বাংলা কি বেটি

না ফেরার দেশে চলে গেলেন 'একদিন প্রতিদিন'-এর মিন। পরিচালক মৃণাল সেনের মানসকন্যা অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার। ভুগছিলেন দুরারোগ্য ক্যানসারে। কাউকে বুঝতে দেননি সেকথা। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল তাঁকে মজা করে বলতেন 'বাংলা কি বেটি'। বাংলার মেয়ে হলেও তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মানের অভিনেত্রী। সৌন্দর্যে নয়, অভিনয়প্রতিভা এবং ব্যক্তিত্বের জোরে জায়গা করে নিয়েছিলেন দর্শক মনে। তাঁকে জাগোবাংলার শ্রদ্ধাঞ্জলি

Must read

সেই মেয়েটি
তখন আকাশবাণীতে ‘আত্মজা’ নামে একটি নাটক সম্প্রচারিত হয়। সেই নাটকে অভিনয় করত এক ষোলো বছরের কিশোরী। বেতারনাটক, শ্রুতিবিজ্ঞাপনে সেই মেয়ের কণ্ঠাভিনয় অনবদ্য। জগন্নাথ বসু তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর নাটকের প্রযোজক। ‘আত্মজা’ তাঁরই পরিচালনা। রেডিওর পাশাপাশি গ্রুপ থিয়েটারেও অভিনয় করত সে। এমনই একদিন গ্রুপ থিয়েটারের মহড়ায় পৌঁছতে দেরি তার। ছুটতে ছুটতে হাজির সে। হাত তুলে ‍‘আই অ্যাম সরি’ বলতে বলতে ঢুকল। কিন্তু অসন্তুষ্ট দলের সবাই। সময়জ্ঞান নেই। তিরস্কৃত হয়ে একটু অবাকই হল মেয়েটি। কী হল হঠাৎ! দলের সবার সে প্রিয়পাত্রী। তাহলে এমন কী হল যে আজকে তার দেরি করে আসার জন্য সবাই বিরক্ত। হঠাৎ তার নজর গেল অদূরে বসে থাকা এক পক্ককেশ প্রৌঢ়ের উপর।

আরও পড়ুন-মেয়েবেলার খেলা

তাঁর সঙ্গে পরিচালক পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রৌঢ় জিজ্ঞেস করলেন, ‍‘‍‘তুমি আমাকে চেন?’’ কিশোরী বলল, ‍‘‍‘না, আমি উত্তমকুমারকে চিনি, আপনাকে চিনি না।’’ ব্যস, মহড়ার সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‍‘‍‘না না, ও আপনাকে চেনে মৃণালদা।’’ পরিচালক মৃণাল সেনকে দেখে মুখের উপর বলে ফেলেছে সে তাঁকে চেনে না। যদিও বা একটা সুযোগ এসেছিল এবার বুঝি গেল!
কিন্তু কীসের সুযোগ! সেই কিশোরী তো কিছুই জানে না। আসলে তার কণ্ঠাভিনয় মন কেড়েছিল পরিচালক মৃণাল সেন সহধর্মিণী গীতা সেনের। তিনি আত্মজা নাটকটি শুনেছিলেন। এদিকে স্বামী মৃণাল সেন তাঁর পরবর্তী ছবির জন্য একটি শ্যামবর্ণা, বাঙ্ময় চোখের কিশোরী খুঁজছেন। সেই ছবির নায়িকা খোঁজার দায়িত্ব তার কাঁধে। ‍‘আত্মজা’য় মেয়েটিকে শুনে গীতা সেনের মনে হল এই সেই মেয়ে যাকে তাঁরা খুঁজছেন। এরপরেই মৃণাল সেন সরাসরি জগন্নাথ বসুকে ফোন করলেন। মেয়েটিকে চাক্ষুষ করবেন বলে স্বয়ং পৌঁছে গেলেন থিয়েটারের মহড়ায়।
এরপর মৃণাল সেদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তুমি সিনেমা দেখো? কিশোরী জানাল, মা ছবি দেখার অনুমতি দেন না৷ তাই ছবি দেখা হয় না৷ তখন মৃণাল বললেন, তুমি অভিনয় করবে? সে বলল, হ্যাঁ করব। তখন মৃণাল বললেন, তুমি আগে কখনও অভিনয় করেছ? কিশোরী বলল, না করিনি। মৃণাল আবার বললেন, তুমি পারবে? সে বলল, হ্যাঁ পারব। তখন কিংবদন্তি পরিচালক তাকে বললেন, আগামিকাল মাকে নিয়ে আমার বাড়িতে এসো। অতঃপর পরেরদিন মাকে নিয়ে সে পৌঁছল পরিচালকের বাড়ি, সেখানে কথাবার্তা হল। এরপর মৃণাল তাকে তুলে দেন স্ত্রী গীতার হাতে। গীতা সেনই নিজে হাতে গ্রুমিং করেছিলেন তার। সেই কিশোরী আর কেউ নন, সর্বকালের সেরা অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার।

