চোপ! আদালত চলছে

বিজয় তেন্ডুলকর মারাঠিতে লিখেছিলেন ‘শান্ত কোর্ট চালু আহে’। পরে নানা ভাষায় অনূদিত। এক সময় বাংলায় মঞ্চস্থ করেছে বহুরূপী। এবার ‘সংলাপ’-এর প্রযোজনায় অভিনীত হল ‘চোপ! আদালত চলছে’। বঙ্গীয়করণ করেছেন কুন্তল মুখোপাধ্যায়। নাটকটি নারীকেন্দ্রিক। নারী-সমস্যার নানা দিক তুলে ধরেছে। দেখিয়েছে ৫০ বছর আগে সমাজে নারীর স্থান যা ছিল, এখনও তাই আছে। লিখলেন জয়িতা মৌলিক

Must read

একবিংশ শতাব্দী। চারিদিকে উড়ছে নারী স্বাধীনতার ধ্বজা। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে আজও কি সত্যিই মেয়েদের স্বাধীন ইচ্ছের দাম আছে? নিজের পছন্দের পথে যেতে চাইলে এখনও তার গায়েই ছেটে কলঙ্কের কালি। প্রায় ৫০ বছর আগে মারাঠি-তে নাটক প্রখ্যাত নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকর লিখেছিলেন ‘শান্ত কোর্ট চালু আহে’। এরপর নানা ভাষায় এই নাটক অনুবাদ হয়েছে। বাংলাতেও অনেকেই এর ভাষান্তর করেছেন। এক সময় বহুরূপী এই নাটক করেছে। এমনকী, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে মারাঠির বঙ্গানুবাদ হয়েছে বাংলাদেশেও। এবার সেই নাটক মঞ্চস্থ করছে ‘সংলাপ’। নাট্যকার কুন্তল মুখোপাধ্যায় এর বঙ্গীয়করণ করেন। নাটকে আসে বর্তমান সমাজের অনেক বিষয়। তবে, এক থাকে নাটকের মূল সুর— আদালত ও একটি মেয়ে। যদিও এটা নকল আদালত অর্থাৎ বিচার বিচার বিচার খেলা। কিন্তু তাতেও বেরিয়ে আসে সমাজের বিভিন্ন পেশায় থাকা মানুষের মুখোশের আড়ালে মুখের চেহারাটা।

আরও পড়ুন-বাংলা কি বেটি

‘চোপ! আদালত চলছে’-তে নির্দেশক স্পষ্ট দেখিয়েছেন ৫০ বছর আগেও নারীর স্থান সমাজে যা ছিল, বর্তমানে তার ফারাক তেমন হয়নি। নাটকটি নারীকেন্দ্রিক। প্রধান চরিত্র সৃষ্টি। তাঁকে ঘিরেই এগোয় গল্প। সৃষ্টি একজন শিক্ষিকা। আধুনিকা সৃষ্টি গ্রুপ থিয়েটার করে। উচ্ছ্বল। সে হাসতে ভালবাসে। অনর্গল কথা বলে সে। তার কথায়, সে স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে। আনন্দে থাকাই তার জীবনের মূল মন্ত্র। কিন্তু সেই উচ্ছলতার আড়ালে রয়েছে না পাওয়ার, বঞ্চনার অভিজ্ঞতা। সেটা সযত্নে লুকিয়ে রাখে সে। কিন্তু আটজন মানুষের নাটকের দল একটা মফস্বল শহরে যায়। সেখানে শুরু হয় কোর্ট রুম ড্রামার মহড়া। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যেই এরা ছোট ছোট নাট্য অভিনয় করে। কিন্তু যে নাটকটি তারা করবে ভেবেছিল, সেটা নয়। একটি কাল্পনিক ঘটনাকে নাট্যরূপ দেওয়া হয়। কিন্তু সত্যিই কি কাল্পনিক? না কি আগে থেকেই একজনকে দোষী সাব্যস্ত করে নিয়ে শুধু বিচার বিচার খেলা? সৃষ্টিকেই অপরাধী সাজিয়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়। স্বাধীন এক যুবতী নারী হিসেবে সৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে। যা তার নাট্যদলের সকলকে তার সম্বন্ধে কুকথা বলে। অবিবাহিত নারীর অন্তরঙ্গ মেলামেশা যে এখনও গর্হিত অপরাধ— সেটাই দেখায় ‘চোপ! আদালত চলছে’। নির্দিষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়া গেলেও সৃষ্টিই কি অপরাধী? আর সেখানেই উঠে আসে সমাজে নারীর স্থান কোথায়! আজও একশ্রেণির মানুষ নারী স্বাধীনতাকে কী চোখে দেখে! শুধু সৃষ্টি নয়, এ যেন সমগ্র নারীজাতির অবমাননা। সমসাময়িক প্রসঙ্গেও আসে নাটকে। ‍‘খেলা হবে’ স্লোগানও এসেছে ভিন্ন আঙ্গিকে।

