সব সাধু যে সত্যদ্রষ্টা সন্ন্যাসী হন না, সে-কথা ভালমতোই টের পেয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সকল গেরুয়াধারীর অন্তরাত্মায় যে মানবতার ফল্গুধারা প্রবহমান নয়, সেটা বুঝতেও অসুবিধা হয়নি তাঁর। তাই, তাই-ই, গৈরিক বসন পরিহিত ব্যক্তিমাত্রই সাধু হিসেবে সংজ্ঞায়িত, প্রজ্ঞাবান সন্ন্যাসী হিসেবে অনুসরণযোগ্য নন। অনর্হ সাধুর অভাব নেই আশেপাশে। আজকে তো বটেই। সেদিনও ছিল না।
আরও পড়ুন-আজ ষষ্ঠপর্বে ভোট ৮ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫৮ আসনে, নজর কাড়ছে দিল্লি-হরিয়ানা
১৮৯৮-এর গ্রীষ্মকাল। স্বামী বিবেকানন্দ তখন অমরনাথের যাত্রী। সঙ্গীদের মধ্যে আছেন ভগিনী নিবেদিতাও। সেই যাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে নিবেদিতার লেখা ‘The Master as I saw Him’ গ্রন্থে। গ্রন্থটির বাংলায় অনুবাদ করেছেন স্বামী মাধবানন্দ। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের নবম প্রেসিডেন্ট।
সেই গ্রন্থে অমরনাথ যাত্রার পথে একটি ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে। নিবেদিতা লিখেছেন, স্বামী মাধবানন্দ কৃত অনুবাদে, ‘যাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের শত শত সাধু। তাঁহাদের তাঁবুগুলির রং গৈরিক’। সেই সাধু সম্প্রদায়ের ওপর স্বামীজির ‘অসীম প্রভাব’ চোখ এড়ায়নি নিবেদিতার। তিনি দেখেছিলেন, সাধুদের মধ্যে যাঁরা ‘অপেক্ষাকৃত বিদ্বান’, অর্থাৎ পণ্ডিত সন্ন্যাসীরা ‘প্রত্যেক বিশ্রামস্থলে স্বামীজীকে ঘিরিয়া থাকিতেন’। ‘তাঁহার (বিবেকানন্দের) তাঁবুর মধ্যে সর্বদা ভিড়, দিনের আলো থাকা পর্যন্ত সাধুরা কথাবার্তায় মগ্ন থাকিতেন।’ এই সাধুদের বক্তব্য ছিল, বিদেশি অর্থাৎ ইংরেজরাও ‘মানুষ’। সুতরাং স্বদেশ ও বিদেশের মধ্যে ভেদরেখা টানা অর্থহীন। অথচ এই সাধুদেরই একাংশ ‘মুসলমান ধর্মের প্রতি স্বামীজীর প্রেম ও সহানুভূতির অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিতেন না’। নিবেদিতার স্পষ্ট অনুভব, ‘যে পরলোক চিন্তা স্বদেশ-বিদেশকে অভিন্ন জ্ঞান করাইত, সেই চিন্তাই এই সরলান্তঃকরণ ব্যক্তিগণকে হিন্দু ও মুসলমান যে এক অখণ্ড সত্তার দুইটি পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপ অঙ্গ বিশেষ— এই চিন্তায় বাধা দিত’। মূল ইংরেজিতে, ‘The same other-worldliness that made Swadesh and Bidesh indistinguishable, also prevented these simple souls from formally conceiving of a unity, in which Hindu and Mohammedan were but rival elements.’
