মাননীয় পদ্মপাল! আপনার অতি-সক্রিয়তা অসাংবিধানিক ও অশুভ

ভাঙড়, বাসন্তী, ডোমকল, কাটোয়া, চাপড়া, রানিনগর, দিনহাটা, রতুয়া, গাজোল। মোটামুটি এটাই পঞ্চায়েত ভোট-পর্বে বাংলায় হিংসার ভূগোল। কিন্তু পদ্মপাল ও লোডশেডিং অধিকারীর লম্ফঝম্প দেখে ও ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির ‘গেল গেল’ রব শুনে মনে হচ্ছে সুজলা সুফলা বঙ্গজননী আজ আপাদমস্তক শোণিত-সিক্তা। নিন্দাবাদের বৃন্দগানে গলা মিলিয়েছে মিডিয়ার একাংশ। অভিযোগের আঙুল তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে আবার, কী আশ্চর্য, ঘটনার বলিও তৃণমূল কংগ্রেস! মিথ্যাচারের এই আবহ তৈরি করে পর্দার আড়ালে অনির্বাচিত একজন স্বৈরশাসন নামিয়ে আনতে তৎপর। সেই সত্য উন্মোচনে দেবাশিস পাঠক

Must read

কথাটা বলেছিলেন অরুণ জেটলি। বিজেপির নেতা। ‘Democracy cannot be tyranny of the unelected.’ অস্যার্থ গণতন্ত্র কদাচ ‘অনির্বাচিতের স্বৈরতন্ত্র’ হতে পারে না। প্রয়াত বিজেপি নেতার কথাটাই আজ মনে পড়ছে বিজেপির সৌজন্যে। রাজ্যপালকে পদ্মপালে পরিণত করে কেন্দ্রের বিজেপি শাসকরা রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা সৃষ্টির মতলব আঁটছেন।

আরও পড়ুন-পাল্টে যাচ্ছে বন্দেভারতের রং, কেন গেরুয়া

তাঁরা ভুলে গেছেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত কেউ নন। তিনি নামসর্বস্ব শাসক-প্রধানমাত্র। তিনি যা যা করে বেড়াচ্ছেন সেগুলো তাঁর অতি সক্রিয়তার লক্ষণ, রাজ্যের স্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকা নয়।
কেন্দ্রে ও অঙ্গরাজ্যে একই রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থাকলে রাজ্যপাল নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীর ক্রীড়নকে পরিণত হন। পক্ষান্তরে, কেন্দ্রে ও রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার ক্ষমতাসীন হলে অবস্থা অন্যরকম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাজ্যপাল তখন কেন্দ্রের ওপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্ট রাজ্যপাল প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সকল বিষয়ে যোগাযোগ করে কাজকর্ম পরিচালনা করেন। ১৯৬৭ সালে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে অ-কংগ্রেসী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে এমনটা হয়ে আসছে। এরকম প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল ইদানীং দৃষ্টিকটুভাবে কেন্দ্রের প্রতিনিধির ভূমিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হয়েছেন। এরকম অতি-সক্রিয়তা রাজ্যে সাংবিধানিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। আমাদের আশঙ্কার কারণ সেটাই।
রাজ্যপাল সাংবিধানিক পদ। তিনি রাজনৈতিক দলের হয়ে ভোটপ্রচার করতে পারেন না। অথচ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কোচবিহারে গিয়ে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ভোটের রণনীতি ঠিক করে দিচ্ছেন। তিনি এটা করতে পারেন না।

আরও পড়ুন-এল না বাহিনী, এবার তবে দায় কার?

একাধিক বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত বা আদালতের রায়ে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাজ্যপাল মন্ত্রিসভার পরামর্শে কাজ করবেন। সুনীলকুমার বসু বনাম পশ্চিমবঙ্গ সরকার (১৯৫০) মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট মন্তব্য করেছিল যে, রাজ্য মন্ত্রিসভার পরামর্শ ব্যতীত রাজ্যপালদের কাজ করার ক্ষমতা নেই। রাম জাওয়া কাপুর বনাম পাঞ্জাব রাজ্য মামলা (১৯৫৫)-তেও সুপ্রিম কোর্ট অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছিল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারে নাক গলানো উল্লিখিত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার পরিধিতে পড়ে না। অথচ, সি ভি আনন্দ বোস সেটাই দু সপ্তাহ ধরে করলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে কাব্যসুষমামণ্ডিত বয়ান শোনালেন। মহাকবি শেক্সপিয়রের আশ্রয় নিলেন। ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকের চরিত্র এরিয়েলকে উদ্ধৃত করে বললেন, “নরক এখন শূন্য। সব শয়তান এখানে উঠে এসেছে।” নাটকটির প্রথম অংকের দ্বিতীয় দৃশ্যের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমরাও বহুলাংশে একমত।