আরও পড়ুন-মেয়েদের কুস্তি কথা

মৃণাল সেনের মানসকন্যা
মাধ্যমিকের আগেই মৃণাল সেনের হাত ধরে অভিনয় জগতে আত্মপ্রকাশ হল এই অনন্যসাধারণ অভিনেত্রীর। মৃণাল সেনের মানসকন্যা শ্রীলা।
১৯৭৯ সালে, তিনি মৃণাল সেন পরিচালিত ‍‘পরশুরাম’ ছবিতে প্রথম অভিনয়। এরপর তাঁর পরিচালনায় ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’, ‘খণ্ডহর’, ‘আকালের সন্ধানে’-র মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন৷ কৈশোরে শ্রীলা বুঝতে পারেননি কার সঙ্গে, কার পরিচালনায় অভিনয় করছেন৷ এমনকী অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার কথাও ভাবেননি৷
আন্তর্জাতিক মানের বেশ কয়েকটি ছবি করার পর ঠিক করলেন তিনি অভিনয় করবেন৷
হিন্দি ছবিতে হাতেখড়ি
ভীষণ ভাল ছিলেন লেখাপড়ায়। দারুণ ইংরেজি উচ্চারণ ছিল তাঁর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বঙ্গবাসী কলেজ থেকে স্নাতক হন। মৃণাল সেনের ছবির হাত ধরেই শ্রীলার কাছে আসতে থাকে বম্বের আর্ট ফিল্মে অভিনয় করার সুযোগ। শ্যাম বেনেগাল থেকে প্রকাশ ঝার ছবির নায়িকা হয়েছিলেন। প্রকাশ ঝার প্রথম ছবি ‍‘দামুল’-এর নায়িকা ছিলেন শ্রীলা মজুমদার। রোলটি প্রথমে করার কথা ছিল শাবানার। জগমোহন মুন্দ্রার ‍‘কমলা’  ছবিতে কাজ করার কথা ছিল তাঁর। রোলটা চলে যায় দীপ্তি নাভালের কাছে। পাশাপাশি বাংলাতেও অপর্ণা সেনের ‍‘পিকনিক’, নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‍‘চপার’, গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ‍‘নাগমতী’ ছবিতে কাজ করেন তিনি। নাগমতী সেরা বাংলা ছবির জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। বম্বেতে শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, দীপ্তি নাভালদের সঙ্গে শ্রীলা মজুমদারের নামটাও আসত সবার মুখে মুখে।

আরও পড়ুন-আর কত বঞ্চিত হব আমরা!