আরও পড়ুন-ফের মহিলা ভোটারকে যৌন-নিগ্রহের অভিযোগ জওয়ানের বিরুদ্ধে
বিবেকানন্দের কাছে আসা সাধুদের এরকম ধর্মীয় গোঁড়ামির সংকীর্ণতা, এরকম মুসলমান বিদ্বেষ লক্ষ্য করে নিবেদিতার মতো পাশ্চাত্য থেকে আসা লোকজনের খুব মজা লেগেছিল। কারণ, সেই তীর্থযাত্রার সঙ্গে জুড়ে থাকা ‘বহু কর্মচারী ও ভৃত্য’, এমনকী স্বয়ং তহশিলদার ছিলেন মুসলমান। ‘যথাসময়ে তীর্থস্থানে উপনীত হইয়া তাঁহাদের (মুসলমান কর্মচারী, ভৃত্য ও তহশিলদারের) (অমরনাথের) গুহায় প্রবেশে যে কোনওরূপ বাধা আসিতে পারে, একথা স্বপ্নেও কাহারও মনে উঠে নাই।’ নিবেদিতা আরও জানাচ্ছেন, ওই তহশিলদার ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু বিবেকানন্দের শিষ্য হওয়ার জন্যে পরে এসেছিলেন। ‘এবং এই ব্যাপার কাহারও নিকট বিস্ময়কর (surprising) বা বিসদৃশ (incongruous) বোধ হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না।’
বিবেকানন্দ অহেতুক গোঁড়ামিতে আক্রান্ত ছিলেন না। ইসলামকে তিনি কখনও দূরে সরিয়ে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না। এজন্যই তাঁর অন্যতম শিষ্য ছিলেন মহম্মদানন্দ।
আরও পড়ুন-ধেয়ে আসছে রিমেল মোকাবিলায় কোমর বেঁধেছে কলকাতা পুরসভা
১৮৯৮-এর মে মাসে বিবেকানন্দ নৈনিতাল যান। সেখানে এক মুসলমান ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই ভদ্রলোক স্বামীজিকে কাছে পেয়ে আবেগে ভেসে গিয়ে বলেন, ‘স্বামীজি, যদি ভবিষ্যতে কেউ কখনও আপনাকে অবতার বলে ঘোষণা করে, তাহলে মনে রাখবেন, আমি, যে নাকি মুসলমান, সেই-ই প্রথম।’ এই মহম্মদানন্দকেই বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ঐসলামিক দেহ আর বৈদান্তিক মস্তিষ্কের সমন্বয় ঘটলে ভারতবর্ষ পুনরুজ্জীবিত হবে এবং জগতে সকলের পুরোভাগে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করতে সমর্থ হবে।
এই বিবেকানন্দই দক্ষিণারঞ্জন গুহকে পাঠিয়েছিলেন হৃষীকেশ-হরিদ্বারে, দীক্ষাদানের পর স্বামী কল্যাণানন্দ করে। দক্ষিণারঞ্জন বরিশালের ছেলে। সেবানুরাগ ছিল তাঁর আজন্ম সংস্কার। বিবেকানন্দ পরিব্রাজক জীবনে উত্তরাখণ্ডে বৃদ্ধ ও পীড়িত সাধুদের দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছিলেন। ভারতবর্ষের বহু সাধু-সন্ত, সন্ন্যাসী-উদাসী, বৈরাগী-পরিব্রাজকের দল এই তীর্থভূমিতে আসেন। আসন পেতে বসেন। গঙ্গার তীরে কুঠিয়া তৈরি করে সেখানেই তপস্যায় ডুব দেন। কিন্তু বয়স বাড়লে, অসুখে পড়লে এই নিঃসম্বল সাধুদের দেখাশোনা করার, চিকিৎসা কিংবা সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য কাউকে পাওয়া যায় না। তাই কল্যাণানন্দকে বিবেকানন্দ তাঁদের সেবা করার জন্য হরিদ্বারে পাঠিয়ে দিলেন।
আরও পড়ুন-টানা ১২ দিন অনশনে অসুস্থ হাসপাতালে মমতাবালার কন্যা
