ভারতে গণতন্ত্রের সলিলসমাধি

নানা তামাশার গলিঘুঁজিতে পথ হারিয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। সৌজন্যে মোদি সরকার। গুজরাত গণহত্যার নায়করা এখন সংসদের ভিতরে বাইরে বিরোধী কণ্ঠরোধ করে, সাংবিধানিক সত্তাকে দুমড়েমুচড়ে, সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ তৈরি করে ভারতীয়ত্বের সংজ্ঞা পুনর্নির্মাণে ব্যস্ত। লিখছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু

Must read

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে শাসকদল। প্রশ্ন উঠবেই, হঠাৎ বিশেষ অধিবেশন ডাকা হল কেন? কেনই বা বিরোধী দলগুলির পক্ষে এই বিশেষ অধিবেশনে কী কী বিষয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন, তার একটি তালিকা জমা দেওয়া হলেও, সে-বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কোনও উচ্চবাচ্য করলেন না? এত গোপনীয়তা কীসের? বহু পরে সরকারি ভাবে কর্মসূচি জানানো হলেও অন্ধকার দূর হল না। গণতন্ত্রের মূল কথা হল, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে শাসন।

আরও পড়ুন-আজ সুনীলদের সামনে বাংলাদেশ, দলের পাশেই স্টিমাচ

এককথায় দেশ কীভাবে চলবে সেই পদ্ধতি সম্বন্ধে নাগরিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা। এখানে কী হল? একটি বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করার আগে বিরোধী দলের সংসদীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করারও প্রয়োজন বোধ করল না সরকার পক্ষ। এর ফলে আলোচনার ভিত্তিতে গণতন্ত্রের ধারণাটিকেই প্রহসনে পরিণত করা হল। সকলেই জানেন, বর্তমান সংসদে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই কারণে বিরোধী বা শরিক কোনও পক্ষের মতামতের ধার না ধেরে বিজেপি দেশ পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু যা পারা যায় তার সবটাই উচিত নয়। বিরোধী পক্ষকে অবজ্ঞা করার যে কু-অভ্যাসটি বিজেপি রপ্ত করেছে তা অত্যন্ত খারাপ এবং অনুচিত।

আরও পড়ুন-বাকি ২৯ দিন, চাহিদা বাড়ছে ছোট দুর্গার, আশায় মৃৎশিল্পীরা

বিরোধী পক্ষ সংসদে যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলি চাইছে, সরকার পক্ষ সেসব বিষয়ে উচ্চবাচ্য করছে না। বিজেপি সংসদে এটা প্রমাণ করেছে যে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই এখানে আলোচনা হয় না। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিল বস্তুত বিনা আলোচনায় পাশ হয়ে যায়। এর আগে শুধু অধ্যাদেশ জারি করে দেশ পরিচালনাকে একটা নিয়মে পরিণত করা হয়েছিল। পার্টিসিপেটরি ডেমোক্র্যাসির ধারণাটিকে অত্যন্ত সচেতনভাবে অবজ্ঞা করতে শাসকদের কোনও দ্বিধা নেই। দেশের স্বার্থেই যে বিষয়ে আলোচনা দরকার, সরকার পক্ষকে সেই আলোচনায় রাজি করানোও কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ হোক বা চিন কর্তৃক ভারতীয় জমি দখলের অভিযোগই হোক। কোনও প্রশ্নই সরকার আলোচনা করতে নারাজ। ফলে সংসদকেই অবান্তর করে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন-আগামিকাল কি ফের কি জেগে উঠবে প্রজ্ঞান?

