সার্ভাইকাল ক্যানসার সচেতনতা মাস পালন

গোটা জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় সার্ভাইকাল ক্যানসার (cervical cancer) অ্যাওয়ারনেস মান্থ। জরায়ু মুখের ক্যানসার হল বিশ্বব্যাপী মহিলাদের হওয়া ক্যানসারগুলোর মধ্যে অন্যতম। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী সমগ্র এশিয়ার মধ্যে এই ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ভারতেই বেশি। এই ক্যানসারে মৃত্যুর ৪০ শতাংশর মধ্যে ২৩ শতাংশই এদেশে। সময় এসেছে আরও সতর্কতা এবং সচেতনতার। সঠিক সময় ধরা পড়লে সেরে যেতে পারে এই রোগ। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী।

Must read

প্রতিবছরেই এই মাসটি পালনের একটা থিম থাকে। ২০২৪ এর সার্ভাইকাল ক্যানসার অ্যাওয়ারনেস মান্থের থিম হল— লার্ন, প্রিভেন্ট এবং স্ক্রিনিং অর্থাৎ রোগটি সম্পর্কে জানা তার প্রতিরোধ করতে সঠিক পরীক্ষা।
‍‘বিগ ব্রাদার’ খ্যাত সেই জেড গুডির কথা মনে আছে? তিনি রিয়্যালিটি শো বিগ ব্রাদারে এসে শিল্পা শেট্টির সঙ্গে বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ করেছিলেন। প্রবল বিতর্কের মাঝেই তিনি ২০০৮-এ ভারতের ‘বিগ বস’ শো-য়ে যোগ দেন। কিন্তু তা বেশিদূর এগোয়নি। হঠাৎ জেড গুডির সার্ভাইকাল ক্যানসার ধরা পড়ায় শো ছেড়ে দেশে ফিরে যান। চিকিৎসায় অর্থ খরচ করেও বাঁচানো,যায়নি তাঁকে। মাত্র ২৭ বছর বয়সে জেড গুডি প্রয়াত হন । তাঁর রোগযন্ত্রণার সবটা টিভিতে দেখার পর অনেকেই সার্ভাইকাল ক্যানসার অসুখটি নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।

আরও পড়ুন-পান্নুনের খুনের হুমকির মুখে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী

সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে হওয়া জরায়ুর মুখের ক্যানসার বা সার্ভাইকাল ক্যানসারের মধ্যে ২১ শতাংশই হয় এই দেশের মহিলাদের। সাম্প্রতিক ল্যানসেট স্টাডি অনুযায়ী সমগ্র এশিয়ার মধ্যে জরায়ুর মুখের ক্যানসার ভারতেই বেশি। এছাড়া সার্ভাইকাল ক্যানসারে ভারতে মৃত্যুর হার চিনের ঠিক পরেই। ক্যানসারে আক্রান্তের মৃত্যুর ৪০ শতাংশর মধ্যে ২৩ শতাংশই এই দেশে, বাকি চিনে। আরও দুশ্চিন্তার বিষয় হল, ভারতবর্ষে প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন মহিলা সার্ভাইকাল ক্যানসারে মারা যান। যদিও বহু প্রচারের ফলে সার্ভাইকাল ক্যানসারে মৃত্যুর হার আগের চেয়ে কিছুটা কমলেও এই ছবিটা খুব স্বাভাবিক নয়।

আরও পড়ুন-‘দক্ষিণেশ্বরের স্কাইওয়াক হৃদয়ের মণিমুক্ত’ সাংবাদিকদের মুখোমুখি মুখ্যমন্ত্রী