১৯০১-এর জুন মাসে কনখলে এসে পৌঁছলেন কল্যাণানন্দ। মাসিক তিন টাকা ভাড়ায় দু’খানা ঘর নিলেন। ওই দুটো ঘরেই চালু হল অসুস্থ সাধুদের জন্য চিকিৎসা, পাতা হল তাঁদের রোগশয্যা, আর কল্যাণানন্দের নিজের থাকা-খাওয়া সেখানেই, ওই দুটো ঘরেই। রোজ সাধুদের কুঠিয়ায় কুঠিয়ায় ঘুরতেন। পীড়িত বা বৃদ্ধ সাধুদের খোঁজখবর নিতেন। দরকার পড়লে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দিতেন। প্রয়োজন বুঝলে নিয়ে চলে আসতেন ওই দু-কামরার আশ্রয়ে। রোগীদের পথ্য তৈরি করতেন নিজের হাতে আর নিজের দেহটা টিকিয়ে রাখতে পুরোপুরি নির্ভর করতেন মাধুকরী ভিক্ষার ওপর।
এই সেবাকর্ম কনখল থেকে ছড়িয়ে পড়ল হৃষীকেশেও। স্বামীজির নির্দেশে কল্যাণানন্দকে সাহায্য করার জন্য এলেন তাঁরই আর এক গুরুভাই, স্বামী নিশ্চয়ানন্দ। সন্ন্যাসী ভ্রাতৃদ্বয় নিজে হাতে রোগীর মল-মূত্র সাফ করতেন, পথ্য তৈরি করতেন, ওষুধ আর পথ্য নিজেদের হাতে রোগীদের খাওয়াতেন।
আর হরিদ্বারবাসী গেরুয়াধারী গোঁড়া হিন্দু সন্ন্যাসীর দল ওই দুই বিবেকানন্দ-শিষ্যকে ব্যঙ্গ করে বলতেন, ভাঙ্গী সাধু। তাঁদের বক্তব্য, অন্যের পেচ্ছাপ-পায়খানা পরিষ্কার করাটা সর্বকর্মত্যাগী সন্ন্যাসীর কর্তব্য নয়। বেদান্তের উচ্চতম আদর্শের কথা আওড়াতে এঁদের বাধত না, নিজেরা অসুস্থ হলে বা বেকায়দায় পড়লে অন্যের সেবা নিতে এইসব গেরুয়াধারীদের আটকাত না, কিন্তু অন্যকে সেবা করবার বেলায় এইসব সাধুরা সকলে নিষ্ক্রিয় ‘আত্মারাম’ হয়ে বসে থাকতেন।
আরও পড়ুন-বিধায়ক থাকবেন, সভায় আসবেন না! তৃণমূলে দল আসল, ব্যক্তি নয় : নেত্রী
এই গেরুয়াধারীদের সমাজে আক্ষরিক অর্থে ব্রাত্য ছিলেন স্বামী কল্যাণানন্দ এবং স্বামী নিশ্চয়ানন্দ। তাঁদের অপরাধ, তাঁরা তাঁদের গুরু স্বামী বিবেকানন্দের কথামতো পীড়িত ও অসহায়দের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। এই অবস্থা বদলাল হৃষীকেশের কৈলাস মঠের মণ্ডলীশ্বর স্বামী ধনরাজ গিরির সৌজন্যে। তিনিই প্রথম দশনামী সাধুদের ভাণ্ডারায় (সাধুমণ্ডলীর সমাবেশকে ‘ভাণ্ডারা’ বলা হয়) কল্যাণানন্দ আর নিশ্চয়ানন্দকে আমন্ত্রণ করে এনে নিজের পাশে বসান।
ধ্যান আর সেবা এক তালে চালিয়েও কল্যাণানন্দরা সহ-সাধুদের সহানুভূতি বা সাহায্য পাননি। গেরুয়া পরলেই যে সাধু হাওয়া যায় না, সব সাধু তাই সত্যিকার অর্থে সাধু নন, এটা না-মেনে উপায় নেই।
স্বামী বিবেকানন্দ অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কারণ, তিনি সম্প্রদায়বিহীন আধ্যাত্মিক অনুশীলনে আস্থাবান ছিলেন। ১৮৯৭-তে পাশ্চাত্য থেকে ফিরেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর সঙ্গে দেখা করে প্রণতি জ্ঞাপন করলেন শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী। ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ দুর্গাচরণ নাগের সান্নিধ্যে এসে জেনেছেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের কথা। এহেন শরচ্চন্দ্রের সঙ্গে বিবেকানন্দের এক দিনের কথোপকথন এরকম :
