বিলীন হয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। ক্রমশ শূন্য হচ্ছে আসর। ফিকে হচ্ছে মূর্ছনা। বেদনা ঠিকরে পড়ছে সেই সমৃদ্ধ আসরের একনিষ্ঠ শ্রোতা ছিলেন যাঁরা, তাঁদের হৃদয় থেকে। এ যেন শুধু হারানোর দিনকাল। গত এক বছর যাবৎ সংগীত জগতে নক্ষত্র পতন যেন রুটিন হয়ে পড়েছে। এবার চলে গেলেন সুরকার স্বপন সেনগুপ্ত। গত ১৬ অক্টোবর মুম্বইয়ে নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। একটা দীর্ঘ সময় বলিউড শাসন করেছেন বাঙালি সুরকার-গীতিকার এবং গায়ক-গায়িকারা। তাঁদের সৃষ্ট সুরের জাদুতে মাত হত আপামর ভারতবর্ষ। স্বপন সেনগুপ্ত ছিলেন সেই উজ্জ্বল সময়ের এক অংশীদার। জুটিতে খ্যাত হয়েছিলেন তিনি। জগমোহন বক্সি ও স্বপন সেনগুপ্ত একযোগে সুরের কাজ করতেন! পরিচিত ছিলেন স্বপন-জগমোহন নামে। জুটির একজন, জগমোহন আগেই চলে গেছেন ১৯৯৯ সালে। অসম্ভব ব্যথা পেয়েছিলেন, অন্যজন সে সময়। আর এবার নবতিপর শিল্পী নিজেই পাড়ি দিলেন সুরলোকে। ভারতের চলচ্চিত্র-সংগীতের একটি অধ্যায়ের অবসান হল।
আরও পড়ুন-সিত্রাং : নিরঞ্জনে বিধি ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনাও
দীপ্তিময় সেই অধ্যায়ের শুরুটা হয়েছিল অতি সাধারণভাবে। ভাবেনওনি যে গানে সুর দেবেন কিংবা তার জন্য পাড়ি দেবেন একেবারে পুব থেকে সুদূর পশ্চিমে। বাংলাদেশের ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্বপন সেনগুপ্ত। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে একেবারে শৈশবেই ওপার বাংলা ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়। সংগীতের প্রতি টান ছিল আজন্ম। প্রথম দিকে লোকগান, ভাওইয়া গানের বেশি ভক্ত ছিলেন। এমনকী সে নিয়ে চর্চা, গবেষণাও করবেন ভেবে ফেলেছিলেন। কিন্তু পথ তৈরি ছিল অন্য জায়গায়। সরাসরি মুম্বই থেকে ডাক পেয়েছিলেন সলিল চৌধুরীর ‘ইয়ুথ কয়্যার’-এ যোগদানের। গানের টানে সব ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বই। কোরাসে গাইতেন তিনি। সেখানেই আলাপ হয় জগমোহন বক্সির সঙ্গে। সংগীত গড়ে দেয় অটুট বন্ধুত্ব। জুটি বাঁধেন দু’জন।
আরও পড়ুন-এলিজিবিলিটি টেস্ট পাশ মানেই চাকরি নয়
বছর দশেক আগে এক সাক্ষাৎকারে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মিউজিক জগৎ থেকে কি অবসর নিয়ে নিয়েছেন উনি? আর কেন গান বাঁধেন না? অমায়িক হেসে তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়েছিলেন, “নিতে বাধ্য হয়েছি! এক তো আর কেউ আসে না। আর আমিও এখন যে মিউজিক চলে তা বানাতে পারব না!” প্রায় একইসঙ্গে, প্রচ্ছন্ন গর্বের মিশেলে সোজা-সাপটা জানান, “কলকাতায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের শিষ্য ছিলাম আমি। প্রায় সারাদিন পড়ে থাকতাম তাঁর বাড়িতেই। সংগীতের তালিম তাঁর হাত ধরেই জোরকদমে চলত। তারপর বম্বে চলে আসার পর আলাপ হয় শচীন দেব বর্মন সাহেবের সঙ্গে। কীভাবে কোথায় প্রথম আলাপ হয়, তা আজ আর মনে নেই কিন্তু তাঁর সহকারী হিসেবে আমি আর জগমোহন দীর্ঘদিন কাজ করি। এতটাই হৃদ্যতা ছিল যে কোনও কাজ আমাকে ছাড়া করতেন না। অন্দরমহলে যাওয়ার অনুমতি কারও ছিল না, কিন্তু আমাকে বলতেন, গান যখন বাঁধব সামনে থাকবি! কোথাও যাবি না! খিদে পেলে ভেতরে গিয়ে ভাবীর কাছ থেকে খেয়ে আসবি! তাই এদের কাছে সংগীতে হাতে খড়ি হওয়ার পর এখন যে ধুম ধুম ধুম ধুম মিউজিক হয় তা করতে পারব না!”