মানবদেহের সার্ভিক্সে দু’ধরনের কোষ রয়েছে— স্কোয়ামাস কোষ এবং গ্রন্থি কোষ। বেশির ভাগ সার্ভাইকাল ক্যানসার (প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ) এই স্কোয়ামাস কোষেই হয়। বাকি ক্ষেত্রে গ্রন্থি কোষে হয়। জরায়ুর নীচের অংশকে সার্ভিক্স বলে। কিছু অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে এই অংশটা চিকিৎসক দেখতে পান। এই অংশে ক্যানসার হলে তাকে সার্ভাইক্যাল ক্যানসার বলে। এটা এক ধরনের সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ। আরও সহজ করে বললে, সার্ভাইকাল ক্যানসার হল সার্ভিক্সের মধ্যে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। এর জন্য দায়ী হল এইচপিভি বা হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস। এই ভাইরাসটি মহিলাদের ইউট্রাসের মুখে সার্ভিক্সে প্রি-ক্যানসারাস স্টেজ তৈরি করে। যাকে চিকিৎসার পরিভাষায় বলা হয় ইনট্রা এপিথেলিয়া নিওপ্লেশিয়া বা সিআইএন ওয়ান, সিআইএন টু ইত্যাদি। তখন ওই অংশের কোষগুলো অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে শুরু করে। অনেক সময়ই শরীরে খুব বেশি ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ শক্তি থাকলে এগুলো নিজে থেকে সেরে যায়, ক্যানসার স্টেজে পৌঁছয় না। কিন্তু যদি খুব বেশি পরিমাণে ভাইরাস দ্বারা উইমেন সার্ভিক্স আক্রান্ত হয় তখন সেটা ক্যানসারে পরিণত হয় এবং শুরুতেই ধরা না পড়লে ছড়াতে শুরু করে।

আরও পড়ুন-‘আপনারা সমালোচনা করবেন, আমি খুশি হব’ বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর

লক্ষণ চিনুন
 একদম শুরুতে অনেক সময় কোনও সিম্পটম বা উপসর্গই থাকে না। কিছুই বোঝা যায় না। সেই কারণে একটা বয়স থেকে প্যাপস্মিয়ার টেস্টের কথা বলা হয়।
 বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি ধরে গেলে ঋতুচক্রের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। যখন নিকটবর্তী টিস্যুতে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে তখন এটা হয়।
 অস্বাভাবিক বা কটু গন্ধযুক্ত ওয়াটারি ভ্যাজাইনাল হোয়াইট ডিসচার্জ বা সাদা স্রাবও হতে পারে। সেই ডিসচার্জে ব্লাডও আসতে পারে।
 পোস্ট কয়টাল ব্লিডিং বা যৌন সংসর্গের পর ব্যথা এবং অনিয়মিত রক্তপাত।
 অনিয়মিত অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, সঙ্গে কোমরে, তলপেটে অবিরাম ব্যথা। পা ফুলে যাওয়া।
 ঋতুবন্ধের পরেও রক্তপাত হয়।
 এই রোগে আক্রান্ত মহিলাদের খিদে না পাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পায়।
 দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব এবং অস্বস্তি।  ঋতুস্রাব একদম কমে যাওয়া। শুধু স্পটিং হওয়া
 খুব বাড়াবাড়ি হলে ইউরিনের সঙ্গে বা স্টুলের সঙ্গে ব্লাড আসতে শুরু করে।

আরও পড়ুন-কলকাতার রাজপথে মেগা সংহতি মিছিলের ডাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