শিষ্য : মহাশয়, প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায়েই দেখা যায় কোনো-না-কোনো বাহ্য উৎসব-আমোদ আছে। কিন্তু কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। এমন যে উদার হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম, তার মধ্যেও ঢাকা শহরে দেখেছি শিয়া-সুন্নিতে লাঠালাঠি হয়।
স্বামীজী : সম্প্রদায় হলেই এটা অল্পাধিক হবে। তবে এখানকার (রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের) ভাব কী জানিস? – সম্প্রদায়বিহীনতা। আমাদের ঠাকুর (রামকৃষ্ণ) ওইটেই দেখাতে জন্মেছিলেন। তিনি সব মানতেন-আবার বলতেন, ‘ব্রহ্মজ্ঞানের দিক দিয়ে দেখলেও এ-সকলই মিথ্যা মায়া মাত্র।
বিবেকানন্দের সমগ্র জীবন ও সাধনা এই ভাবকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। পাঁচ বার নামাজ পাঠ বা ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী-পাঠ কোনওদিন বিবেকানন্দের জীবন চেতনার ভিত ছিল না।
আরও পড়ুন-হলদিয়ায় প্রবল বিক্ষোভের মুখে চাকরিখেকো চাকরিচোর শুনতে হল প্রাক্তন বিচারপতিকে
বারবার বলতেন, ‘আমি একজন রাজনীতিক নই, অথবা রাজনৈতিক আন্দোলনকারী নই।’ [বাণী ও রচনা, সপ্তম খণ্ড, পৃ. ১৫] । ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, নিজে পূর্ণ স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, ছিলেন জনজীবনে স্বাধীনতার পূর্ণ প্রেরণাস্বরূপ। তাও কেন রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ?
সম্ভাব্য কারণ দুটি।
এক, সন্ন্যাসীর কাছে ঈশ্বরই সত্য। আধ্যাত্মিক আলোকে মানুষের মনের অজ্ঞানতা দূরীকরণই প্রকৃত সন্ন্যাসীর কর্তব্য। অন্য কিছু নয়। এটা তিনি মানতেন।
দুই, দেশের ভাল মন্দ, স্বাধীনতা-পরাধীনতা দেশবাসীর ওপর নির্ভর করে। ‘You can only get the government you deserve, and no better.’ এটা তিনি জানতেন। সুতরাং, সরকার গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জুড়ে থাকা রাজনীতিতে মনোনিবেশ না-করে সাধুর উচিত man-making বা মানুষ তৈরির প্রক্রিয়ায় মন দেওয়া। এমনটাই মনে করতেন তিনি। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে সরকার গঠন নয়, ‘মানুষ’ তৈরি করে জাতি গঠন বেশি জরুরি। সুতরাং সার্থক সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি সেটার ওপরেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আরও পড়ুন-অনাবৃষ্টি মুর্শিদাবাদের পানচাষিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে
এই কথাগুলো আজ আমাদের সবার, এমনকী সাধু সমাজেরও মনে রাখা এবং মেনে চলা দরকার।
‘চিনি না জানি না বুঝি না তাঁহারে, তথাপি তাঁহারে চাই। / সজ্ঞানে অজ্ঞানে পরানের টানে, তাঁর পানে ছুটে যাই।’ —এইসব গানের কলির আড়ালে নিজেদের অসম্পূর্ণতা লুকিয়ে রেখে শুধু বিবেকানন্দের মূর্তি আর ছবিতে ফুল-মালা দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না। একথাটা সাধু কিংবা গৃহী, সব ভারতীয়ের বোঝার ও সকল ভারতীয়কে বোঝানোর সময় এসে গিয়েছে।