কোনও ডেপুটি চেয়ার পার্সন নিয়োগের সামান্যতম চেষ্টাও করল না বিজেপি।

আরও পড়ুন-মসজিদ খালি না করলে ভয়.ঙ্কর পরিণতি! হুঁশিয়ারি বিজেপি নেতার

এই কক্ষে ধনখড় সাহেব নিশ্চিন্তে এবং নির্বিবাদে বর্তমান শাসক দলকে মদত দিয়ে গেলেন। নতুন সংসদ ভবনে সংসদ টিভিতে সম্প্রচারের ক্যামেরা কেবল শাসকদলের সাংসদদের দিকে মুখ করে বসানো হয়েছে, ফলত, যবে থেকে এই নতুন ভবনে অধিবেশন বসছে, তবে থেকে সংসদ টিভিতে কোনও বিরোধী পক্ষের সাংসদকে একবারের জন্য বক্তব্য রাখতে দেখা যায়নি। বলা বাহুল্য, শুধু রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেই এরকমটা দেখা যায়। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নয়।

আরও পড়ুন-আইনশৃঙ্খলায় দেশের নিরাপদ শহর কলকাতা

আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলগুলি ছাড়া আর কেউ মোদি শিবিরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গায় নেই। সংবাদ মাধ্যম তো সরকারের কাজকর্ম নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের কার্যকলাপ নিয়ে, ভুল নিয়ে কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করার অধিকার হারিয়েছে। তথ্যাধিকার (রাইট টু ইনফরমেশন), বিচারবিভাগ এমনকী আমলাতন্ত্রকেও দরকারে পাশে পাচ্ছেন না জনগণ। সুতরাং, জনগণের হয়ে আওয়াজ তোলার, তাদের দাবিদাওয়া তুলে ধরার, সেগুলো নিয়ে সরব হওয়ার জন্য পড়ে রইল একটাই বিকল্প তৃণমূল কংগ্রেসের মতো বিরোধী দল। নওজোয়ানদের আগামী, কৃষিজীবীদের উপার্জন, দলিতদের আত্মসম্মান, তাঁদের জমি জঙ্গল ভাষার নিরাপত্তা, এসব নিয়ে কথা বলার দায়িত্ব পুরোটাই তৃণমূল কংগ্রেসের কাঁধে। এমতাবস্থায় ১৪৬ বিরোধী সাংসদকে বহিষ্কারের ঘটনা যদি আবার ঘটে তাহলে সেটা আর যাই হোক, ভারতের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক কিছু হবে না। এটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স কিংবা রাজনীতি-বিজ্ঞান— কোনওটা জানারই দরকার নেই। ভারতের সংবিধান, ভারতে গণতন্ত্র বাঁচানোর জন্য বিরোধী পক্ষের আবশ্যকতা এর আগে এতটা অনুভূত হয়নি।

আরও পড়ুন-উত্তরের পর এবার প্রতিবাদ, দক্ষিণ ভারতে কেন্দ্রের কালা কানুন

সংসদীয় গণতন্ত্র মানে কী? খুব সোজা করে বললে, শাসন বিভাগ সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, সরকার সংসদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। এটাই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল কথা। একই সঙ্গে এটাও প্রত্যাশিত যে সাংসদরা জনগণের প্রতি, তাঁদের নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি দায়বদ্ধ থাকবেন। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আশা করা হয় যে, এবং সে আশা বহুকালাগত পরম্পরা অনুসারী, যে সংবাদমাধ্যম আর সংসদ তাল মিলিয়ে চলবে। সংসদের কথা, সংসদে ওঠা আওয়াজ, সংবাদমাধ্যমে প্রতিবিম্বিত হবে। সেসব এখন হচ্ছেটা কোথায়? আগে শুনেছিলাম এবং সেইমতো জেনেছিলাম, সংসদের কাজ মসৃণভাবে চালানোর দায় সরকারের। এখন দেখছি এবং বুঝছি, এই সরকারের সাফ কথা, বিরোধী পক্ষ যদি আমাদের অনুগমন করে, তবে সংসদ চলতে দেব। নইলে সে গুড়ে বালি। আমরাই দায়িত্ব নিয়ে সংসদ বন্ধ করে দেব। এহ বাহ্য! এই প্রথম সংসদ দেখছে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংসদের অধিবেশন এড়িয়ে চলেন। যদি প্রশ্নগুলো অনুত্তরিত থাকে, যদি কমিটিগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, যদি বিলগুলো খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ না পায় পার্লামেন্টের স্ট্যান্ডিং কমিটি কিংবা জয়েন্ট কমিটিগুলো, তবে আর সংসদীয় গণতন্ত্র বহাল রেখে লাভটা কী?

