একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিরূপণ করা যায় সেই দেশের শক্তির চাহিদা দেখেই। আর্থ-সামাজিক উন্নতি যত হবে পাল্লা দিয়ে ততই শক্তির চাহিদা বাড়বে। তখনই এনার্জি সিকিউরিটি বা শক্তি নিরাপত্তার প্রশ্নটি আসে। অর্থাৎ, পরবর্তী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি মজুত থাকছে তো? ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এই প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী বিশ্বে ভারত একটি সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে। সেই নিরিখে শক্তির চাহিদা বা এনার্জি ডিমান্ড বহুগুণে বেড়ে যাবে। বর্তমানে আমাদের দেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। এই হার বাড়ছে এবং বাড়বে। এই কারণে ভারতের মতো একটি দেশে এনার্জি সিকিউরিটির ইস্যুটি একটি বার্নিং ইস্যু। অনেকের মনে এই মুহূর্তে একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হল— ভারতের মতো একটি দেশে যেখানে আর্থিক পরিকাঠামোর পরিধি ক্রমেই বাড়ছে সেখানে শক্তির উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধি সামলানো যাবে তো? আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব হবে না তো? যাকে আমরা প্রকৃত অর্থে ক্রাইসিস বলি?
আরও পড়ুন-এই সময়ের তিনটি পত্রিকা
ভারত যে সুসংহত শক্তিনীতি নিয়েছে তা মূলত দুটি প্রধান বিষয়ের ওপর আধারিত। ২০৩০ পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে যে বিপুল শক্তির প্রয়োজন হবে তা আমরা মেটাতে পারব কি? ২০৩০-এ অতিরিক্ত ৪০০ গিগা-ওয়াট (এক গিগা-ওয়াট মানে ১০০০ মেগা-ওয়াট) রিনিউয়েবল এনার্জি ভারতের প্রয়োজন-লক্ষ্যমাত্রা হবে। বর্তমানে গড়ে দেশের মোট শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা ৪৪৮.১১ গিগা-ওয়াট (২০২০ মার্চ-এর হিসাব)। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার (জিডিপি) যেখানে মনে করা হচ্ছে ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে ৮.৯ শতাংশ হতে পারে এবং লক্ষ্যমতো ৯.২ শতাংশ নয়, আমরা আমাদের সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের শক্তির চাহিদা মেটাতে পারব কি? শুধু শিল্পের নয়, সামাজিক পরিষেবা নয়, স্বাস্থ্য নয়, উৎপাদন নয়, সব ক’টি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শক্তির চাহিদা দেখা দেবে। এমনকী, ব্যক্তিগত ভাবে মানুষের আর্থিক উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের ব্যবহারের তূল্যমূল্যে শক্তির চাহিদা বাড়বে। শক্তির চাহিদা একই ভাবে বাড়বে গৃহস্থালিতেও। তাহলে আমাদের দেখতে হচ্ছে এই চাহিদা আগামী দিনে মিটবে কী করে। এভাবেই এসে যাচ্ছে এনার্জি সিকিউরিটির প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-জামাই-আখ্যান
ভারতের ক্ষেত্রে শক্তির চাহিদার বিষয়টি এই রকম— মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ প্রায় পশ্চিমি আদলে জীবনযাপন করেন, ৪০ শতাংশ মানুষ এই জীবনের দিকে চলেছেন, বাকি ৫০ শতাংশ মানুষের চাহিদা বাণিজ্যিক শক্তি যার মধ্য দিয়ে তারা শিল্প ও কৃষি উৎপাদন এবং জীবনযাত্রার মান বাড়াতে চান। অর্থাৎ, শক্তি নিরাপত্তা মানে অন্য অর্থে শক্তি খরচ বা এনার্জি কনসাম্পশনকে সুনিশ্চিত করা। এই কথা মাথায় রেখেই ভারতকে শক্তি নিরাপত্তা নীতি কার্যকর করতে হবে।
আরও পড়ুন-যুবভারতী ভরানোর ডাক দিলেন সুনীল
