রক্তাল্পতা

অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা হল একটি ঘাতক রোগ। রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে হয় এই অসুখ। একাধিক কারণে কমে যায় হিমোগ্লোবিন। কেন হয় রক্তের ঘাটতি? কীভাবে পূরণ করবেন তা। কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকবেন, জানাচ্ছেন মালদা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক এবং অধ্যাপক ডাঃ পল্লব বসু। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রক্ত অল্প কেন
রক্তাল্পতার কারণ অনেক। তবে, মূলত হল নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়া। আয়রনের অভাবে যে অ্যানিমিয়া হয় এটাই প্রধানত দেখতে পাওয়া যায়।
মেয়েদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার প্রধান কারণ হল প্রতিমাসে পিরিয়ডের কারণে খানিকটা ব্লাড লস হয়। এছাড়া সঠিক পুষ্টির অভাবজনিত কারণে এদেশের মেয়েরা এবং প্রেগন্যান্সির সময় হবু মা অ্যানিমিয়াতে ভোগেন। তাই এখন নিয়ম হয়েছে গর্ভবতীদের রুটিন করে আয়রন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন-বিশ্বের ৫০টি সর্বাধিক দূষিত শহরের মধ্যে ৩৯টি ভারতে

শুধু আয়রন নয়, আরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে যা আমাদের লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং ফলিক অ্যাসিড। এই দুটোর অভাবেও অ্যানিমিয়া হয়।
ভিটামিন বি টুয়েলভের উৎস হল প্রাণীজ খাদ্য। তাই ভেজিটেরিয়ান ডায়েটে বি টুয়েলভ বেশি থাকে না ফলে নিরামিষাশীদের ডায়েটে যদি দুধ না থাকে তখন ভিটামিন বি টুয়েলভের ঘাটতি হয়।
দীর্ঘস্থায়ী কিছু অসুখের পর অ্যানিমিয়া দেখা দেয়, যেমন কালা জ্বর, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি অসুখে লোহিত রক্তকণিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ক্রনিক কিছু রোগ, যেমন লিভার বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনির অসুখ হলেও অ্যানিমিয়া হয়। অনেকদিন ধরে কিডনির অসুখে ভুগলে এরিথ্রোপোয়েটিন নামক একটি হরমোন যা কিডনি থেকে ঠিকমতো নিঃসৃত হতে পারে না। এর ফলে রক্তাল্পতা দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-ব্যাঙ্ক বিপর্যয়ের দায় ট্রাম্পের, দাবি বাইডেনের

যে রোগীর ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন বেশি রয়েছে তাঁদের প্রচুর পরিমাণে আয়রন যুক্ত খাবার খাওয়ালেও যখন দেখা যায় হিমোগ্লোবিন বাড়ছে না তখন তাঁদের রক্তপরীক্ষা করলে কিডনির অসুখ ধরা পড়ে। এই কিডনির অসুখের কারণ অন্যতম কারণ ডায়াবেটিস। দুর্ঘটনায় অনেক পরিমাণে ব্লাড লস হলে পরবর্তীতে অ্যানিমিয়া দেখা দেয়।

আরও পড়ুন-নিরাপত্তা প্রত্যাহার

থ্যালাসেমিয়া
থ্যালাসেমিয়া এশিয়ান কান্ট্রিতে খুব কমন অসুখ এবং এই রোগের কারণে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। থ্যালাসেমিয়া নানা ধরনের হয়। এদেশের কিছু রাজ্যে এবং পশ্চিমবঙ্গে কিছু জেলায় ইবিটা থ্যালাসেমিয়া বলে একটা প্রকার রয়েছে, এটার ক্ষেত্রে আরবিসি বা লোহিত রক্তকণিকার লাইফ স্প্যান খুব কম হয়। সাধারণত লোহিত রক্তকণিকাগুলো বেঁচে থাকে ১২০ দিন বা চার মাস কিন্তু এই থ্যালাসেমিয়া হলে লোহিত রক্তকণিকা বেঁচে থাকে ৩০ থেকে ৬০ দিন। এর ফলে এই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের প্রতিমাসে একবার করে রক্ত দিতে হয়। এটাই এদের বেঁচে থাকার একমাত্র রাস্তা। অন্যান্য থ্যালাসেমিয়াতেও শিশুদের প্রতি দুই থেকে তিনমাস অন্তর রক্ত দিতে হয়। তবে এটা প্রিভেন্টেবল অ্যানিমিয়া।
ঠিক যেমন নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। পুষ্টি মেনে চললে, বেশি করে আয়রনযুক্ত খাবার খেলে আবার প্রেগন্যান্সির সময় যে অ্যানিমিয়া হয় সেটাও প্রতিরোধ করা সম্ভব আয়রন এবং ফলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টের মাধ্যমে। তেমনই বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর থ্যালাসেমিয়া রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। দু’জনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার কেরিয়ার হন তাহলে তাঁদের সন্তানের মেজর বা মাইনর থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে বারবার রক্ত দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। যদি একজন কেরিয়ার হন, অপরজন কেরিয়ার না হন তাহলে থ্যালাসেমিয়া সম্পূর্ণ আটকে দেওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন-শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস উত্তরে কমলা সতর্কতা

অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া
আর একটি অ্যানিমিয়া হল বোনম্যারো ঘটিত অ্যানিমিয়া। একে বলা হয় অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া। আমাদের শরীরে যে রক্তের উপাদান রেড ব্লাড এবং হোয়াইট ব্লাড কর্পাসল, প্লেটলেট সবই তৈরি হয় অস্থিমজ্জা থেকে। এবার শরীরে কোথাও ক্যানসার হলে রেডিয়েশন দেওয়া হয় তাতে বোনম্যারো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিছু অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে যা খেলে বোনম্যারোর ক্ষতি হয় ফলে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হতে পারে না। এই অবস্থা হলে রক্তাল্পতা হয়।
লিউকেমিয়া
এছাড়া ব্লাড ক্যানসার বা লিউকেমিয়া হলে বোনম্যারো বা অস্থিমজ্জা থেকে রক্তকণিকাগুলো তৈরি হতে পারে না। এরকম কন্ডিশনে অ্যানিমিয়া দেখা যায়।

আরও পড়ুন-হাজিরা নিয়ে উত্তাল বিশ্বভারতী, বিক্ষোভ

একটোপিক প্রেগন্যান্সি
একটোপিক প্রেগন্যান্সি অর্থাৎ জরায়ুর মধ্যে না এসে ভ্রূণটি অন্য কোথাও তৈরি হয়েছে যেমন ফ্যালোপিয়ান টিউবে বা জরায়ুর বাইরে, তখন কিছুদিন থাকার পর সেটা ফেটে যায় এবং প্রচুর পরিমাণে রক্তপাত হয়, অ্যানিমিয়া হয়। এটা হেমারেজিক অ্যানিমিয়ার বড় কারণ।
উপসর্গ
অ্যানিমিয়া হলে সব কোষের মধ্যে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। যার বহিঃপ্রকাশ হল একটু কাজ করলে, হাঁটলে, সিঁড়ি ভাঙলে হাঁপিয়ে যায়। খুব দুর্বলতা।
একটু সাদাটে বা ফ্যাকাশে দেখায়।
ঘুম থেকে উঠলে চোখ-মুখ ফুলে থাকে।
পা ঝুলিয়ে বসলে ফুলতে শুরু করে।
মাথা ঝিমঝিম করা, মাথা ঘোরা।
ঘুম ঘুম পাওয়া, সঙ্গে ল্যাথার্জি থাকে।

আরও পড়ুন-নিরাপত্তা প্রত্যাহার

অ্যানিমিয়া শক
অ্যানিমিয়ার তিনটে ধাপ হয়— মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়র। রক্তে হিমোগ্লোবিন যদি ১৪-র থেকে কম এবং ৯ এর উপরে থাকে তাহলে মাইল্ড। যদি ৬ থেকে ৯ এর মধ্যে থাকে তাহলে মডারেট এবং ৯ এর নিচে চলে গেলে সিভিয়র অ্যানিমিয়া। ৫ বা ৪ এর নিচে চলে গেলে তখন রক্ত দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তখন রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে বা শকে চলে যেতে পারে, এটাকে বলে অ্যানিমিক শক।
পরীক্ষা
প্রধানত হিমোগ্লোবিন টেস্ট করলেই অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা ধরা পড়ে। এছাড়াও, রক্তে ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং ফলিক অ্যাসিডের পরিমাণ পরিমাপ করা যায়। সেক্ষেত্রে, এই ভিটামিনগুলো নরমাল আছে কি না তাও ধরা পড়ে।
কিছু ক্ষেত্রে রক্তে ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন-এর মাত্রা পরীক্ষা করা হয়, তখন যদি এগুলোর মাত্রা বেশি থাকে তাহলে বোঝা যায় ক্রনিক কিডনি ডিজিজ জনিত কারণে অ্যানিমিয়া।

আরও পড়ুন-বিতর্ক এড়াতেই কি আপলোড করা হল না অনুপমের বক্তৃতা

চিকিৎসা
প্রধানত আয়রন ডেফিসিয়েন্সি অ্যানিমিয়া বা নিউট্রিশনাল অ্যানিমিয়ায় আয়রন, ভিটামিন বি টুয়েলভ এবং ফলিক অ্যাসিড রয়েছে এমন ওষুধ একটি নির্দিষ্ট ডোজে দেওয়া হয়। এক থেকে তিনমাস আয়রন সাপ্লিমেন্ট চলে। এতে একটা কনস্টিপেশন দেখা দিতে পারে। যাঁদের ইতিমধ্যে কোষ্টকাঠিন্য রয়েছে তাঁদের আয়রন সাপ্লিমেন্টের সঙ্গে ল্যাক্সেটিভ দেওয়া হয়।
আয়ুর্বেদিক কিছু ভেষজ বা ওষুধ রয়েছে যেগুলো খেলে রক্ত বাড়ে।
যাঁদের বি টুয়েলভ ডেফিসিয়েন্সি রয়েছে তাঁদের বি টুয়েলভ ইঞ্জেকশন দিতে হয়।
ফলিক অ্যাসিড ডেফিসিয়েন্সি গর্ভবতী মায়েদের হলে তাকে সাপ্লিমেন্ট এবং ওষুধ দেওয়া হয়।
কিডনি রোগের অ্যানিমিয়া সারাতে অ্যারিথ্রোপোয়েটিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। সপ্তাহে এক বা দু’দিন দিতে হবে, সঙ্গে আয়রন সাপ্লিমেন্ট দিলেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে।
এর পাশাপাশি রক্তাল্পতায় খাওয়া-দাওয়া বা ডায়েট একটা বড় পার্ট যার মাধ্যমে রোগী অনেকটা সুস্থ হয়ে ওঠে।

Latest article