বিনোদিনী শ্রীলা
দারুণ বাচিকশিল্পী ছিলেন শ্রীলা। ‍‘চোখের বালি’ করছেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। ঐশ্বর্যর গলার জন্য তাঁর পছন্দ ছিল শ্রীলাকেই। শুরুতেই এই ডাবিং করতে রাজি ছিলেন না অভিনেত্রী। তবে পরে রাজি হন। চোখের বালি সিনেমায় ঐশ্বর্যর ডাবিং করে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলেন শ্রীলা।
সেরা ৫০ এ
শ্রীলা মজুমদার শুধুমাত্র বাংলার অভিনেত্রী নন, তিনি আন্তর্জাতিক অভিনেত্রী। আশির দশকের শেষে বম্বের ফিল্মফেয়ার পত্রিকা সর্বভারতীয় ৫০ জন সেরা নায়িকার তালিকা প্রকাশ করেছিল। বাংলার থেকে ছিল দু’জন অভিনেত্রীর নাম— একজন সুচিত্রা সেন, অন্যজন শ্রীলা মজুমদার। এতটাই ছিল বম্বের ডিরেক্টরদের কাছে শ্রীলার ক্রেজ।
ঘরে ফেরা
কিন্তু নব্বই দশকে এসেই চিত্রটা বদলে যায়। বম্বের ছবি থেকে কমতে থাকে শ্রীলা মজুমদারের নাম। কমতে থাকে ভাল ছবির সংখ্যা। বম্বের সেই দারুণ ভাল  কেরিয়ার ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন শ্রীলা। আসলে বিয়ে করে বম্বে (অধুনা মুম্বই) ছাড়েন শ্রীলা। মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগালের কাছে বরাবর খুব দুঃখজনক ছিল এই ঘটনা যে শুধুমাত্র বিয়ের জন্য শ্রীলার বম্বে ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সে সময় কেরিয়ারের মধ্যগগনে শ্রীলা, তাঁর কণ্ঠ ছিল সবার কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু হবু স্বামীকে ভালবেসে কেরিয়ারে আপস করেন তিনি। প্রথিতযশা সাংবাদিক লেখক এস এন এম আবদিকে বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী শ্রীলা মজুমদার। দীর্ঘদিন ইংরেজি দৈনিকে সাংবাদিকতা করেছেন আবদি। যদিও আবদি কখনও তাঁর ইচ্ছে শ্রীলার উপর চাপিয়ে দেননি। পরবর্তীকালে স্বামীর সঙ্গে একছাদের তলায় থাকা হয়নি তাঁর। আবদি সাংবাদিকতার কারণে দিল্লিতেই থাকতেন। ফলে সন্তানের পুরো দায়িত্ব একাই সামলাতে হয়েছে শ্রীলাকে। পাশাপাশি সিনেমা থিয়েটার যাত্রা করে গিয়েছেন তিনি। বেশ কিছু মূলধারার ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন শ্রীলা। সেই ছবি মনেও ধরেছিল দর্শকদের। অঞ্জন চৌধুরীর ‘পূজা’, হরনাথ চক্রবর্তীর ‘প্রতিবাদ’ তাঁকে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-৮ ফেব্রুয়ারি পেশ রাজ্য বাজেট

অদম্য মনোবল
গত তিন বছর ধরে মারণ রোগ ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি৷ ভেবেছিলেন একদিন ক্যানসারকে হারিয়ে নজির গড়বেন। তবু শেষরক্ষা হল না। বিশিষ্ট পরিচালক কৌশিক গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘পালান’-এ তাঁকে শেষবারের মতো বড়পর্দায় দেখা গিয়েছিল। ‍‘পালান’ মৃণাল সেনের ‍‘খারিজ’ ছবিরই সিক্যুইল। তাঁর প্রয়াণের পর কৌশিক গঙ্গ্যোপাধ্যায় বলেন, ‍‘‍‘শ্রীলাদি যে এতটা অসুস্থ জানতামই না আমরা। উনি কখনও আমাদের ওঁর অসুস্থতার কথাটা বুঝতে দেননি। উনি কখনও কাজ থেকে বিশ্রাম চাননি, নিজের সবটা উজাড় করে কাজ করে গিয়েছেন। কিন্তু কীভাবে করেছেন সেটা এখন ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’’ এমনটাই ছিল তাঁর মনের জোর।
অধরা রইল স্বপ্ন
কিন্তু কেন কেউ জানতেন না তাঁর এই অসুস্থতার কথা! এই প্রসঙ্গে অভিনেত্রীর স্বামী আবদি জানিয়েছিলেন ‍কাউকে কোনও কিছু না জানানোর সিদ্ধান্ত নাকী শ্রীলার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল। অসুস্থতার কথা কখনও কাউকে সেভাবে বলতেও চাইত না। অনেক সময় নানা শারীরিক সমস্যা এসছে, মনের জোরে সবটা জয় করছেন কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।

Latest article