চিনের মতো ভারতেও শক্তির চাহিদা বাড়ছে এবং তা সামাল দেওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি তথ্য বলছে, শক্তির চাহিদার নিরিখে ভারতের স্থান বিশ্বে ৬ নম্বরে। দেশে তেল, কয়লা, গ্যাস-সহ অন্যান্য শক্তির চাহিদা বেড়ে যাবে। সড়ক, জল এবং বিমান পরিবহণের ক্ষেত্রে আমাদের শক্তির চাহিদা বাড়বে। ভারতের মোট শক্তির চাহিদার ৭০ শতাংশ আসে ফসিল ফুয়েল থেকে। এর মধ্যে, ৪০ শতাংশ জোগান দেয় কয়লা, ২৪ শতাংশ তেল, ৬ শতাংশ গ্যাস। ভারতের শক্তি আমদানির হার খুব শীঘ্রই ৫৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ২০০৯-’১০-এ ভারত ১৫৯.২৬ মিলিয়ন টন ক্রুড অয়েল আমদানি করেছিল, যা ছিল তার মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ। পেট্রোলিয়ম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালাইসিস সেল বা পিপিএসি-র এক হিসাব অনুযায়ী ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে তা হয়েছে ২১২.২ মিলিয়ন টন। তবে অতিমারির পর্বের আগে ২০১৯-’২০-তে এই সংখ্যা ছিল ২২৭ মিলিয়ন টন। ভারতের মোট আমদানির ৩১ শতাংশই তেল।
আরও পড়ুন-রাজ্যসভায় বিজেপির হয়ে মাঠে মায়াবতী
দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিমাণ ২০২০-র ডিসেম্বরের হিসাবে ০.৩ শতাংশ এবং পিক আওয়ারে এই ঘাটতি গিয়ে দাঁড়ায় ০.৬ শতাংশে। কেন্দ্রীয় সরকার সূত্রে জানা যায়, এনার্জি সেক্টর বা শক্তি উৎপাদন ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহ এই দুইয়ের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক রয়েছে। এই জন্য আমাদের শক্তি আমদানি বেড়ে যাচ্ছে। কয়লা এবং তেল আরও আরও আনার জন্য আমরা অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। অন্যদিকে, চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যের ফাঁকটি ক্রমেই বাড়ছে। সমগ্র বিশ্বে শক্তির চাহিদা ২০৩৫ সালের মধ্যে মনে করা হচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাবে। কেবলমাত্র চিন, ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি মিলে এই গ্লোবাল ডিমান্ডের ৬০ শতাংশ অধিকার করবে। চিন, আমেরিকা ও রাশিয়ার পর ভারত হল চতুর্থ দেশ যার শক্তি চাহিদা এত বেশি। প্রতি বছরে বিশ্বে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হয় তার ৪.৬ শতাংশ খরচ করে ভারত। যদি ভারতের আর্থিক উন্নয়ন ৮ শতাংশের দিকেই চলতে থাকে তাহলে তার নিজস্ব মজুত শক্তির ওপর চাপ পড়বে। এখনও পর্যন্ত আমরা দেশের মজুত অতিরিক্ত শক্তির উৎসগুলির অনুসন্ধান করে উঠতে পারিনি। হাইড্রোকার্বন রিজার্ভ কোথায় কতটা তা জানার চেষ্টা চলছে। তবে তা অতি ঢিমে তালে। তেল অনুসন্ধানে আমরা বিদেশি কোম্পানিগুলিকে পাশে পাইনি। এ পর্যন্ত আমরা অতিরিক্ত শক্তির সন্ধানে দেশের উপকূলবর্তী এলাকার মাত্র ২২ শতাংশ অনুসন্ধান করেছি।
আরও পড়ুন-হিমন্তের বিরুদ্ধে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে গ্যাস ও তেল রয়েছে। তবুও ভারতে গ্যাস আমদানির চাহিদা বাড়ছে। একটি তথ্য বলছে, আগামী দু-এক বছরের মধ্যে ভারতের মোট গ্যাস (লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস) চাহিদার দুই-পঞ্চমাংশ অনেক বেশি দামে আসবে বিদেশ থেকে। এদিকে ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল আমদানিও বেড়ে চলেছে। এই আমদানি বৃদ্ধি কীসের ইঙ্গিত দেয়? ইঙ্গিত দেয়, আমাদের মজুত শক্তির অভাব ও চাহিদা বৃদ্ধির দিকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত ক্রমেই একটি এনার্জি মার্কেটে পরিণত হচ্ছে। ২০৩৫ সালের আগে-পরে ভারত শক্তি খরচের নিরিখে বিশ্বের দ্বিতীয়তম দেশ হয়ে উঠবে।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে ৯ শ্রমিকের মৃত্যু
ক্রুড অয়েল আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরতা আরও বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। দেশীয় উৎসগুলি থেকে গ্যাস ও তেল উৎপাদন ও অনুসন্ধানের কাজ তেমন জোর দিয়ে হয়নি। এই কাজে তেমন খরচ করাও হয়নি। গত পনেরো বছরে ভারত এইক্ষেত্রে খরচ করেছে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলার। রাজস্থান, কৃষ্ণা-গোদাবরী এবং উত্তর-পূর্ব হিমালয়ে এই অনুসন্ধান চলছে। প্রস্তাবিত ইরান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া পাইপলাইন বসিয়ে তেল আনার যে প্রকল্প তাও এই শক্তি নিরাপত্তার জন্য।