আরও পড়ুন-মেয়েবেলার খেলা

সৃষ্টি-র চরিত্রে অভিনয় করেন শর্মিলা বসু। দীর্ঘদিন ধরে মঞ্চে অভিনয় করা শর্মিলা এই চরিত্রে কার্যত মঞ্চ শাসন করলেন। প্রথম থেকেই তিনি উচ্ছল-প্রগলভ। এই সময় যেমন মঞ্চের সব আলো কেড়ে নেয় সৃষ্টি। আবার যখন সে কাঠগড়ায়— তখন শর্মিলা শান্ত। কষ্ট চেপে রেখে বারবার চেষ্টা করছেন নিজের অবস্থান বোঝানোর। আর তাঁর মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে মহিলাদের যন্ত্রণা।
নাটকে দুই নারী চরিত্র। সৃষ্টি ছাড়া অন্য নারী চরিত্র বেণু। সে বয়স্ক বিচারকের তরুণী স্ত্রী। এই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন শিপ্রা পাল। একদল তথাকথিত রুচিশীল মানুষের মাঝে সে খুবই মেঠো। এই বিবাহিত মহিলাও শিক্ষিতা, আধুনিকা, অবিবাহিতা সৃষ্টিকে দোষারোপ করে। তাকে হিংসা করে। কিন্তু কমবয়সী তরুণের প্রতি বেণুর আকর্ষণও কম নয়। হাঁটা-চলা-কথাবলা-বসা সবের মধ্যেই একেবারে রুচিহীনতার ছাপ। আর আগাগোড়া নাটকে চরিত্রের সেই সুর বজায় রেখেছেন শিপ্রা। যেটা নিঃসন্দেহে তারিফযোগ্য।
নাটকটি বাংলায় সৃজন ও নির্দশন করেছেন কুন্তল মুখোপাধ্যায়। প্রযোজনা ও নিয়ন্ত্রণ গুরুপদ মিত্রের। নিজে উকিলের ভূমিকায় অভিনয়ও করেছেন তিনি। অন্যান্য ভূমিকায় ছিলেন কাজল শম্ভু, সৌরভ পয়ড়া, গুরুপদ মিত্র, অমল আচার্য, শান্তনু পাল, বিতানবিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাদল লাহিড়ী। সকলেই নিজেদের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। তবে, সৌরভ পয়ড়া ও গুরুপদ মিত্র আলাদা করে নজর কেড়েছেন। শান্তির চরিত্র কিছুটা বিবেকের মতো সামনে এসেছে, যেখানে আর সবার মতো সৃষ্টিকে সে অপরাধী মনে করে না। উল্টে তার প্রিয় পুতুল সে তুলে দেয় তার ম্যাডামের হাতে। অভিনয়ের পাশাপাশি পোশাকের দায়িত্বেও ছিলেন শর্মিলা। সৌমেন চক্রবর্তীর আলো মনে রাখার মতো। সৌরভের মঞ্চসজ্জায় যথাযথ। নাটকের প্রথম থেকে যেটাকে ভাঙা ঘড়ি মনে হচ্ছিল। সেটা শেষ দৃশ্যে হয়ে ওঠে নারীর মুখ।

আরও পড়ুন-মেয়েদের কুস্তি কথা

তবে, নাটকের স্ক্রিপ্ট আরও শক্তিশালী হতে পারত। সংলাপে বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। সেটা অবশ্য অভিনয় নিয়ে পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তবে, প্রথম থেকেই সৃষ্টি যে টার্গেট— সেটা স্পষ্ট। শুধু তাই নয়, নাটকের মধ্যে নাটক চলার সময়েও কোণঠাসা সৃষ্টি সেভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেল না। সে নিজের কথা বলল, যেখানে চরিত্ররা পুরোপুরি মঞ্চে পুতুলের মতো বসে থাকেন। মুখে সাদা মুখোশ। অভিব্যক্তিহীন। কিন্তু যারা তার দিকে আঙুল তুলল তাদের মুখোশ খোলার সুযোগ পেল না সে। এটা একটা বড় খামতি।

Latest article