দেশের নাম নিয়ে কোনও সমস্যা আছে বলে এতকাল দেশবাসী জানত না। সবাই জানত, যা ইন্ডিয়া তাই ভারত। দুই নামই ব্যবহার হয়েছে। তাতে কারও কোনও অসুবিধার কথা কখনও শোনা যায়নি। হঠাৎ ২৬টি বিরোধী দলের জোট ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্টাল অ্যালিয়ান্স— INDIA, গত জুলাই মাসে গঠন হওয়ার পরেই নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির মাথায় যেন বাজ পড়ল। কংগ্রেস-টিএমসি-সহ ২৬টি অ-বিজেপি দল ইন্ডিয়া জোট গঠন করার সঙ্গে সঙ্গে মোদির অবস্থা হল, ‍‘রেগে আগুন, তেলে-বেগুন’-এর মতো। তিনি এখন দেশের নতুন নামকরণ চান। ‍‘ইন্ডিয়া’র বদলে ‍‘ভারত’। এ এক প্রতিহিংসার তাড়না! এই বিতর্ক সম্পূর্ণ নিরর্থক এবং অভিসন্ধিমূলক। সবাই জানে, সংবিধানের প্রথম ধারাটিতেই লেখা হয়েছে— ‍‘India, that is Bharat, Shall be a Union of States’। জি-২০ সম্মেলনে বিদেশিদের কাছে ‍‘Bharat’ নামটিকে একমাত্র করে ফেলা হল। কোনও আলোচনা হল না। দেশের রাষ্ট্রপতি বিদেশি প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণলিপিতে লিখলেন— ‘প্রেসিডেন্ট অফ ভারত’। সম্মেলনকক্ষে মোদির সামনে বড় করে লেখা হল—‍ ‘Bharat’। কোথাও কোনও আলোচনা হল না। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, সংবিধানকে অগ্রাহ্য করে কেবলমাত্র গোঁয়ারতুমির বলে ‍‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি বাদ দেওয়া কোন গণতন্ত্রের নমুনা? কথায় আছে, ‍‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। মোদি উলটোটাই করে চলেছেন। একে বলে ‍‘তুঘলকি’ কাণ্ড। নোটবন্দি, প্রস্তুতিবিহীন জিএসটি, একের পর এক আলোচনাহীন আইন প্রণয়ন এবং প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মৌন থাকা— ইত্যাদির মাধ্যমে সংসদীয় রীতিবিরুদ্ধ কাজেই তিনি অভ্যস্ত।

আরও পড়ুন-কাতালোনিয়া ও বাংলার টিমের বৈঠক

আমরা ভুলে যাইনি, ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার ঘটনা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলা মুসলিমদের পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। মুসলিমদের অপর করে দেওয়ার কর্মকাণ্ড মোদি জমানার বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে ইডি-সিবিআই লাগিয়ে দেওয়া, ছাত্র-ছাত্রী, অধিকার রক্ষার কর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিক-সহ অনেককেই দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখাও মোদি জমানার দস্তুর।
নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পুলিশ ও হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণ, ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের পুনর্লিখন, অ্যামেনস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখা বন্ধ করে দেওয়া, বিবিসির ভারতীয় অফিসে পুলিশ পাঠানো, নাগরিক সমাজের কর্মী, সাংবাদিক এবং সরকারের সমালোচনাকারীদের বিমানবন্দর থেকে ফেরত নিয়ে আসা এবং বিদেশি ও ভারতীয় শিক্ষাবিদদের উপর চাপ দেওয়া ইত্যাদি কাজে মোদি জমানার অত্যাচারী ভূমিকা ফ্যাসিবাদের কথাই স্মরণ করায়।

আরও পড়ুন-বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে অর্থ দফতর, কােষাগার থেকেই বেতন উপাচার্যদের

বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারতের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬৯তম স্থানে। মূল ধারার ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলিকে সরকারি প্রচার মাধ্যমে পরিণত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে ‍‘ইন্ডিয়া’ জোট জাতীয় স্তরের ১৪ জন সাংবাদিক ও মোদি ভক্ত অ্যাঙ্কারকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উত্থিত তরবারি হাতে হিংসাশ্রয়ী হিন্দুত্ববাদী আক্রমণকারীদের প্রকাশ্য-হুমকি শোনা যাচ্ছে মুসলিম হত্যা ও মুসলিম নারীর ধর্ষণের পক্ষে। কাশ্মীরের মানুষ যেভাবে এখনও পুলিশ-মিলিটারির বুটের নিচে জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছেন, একবিংশ শতাব্দীতে তা চিন্তাও করা যায় না।

আরও পড়ুন-কেন্দ্রের তুঘলকি আচরণে ভবিষ্যতে চিকিৎসকদের মান নিয়ে সংশয়

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে যেভাবে মুসলিমদের বঞ্চনা করা হয়েছে এবং ধর্মকে নাগরিকত্বের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তা মুসলিমদের দেশছাড়া করার পরিকল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। দিল্লির দাঙ্গা, মণিপুরের জাতিদাঙ্গা, হরিয়ানায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার মাধ্যমে মুসলিমদের ভয় পাওয়ানো হচ্ছে। এ-সবই প্রমাণ করে ভারতে গণতন্ত্রের সলিলসমাধি হয়েছে। বিপরীতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে।
ইতিমধ্যে ‍‘এক দেশ এক ভোট’-নিয়ে মোদি সরকার যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে তার ফলে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে হলে দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের জায়গা নেবে রাষ্ট্রপতি-শাসিত নির্বাচনের ব্যবস্থা। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে যাবে। এতে সংবিধানের ব্যাপক রদবদল ঘটাতে হবে। এক দেশ এক পরিচিতি, এক দেশ এক শিক্ষা, এক দেশ এক দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক ডিজিটাল লাইব্রেরি— এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই গণতান্ত্রিক বহুত্বের সলিলসমাধির ব্যবস্থা।

Latest article