আরও পড়ুন-একটু উন্নতি, কালীপুজোর আগেই ফিরছেন অভিষেক
পাঁচের দশকে কেরিয়ার শুরু করেন মুম্বইয়ে। একটানা কাজ করেন কয়েক দশক। হিন্দি-বাংলা উভয় ইন্ডাস্ট্রিতেই সমান দড় ছিলেন। শতাধিক গানে সুর দিয়েছেন আবার কখনও কখনও নিজেরাও গেয়েছেন নিজেদের সুর করা গানে। তাবড় তাবড় শিল্পীরা তাঁদের তৈরি গান গেয়েছেন একেক দশকে। তার মধ্যে যেমন আছেন লতা মুঙ্গেশকর, কিশোরকুমার, আশা ভোঁসলে, মহম্মদ রফি, মুকেশ তেমনই আছেন সুরেশ ওয়ারেকর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, কুমার শানু, মহম্মদ আজিজ, অনুরাধা পাডোয়ালের মতো শিল্পীরাও। এই জুটির অন্যতম হিট ছবি ছিল, ‘জমির’ (১৯৭৫)। ছবিতে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন, বিনোদ খান্না, শামি কাপুর, সায়রা বানু। শুধু যে হিন্দিতে, তা নয়। বাংলাতেও এই সুরকার জুটির সঙ্গে এইসব শিল্পীর একাধিক হিট গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। যেমন, ‘লালকুঠি’ ছবির অবিস্মরণীয় গানগুলি। ‘কে যায় রে’, ‘তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই’, ‘চলে যেতে যেতে দিন বলে যায়’ গানগুলি আজও সমান জনপ্রিয়। গানে সুর দেওয়ার পাশাপাশি ছবিতে আবহের কাজও করতেন তাঁরা। শতাধিক হিন্দি ছবিতে কাজ করেছেন সব মিলিয়ে। বাংলায় প্রায় চল্লিশটি সিনেমায় সুর দিয়েছেন এই জুটি। এস ডি বর্মণের পরে ছেলে রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গেও একাধিক উল্লেখযোগ্য ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন স্বপন সেনগুপ্ত।
আরও পড়ুন-আসছে ঘূর্ণিঝড়, কৃষকদের সতর্ক করে জারি বিজ্ঞপ্তি
শুধু হিন্দি বা বাংলা নয়, স্বপন-জগমোহন জুটি সুর দিয়েছিলেন ভারতের একাধিক ভাষার গানে। পাঞ্জাবি, ভোজপুরি, তামিল, ওড়িয়া যার মধ্যে অন্যতম। কয়েকমাস আগেই পূর্ণ করেছিলেন নব্বই বছর। সেই জন্মদিন তাই ধুমধাম করে পালন করেছিলেন পরিবারের সকলে। আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলিউডের সঙ্গে যুক্ত অনেককেই। সকলের সঙ্গে কথা বলা, কেক কাটা, সামান্য খাওয়া সবই করেছিলেন সজ্ঞানে। কিন্তু এরপর থেকেই শরীর অল্প-বিস্তর খারাপ হতে শুরু করেছিল। শেষ পর্যন্ত ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। সংগীত জগৎ একাধারে যেমন বিষাদগ্রস্ত তেমনই স্মৃতিকাতর। তাঁর মায়া-ভরা সুরের অনুরণন সংগীতপ্রেমীদের মনে ও মস্তিষ্কে থেকে যাবে আজীবন।