সার্ভাইকাল ক্যানসার কখন হয়
 সার্ভাইকাল ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায় ষোলো বছর বয়সের নীচে মেয়েদের যৌন সংস্রব হলে। এই দেশে এখনও গ্রামাঞ্চলে কমবয়সে কন্যাকে পাত্রস্থ করা হয়। যারা বয়সের আগেই একাধিক সন্তানধারণ করে ফেলে তাদের মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে এই রোগ দেখা দেয়। কারণ সেক্সুয়াল হাইজিন সম্পর্কে এই সব গ্রামাঞ্চলের মানুষ একেবারেই ওয়াকিবহাল নয় ফলে বিপত্তি ঘটে।
 এছাড়া বহুপুরুষের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ও অবাধ, অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্ক।
 পাঁচ বছরের অতিরিক্ত সময় ধরে গর্ভনিরোধক ওষুধ ব্যবহার।
 মহিলাদের অতিরিক্ত ধূমপান এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আরও একটা কারণ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
 সার্ভাইকাল ক্যানসার প্রতিরোধের দুটো উপায়— প্যাপস্মিয়ার টেস্ট বা সার্ভাইকাল ক্যানসার স্ক্রিনিং এবং ভ্যাকসিনেশন।
 প্যাপস্মিয়ার টেস্ট করতে হবে। এই পরীক্ষাটি ২১ বছর বয়সের পর থেকে প্রতি তিনবছর অন্তর একেবারে ৬৫ বছর পর্যন্ত করা উচিত।
 প্যাপস্মিয়ারের সঙ্গে এইচপিভি টেস্টিং করলে ভাল। সেক্ষেত্রে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর করতে হবে।
 সার্ভাইকাল ক্যানসারের ভ্যাকসিন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। ৯ থেকে ১৪ বছর যখন পর্যন্ত একটি মেয়ে ভার্জিন তখনই দিয়ে দিতে হবে। প্রথম ডোজের দু’মাস পর দ্বিতীয় এবং ছ’মাস পর তৃতীয় ডোজ দিতে হবে।

আরও পড়ুন-পাল্টে গেল এক্স হ্যান্ডেলে তৃণমূল কংগ্রেসের কভার পিকচার

চিকিৎসা
 সার্ভাইকাল ক্যানসার যখন স্টেজ ওয়ান তখন ক্যানসার শুধু সার্ভিক্সেই থাকে। স্টেজ টুতে পেলভিক ওয়ালের আগে পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। স্টেজ থ্রি-তে পেলভিক ওয়াল, গ্ল্যান্ড বা লিম্ফ নোডগুলোয় এবং যোনির এক-তৃতীয়াংশে ছড়িয়ে পড়ে। স্টেজ ফোর বা যেটা সর্বশেষ পর্যায় তখন ব্লাডার এবং রেকটামে ছড়িয়ে যায়। সুতরাং চিকিৎসা নির্ভর করছে কোন স্টেজে রয়েছে তার ওপর।
 স্টেজ টু পর্যন্ত সার্জারিই সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি। এক্ষেত্রে সার্ভিক্স সহ সমস্ত জরায়ু, ওভারি অস্ত্রোপচার করে বাদ দেওয়া হয়। এছাড়া আশপাশের গ্ল্যান্ডগুলোতে ছড়িয়েছে কি না দেখার জন্য গ্ল্যান্ডগুলোকে বের করা হয়।
 এর পরবর্তী ধাপ হল রেডিয়েশন থেরাপি। এর সঙ্গে চলে কেমোথেরাপিও।
 স্টেজ ফোর-এ রেকটাম এবং ব্লাডার আক্রান্ত হয়। ফলে তখন সুস্থ হয়ে ওঠা কঠিন।
 যেকোনওরকম অস্বাভাবিকতা এলেই চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। কল্পস্কোপিক টেস্টের মাধ্যমে যোনি এবং সার্ভিক্সের অস্বাভাবিক অংশগুলোকে পরীক্ষা করা হয়।
সতর্কতা
 অসুরক্ষিত যৌনমিলন নয়। কন্ডোমের ব্যবহার করতে হবে।
 সেক্সুয়াল হাইজিন মেনে চলতে হবে।
 ধূমপান বর্জন।
 ভ্যাকসিন নেওয়া খুব জরুরি। ১৪ বছরে নিতে না পারলে ২০ বছর থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে নেওয়া যেতে পারে।
 রোগপ্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ ইমিউনিটি বেশি থাকলে সারভাইকাল ক্যানসার স্টেজ আসার আগে প্রথম ধাপেই সেরে যায়। রোগটা বাড়তে পারে না।

Latest article