আরও পড়ুন-রোমাঞ্চকর মোড়ে দাঁড়িয়ে হেডিংলে

শয়তানের দল নরক ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে বলেই না গতকাল পঞ্চায়েত ভোট চলাকালীন দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের শুকদেবপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের জয়দেবপুর নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে ১৭৫ এবং ১৭৫-এ বুথে ব্যালট বাক্সে জল ঢেলেছে বিজেপি। কোচবিহারের এক নম্বর ব্লকের চাত্রাচেকা ডারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৮০ নম্বর বুথে ভোট চলাকালীন বিজেপির আশ্রয়ে থাকা দুষ্কৃতীরা এসে ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। ব্যালট পেপার লুট করে। স্কুলের মাঠে ব্যালট বাক্স ভাঙা হয়। ভাঙড়ের জামিরগাছি এলাকায় আইএসএফের দুষ্কৃতীরা ব্যাপক বোমাবাজি চালায়। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর মালিওর এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কংগ্রেসের সমাজবিরোধীরা গুলি চালায়। উত্তর দিনাজপুরের চাপড়ার কল্যাণদহে তৃণমূল কর্মীকে কুপিয়ে খুন করে কাটা হাত আর কাস্তে হাতুড়ি তারার জল্লাদরা। মৃতের নাম আমজাদ হোসেন। কোচবিহারের দিনহাটার এক নম্বর ব্লকের ৮৪ নম্বর বুথ বড়নাচিনা এলাকায় ব্যালট বাক্সে আগুন ধরিয়ে দেয় বিজেপির কর্মীরা।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

মানিকচকে নুরপুরের ৫২ নম্বর আসনে নুরপুর পাঠানপাড়া জুনিয়র বেসিক স্কুলে ভোট লুট করে বাম-কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরা। কাটোয়ার সিপিএমের হরিনারায়ণ সামন্ত তৃণমূল কংগ্রেসের বুথ এজেন্ট গৌতম রায়ের ওপর লাঠি-বাঁশ নিয়ে চড়াও হন। ঘটনাস্থলেই জ্ঞান হারান তৃণমূলের বুথ এজেন্ট। তৎক্ষণাৎ তাঁকে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত বলে ঘোষণা করেন। বাসন্তীর ফুলমালঞ্চের তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী আনিসুর ওস্তাগর ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় আচমকা ছোঁড়া বোমার আঘাতে মারা যান। মুর্শিদাবাদের রেজিনগর থানার নাজিরপুরে মৃত্যু হয়েছে ইয়াসিন শেখ নামে এক তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীর। দুষ্কৃতীদের বোমায় মৃত্যু হয়েছে ইয়াসিনের। ভোটের সকালে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামেও তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী সাবিরুদ্দিন শেখের দেহ উদ্ধার হয়। শনিবার ভোর ৩টে নাগাদ খড়গ্রাম থানার রতনপুর নলদ্বীপ গ্রামে সাবিরুদ্দিনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করে কংগ্রেস-আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। এই উত্তর সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত যাঁরা বাংলাকে নরক করতে চাইছে তাঁদের সৌজন্যে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান ও উত্তর দিনাজপুরে কমপক্ষে ছয়জন তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী খুন হয়েছেন।

আরও পড়ুন-আলিপুরদুয়ারের ভুটিয়া বস্তিতে ভোটকর্মীদের অদম্য লড়াইয়ে জয়, হড়পা বানে ভেসে গেল বুথ, বিকল্প কেন্দ্রেই হল ভোট

আর বঙ্গরঙ্গের মুখ্য অভিনেতা, রাজ্য বিজেপির প্রধান পৃষ্ঠপোষক শনিবারেই বারাসতে বাজার গরম করতে গিয়েছিলেন। ওদিকে তিনি রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্য পদে একজন প্রাক্তন বিচারপতিকে নিয়োগ করেছেন যাঁর কাজকর্মে অতিষ্ঠ হয়ে বেঙ্গালুরুর অ্যাডভোকেট অ্যাসোসিয়েশন কর্নাটক হাইকোর্ট থেকে ওই বিচারপতির বদলি চেয়ে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখেছিল। এবং যিনি কর্নাটক হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থাকার সময়, ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির সুরে সুর মিলিয়ে টিপু সুলতানের জন্মবার্ষিকী পালনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

আরও পড়ুন-আরামবাগে আক্রান্ত কর্মীদের পাশে সাংসদ

সংবিধান বিশেষজ্ঞ এম ভি পাইলির মতে, রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা খুশিমতো ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ, একনায়কতন্ত্রের শামিল এবং সেজন্য সংবিধানের মূল প্রকৃতির বিরোধী। একই মত আর এক সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসুর। আর আম্বেদকর মনে করতেন, ‘স্বেচ্ছাধীন’ কথাটি রাজ্যপালের কর্তব্য সম্পাদনের সঙ্গে সংযুক্ত, কার্যসম্পাদনের সঙ্গে সেটা কোনওভাবেই যুক্ত হতে পারে না। উপাচার্যের নিয়োগ কোনও মতেই রাজ্যপালের কর্তব্য-পালন সংক্রান্ত বিষয় নয়, নেহাতই কার্য সম্পাদন সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়।
পুরো বিষয়টা বোঝা যাচ্ছে। চেনা যাচ্ছে ষড়যন্ত্রকারীদের।
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

Latest article