১৪ জুন ছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। এ বছর বিশ্ব রক্তদান দিবসের স্লোগান ছিল ‘ডোনেটিং ব্লাড ইজ অ্যান অ্যাক্ট অফ সলিডারিটি, জয়েন দ্য এফর্ট অ্যান্ড সেভ লাইফ’ অর্থাৎ ‘রক্তদান করা একটি সংহতিমূলক কর্তব্য। এই প্রচেষ্টায় সবাই যোগ দিন এবং জীবন বাঁচান।’ রক্তে বিভিন্ন অংশ রয়েছে তার মধ্যে একটি লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা, প্লাজমা এবং প্লেটলেট। এগুলির মধ্যে লোহিত কণিকা, প্লাজমা, ক্রায়োপিসিফিডিট, প্লেটলেট বা whole blood (যার মধ্যে রক্তের সব ক’টি অংশ থাকে) সাধারণত একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে প্রদান করা যায়। এগুলির মধ্যে whole blood আর প্যাকড আরবিসি বা লোহিত কণিকা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। প্লাজমা বা প্যাকড আরবিসি দেওয়ার সময় ব্লাড গ্রুপ অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুন-ছাত্র-যুবদের ঢল ভোট ভাগ নয়
ব্লাড গ্রুপ কী
১৯০০ সালে কার্লস ল্যান্স লাইনার সাহেব ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনাতে আবিষ্কার করেন চারটে ব্লাড গ্রুপ ‘এ, বি, ও, এবি’। কিন্তু ব্লাড গ্রুপের নেগেটিভ পজিটিভের এই ক্লাসিফিকেশন করেন রোনাল্ড ফিশার এবং আর আর রেজ সাহেব।
আমাদের শরীরের বিভিন্ন অ্যান্টিবডি এবং অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে এই ব্লাড গ্রুপের বিভাজন হয়েছে। এগুলো আমরা জন্মগত ভাবে পাই। যার ব্লাড গ্রুপ ‘এ’ হয়, তার লোহিত কণিকায় ‘এ’ অ্যান্টিজেন থাকে এবং প্লাজমায় থাকে অ্যান্টি ‘বি’ অ্যান্টিবডি। যার ব্লাড গ্রুপ ‘বি’ তাঁর লোহিত কণিকায় থাকবে ‘বি’ অ্যান্টিজেন এবং প্লাজমায় থাকবে অ্যান্টি ‘এ’। কাজেই এঁদের মধ্যে ব্লাড দেওয়া-নেওয়া হলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে ক্রশ রিয়্যাকশন হওয়ার কারণে।
যেহেতু ‘ও’ ব্লাড গ্রুপের রোগীদের রক্তে কোনও অ্যান্টিজেন থাকে না লোহিত কণিকাতে তাই ‘ও’ নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তি সবাইকে রক্ত দিতে পারে এবং এবি নেগেটিভ সবার রক্ত নিতে পারে— যদিও জরুরি অবস্থা ছাড়া এমনটা সচরাচর করা হয় না।
কী কী কারণে রক্ত দেওয়া হয়
আরও পড়ুন-জেলাশাসকের তদারকিতে রাস্তা ও সেতু মেরামত
যে সব মহিলার সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় বা অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন যাঁদের রক্তশূন্যতা হয়।
দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রক্তক্ষরণ হলে তাঁর রক্তের দরকার হয়।
থালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের।
ব্লাড, বোন ম্যারো বা রক্ত অল্পতায় ভুগছেন এমন যেকোনও ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তিদের।
যে সব রোগীর ক্ষেত্রে কোনও বড় অস্ত্রপ্রচার করা হচ্ছে।
রক্ত আমরা কোথা থেকে পাই
এই রক্ত আমরা কোনও না কোনও মানুষের শরীর থেকেই পাই। বিভিন্ন ওষুধপত্র অথবা চিকিৎসাসামগ্রী কৃত্রিম ভাবে বানানো যায় কিন্তু রক্ত নয়।
আজ অবধি কোনও ল্যাবরেটরিতে বা ফ্যাক্টরিতে রক্ত তৈরি হয়নি। তাই রক্তদানের মাধ্যমেই আমরা একে অপরের প্রাণ বাঁচাতে পারি।
রক্ত কারা দিতে পারেন
যে কোনও সুস্থ আঠারো বছর বয়সের ঊর্ধ্বে পুরুষ বা মহিলা রক্ত দিতে পারেন। পুরুষের ক্ষেত্রে তিন মাসে একবার এবং মহিলারা প্রত্যেক চারমাসে একবার করে রক্ত দিতে পারেন।
রক্তদানের আগে দেখে নেওয়া হয় যে দাতা রক্ত দেওয়ার উপযুক্ত শারীরিক অবস্থায় আছেন কী না। ব্লাড ব্যাঙ্কের বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকরা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নিয়ে এবং পর্যাপ্ত পরীক্ষা করার পরেই কোনও ব্যক্তিকে রক্তদান করার অনুমতি দেন।
রক্ত দেওয়া যায় কীভাবে