আরও পড়ুন-দু’হাজারি নোট বদল এবার পোস্ট অফিসে, জানাল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক

এই যে রামমন্দির নিয়ে রাজনৈতিক হুল্লোড়বাজির আভাস পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? এটা তাঁদের গভীর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন। কিন্তু একটা বিশেষ মন্দির কিংবা একজন বিশেষ দেবতাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পর্যায়ে একটা বিশেষ ভাবাবেগে উসকানি দেওয়া, সেটা মেনে নেওয়া যায়? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগ নিয়ে এরকম প্রয়াস কি কোনও যুক্তিনিষ্ঠ মানুষের কাছে সমর্থনযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে? কিন্তু সেটাই হচ্ছে। মোদি-শাহরা খুল্লাম খুল্লা রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দিচ্ছেন। আর এসব নিয়ে বিরোধী পক্ষ সরকারকে জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় না, কারণ সরকার পক্ষের মুখ্য নেতা প্রধানমন্ত্রী সংসদ এড়িয়ে চলেন। সুযোগ পায় না সংবাদমাধ্যমও। কারণ প্রধানমন্ত্রী গত ১০ বছরে একটাও সাংবাদিক বৈঠক করেননি।

আরও পড়ুন-মালদ্বীপ-অস্বস্তি বাড়ছে হাইকমিশনারকে তলব

রামমন্দিরের উদ্বোধন হবে ২২ জানুয়ারি। তার আগে ‘হাইপ’ তোলার জন্য বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ৪ জানুয়ারি থেকে পুজো ইত্যাদি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর যেখানে বিজেপি রাজ্য সরকারে নেই, সেখানেও চলবে এই হুল্লোড়, ভক্তিহীন আদিখ্যেতা। লক্ষ্য একটাই। ধর্মের রাজনীতিকরণ এবং সেই সূত্রে ভোট ব্যাঙ্কটাকে পুষ্ট করা।
৩৫ কোটি মানুষ, কমপক্ষে ৩৫ কোটি ভারতীয় নাগরিকের সংসদে কোনও প্রতিনিধিত্ব নেই। ন্যায় সংহিতার নামে কী রকম ক্রিমিনাল বিল পাশ হয়ে গেল বিরোধীশূন্য সংসদে। অনেক সাংসদেরই অভিযোগ, বিলের ভাষা সংস্কৃত ঘেঁষা হওয়ায় তাঁরা সেটা চট করে বুঝে উঠতে পারেননি। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের সাংসদদের ক্ষেত্রে এটা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। বিলে ১০০০টা বিধান ছিল। সেগুলো পড়ে বুঝে ওঠার সুযোগ পাননি বিরোধী সংসদরা।

আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশে হোম থেকে উধাও ২৬!

চিরকাল দেখে এসেছি বিরোধী পক্ষের সাংসদরা প্রতিবাদে গলা ফাটানোর জন্য সংসদের কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। এখন দেখছি, শাসক দলের সাংসদরা বিরোধী কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার অভিপ্রায়ে সংসদ অচল করার পন্থা নিচ্ছেন।
অন্তিমে একটা সামান্য জিজ্ঞাসা। মোদি-শাহদের উদ্দেশ্যে?
সংসদে রং বোমা কাণ্ড ঘটিয়েছে যে দুষ্কৃতীরা তারা ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু এবং তাদের প্রবেশপত্র দিয়েছিলেন একজন বিজেপি সাংসদ।
যদি এই অবাঞ্ছিত প্রবেশকারীরা ধর্ম পরিচয়ে মুসমান হতেন আর তাদের ঢোকার পাশ দিতেন কোনও বিরোধী দলের সাংসদ, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ প্রয়োগ করা হত না?
উত্তরটা জানাবেন, প্লিজ।

Latest article