আরও পড়ুন-চারজনের ফাঁসি
১৯৭০ সালে কয়লা খনি জাতীয়করণের সময় আমাদের দেশে কয়লা উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭০ মিলিয়ন টন। ২০১৯-’২০ অর্থবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০২.১৩ মিলিয়ন টনে। আগামী পাঁচ বছরে তবুও দেশে চাহিদা-জোগানের মধ্যে ২০ শতাংশ ঘাটতি দেখা দেবে। এই কারণে আগামী দিনে দেশে কয়লা উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে এবং বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য আমদানিও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের মজুত ভাণ্ডার সীমিত। নতুন ভাণ্ডারের অনুসন্ধান চলছে। এই কারণে আমাদের এখন লক্ষ্য পরমাণু শক্তি ও অচিরাচরিত শক্তি। রিনিউয়েবল এনার্জি এবং নিউক্লিয়ার পাওয়ার আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করবে। আমাদের দেশ বায়ু শক্তির একটি বিরাট বাজার। পৃথিবীর পঞ্চমতম। আগামীদিনে সূর্যশক্তিকে কাজে লাগিয়ে চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চলছে। পরমাণু শক্তিকে কয়লা পোড়ানো বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প হিসাবে ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২৫ বছরে পুরোপুরি কয়লা নয়, পরমাণু শক্তি ভারতের বিদ্যুৎ চাহিদা অনেকাংশে মেটাবে। বায়ো-ডিজেল, রিনিউয়েবল ও কার্বন নিউট্রাল বায়োমাস উৎস ফসিল ফুয়েলের বিকল্প হতে পারে।
আরও পড়ুন-অপদার্থতার চূড়ান্ত! জীবিত সাক্ষীকে বেমালুম ‘মৃত’ ঘোষণা সিবিআইয়ের
আমাদের দেশকে অপ্রচলিত ও অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহারের দিকে অনেক বেশি করে নজর দিতে হবে। নজর দিতে হবে শক্তি সঞ্চয় ও অপব্যবহার কমানোর দিকেও। শক্তি খরচের দিকে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হবে। গ্রিন লিভিং কনসেপ্টকে আরো বেশি করে বাস্তবায়িত ও জনপ্রিয় করতে হবে। কীসে শক্তি খরচ কম হয় বা সাশ্রয় হয় তা দেখতে হবে। যদি আমরা রিনিউয়েবল এনার্জির উৎসগুলির আরও বেশি ব্যবহার করতে পারি তাহলে অনেক সমস্যা মিটে যায়। বর্তমানে বায়ুচালিত ও জল বিদ্যুৎ আমাদের শক্তির চাহিদা মেটাচ্ছে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল এবং এই ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগের প্রয়োজন। এনার্জি সিকিউরিটি বা শক্তির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হলে আমাদের যেমন দেশের নতুন নতুন মজুত ফসিল-ফুয়েল ভাণ্ডারগুলি অনুসন্ধান করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, পরমাণু শক্তির দিকে হাত বাড়াতে হবে, তেমনই অপ্রচলিত ও অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহারের দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে হবে। সেইসঙ্গে, এনার্জি কনজারভেশন বা শক্তি সঞ্চয়ের যে নীতি রয়েছে (এনার্জি কনজারভেশন অ্যাক্ট, ২০০১) তাকে আরও কঠোর ভাবে বলবৎ করতে হবে।
আরও পড়ুন-মাঙ্কিপক্সের আতঙ্ক
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-’১৮) উইনস্টন চার্চিল ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীর জন্য একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি রয়্যাল নেভির যুদ্ধ-জাহাজগুলিকে কয়লার পরিবর্তে তেলে চালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কেন? এতে জাহাজ চলবে দ্রুত। তাঁকে তেলের জন্য অবশ্য পার্সিয়ার ওপর নির্ভর করতে হল। অনেকেই তখন এই সিদ্ধান্তের জন্য শক্তি নিরাপত্তার প্রশ্নটি তুলেছিলেন। চার্চিলের উত্তর ছিল, ‘সেফটি অ্যান্ড সার্টেইনটি ইন অয়েল…লাই ইন ভ্যারাইটি অ্যান্ড ভ্যারাইটি অ্যালোন।’ যে-প্রশ্ন চার্চিলের সময় উঠেছিল— শক্তি নিরাপত্তার সেই প্রশ্ন একশো বছর পর ভারতের বুকে আবার উঠেছে। তেল-কয়লা-গ্যাস—এরপর কী?