রক্ত দুভাবে রক্ত দেওয়া যায়— যে কোনও হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের মাধ্যমে অথবা আউটডোর ক্যাম্পের মাধ্যমে। আমরা অনেকেই জানি যে ব্লাড ব্যাঙ্কে শুধু রক্ত পাওয়া যায়। কিন্তু তা নয়, ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত দানও করা যায়।
আরও পড়ুন-লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ফুলে রোজগার
রক্তদানের আগে
রক্তদানের অন্তত চারঘণ্টা আগে খাবার খেয়ে নিতে হবে। খুব পেট ভরে খাওয়া উচিত নয়।
পরিমাণমতো জল খেয়ে তবেই রক্ত দিতে যেতে হবে। বর্তমানে নিয়মিত কোনও ওষুধ চললে, তার কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সুবিধা হয় সেই ব্যক্তির স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বুঝতে।
রক্তদান করতে সময় লাগে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। একজন ব্যক্তির থেকে মোটামুটি ৪৫০-৫০০ এমএল রক্ত নেওয়া হয় একবারে। রক্ত দেওয়া পর পরিমাণমতো জল এবং হালকা খাবার খেতে হবে।
রক্তদাতা যে পরিমাণ রক্ত দিলেন তাঁর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেই পরিমাণ প্লাজমা যা রক্তেরই একটা অংশ তা তৈরি হয়ে যায়। রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি হতে সময় লাগে মোটামুটি তিন সপ্তাহ মতো এবং আয়রন তৈরি হতে সময় লাগে ছ সপ্তাহ মতো। তার মধ্যেই কিন্তু যে রক্তটুকু দান করা হয়েছে আবার সেটা তৈরি হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-ফুটব্রিজ ফিরিয়ে দিক রেল
রক্ত দেওয়ার তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে নির্বিঘ্নে হাঁটাচলা, দৌড়ঝাঁপ সব করা যায়।
কারা রক্ত দেবার জন্য সক্ষম নয়
এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি বা সি আক্রান্ত রোগীদের রক্তদান করা উচিত নয়।
এছাড়া শিরায় মাদক সেবনকারীদেরও উচিত রক্তদান না করা।
রক্তদানের পরে প্রতিটি ব্লাড ব্যাগেই হেপাটাইটিস বি, সি, এইচআইভি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করা হয়। যদি সেই পরীক্ষার পর কোনও একটির রিপোর্ট পজিটিভ আসে তবে তা আর ব্যবহার করা হয় না এবং সেই রক্তদাতাকেও জানানো হয় তার রোগের সম্বন্ধে।
সুস্থ প্রেশার বা ডায়াবেটিস রোগীরা রক্ত দিতে পারেন।
মহিলাদের ক্ষেত্রে পিরিয়ড চলাকালীন রক্ত দেওয়া সম্ভব।
রক্তদান করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই সময় যে সব পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলো করা হয় তা থেকে কোনও ব্যক্তির শারীরিক অসুবিধা যেমন, হিমোগ্লোবিন কম আছে কি না, পালস রেটে বা প্রেশারের কোনও সমস্যা আছে কি না, তা ধরা পড়ে যায়। এছাড়া রক্তে কোনও সংক্রমণ রয়েছে কি না সেগুলোও জানা যায় এবং রক্তদাতার ব্লাড গ্রুপও জানা যায় নিখরচায়।
সাধারণত হিমোগ্লোবিন ১২.৫ হলে তবেই তার রক্ত দানের জন্য নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর ১০ হাজার
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
অনেকেই মনে করেন রক্ত দিলে রক্তবাহী কোনও রোগ শরীরে চলে আসতে পারে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা রক্ত দানের সময় এমন কোনও রক্তবাহিত রোগ প্রবেশের কোনও সম্ভাবনাই নেই।
রক্ত দিতে অনেকে ভয় পান শরীরের রক্ত চলে গেলে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়বেন বা মাথা ঘুরবে। রক্তদানে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সামান্য মাথা ঘুরে গেলে একটু বেশি করে জল ও রক্তদানের পরে একটু হালকা খাবার খেতে হবে।
পরিষেবা
আর জি কর এবং বাকি সরকারি বড় হাসপাতালের মতোই রয়েছে আপৎকালীন পরিষেবার জন্য ব্লাড ব্যাঙ্ক যা ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং রয়েছে রক্তদানেরও সুযোগ। এফএফপি থেকে শুরু করে প্লেটলেট এবং প্যাকড আরবিসি থেকে শুরু করে হোল ব্লাড সবই বিনামূল্যে পাওয়া যায় এখানে।