স্বামীজি বুঝি এই ভারত চেয়েছিলেন!

বিবেকানন্দের স্বপ্নের ভারত কি বর্তমান ভারত? এই অসহিষ্ণু, বিভাজনের মন্ত্রে বিদ্বিষ্ট ভারতীয় সমাজ কি স্বামীজির স্বপ্নের ভুবন? বোধহয় তা নয়। লিখছেন আকসা আসিফ

Must read

গতকালই চলে গেল স্বামী বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) ১৬২তম জন্মবার্ষিকী। আজ এই দেশে স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে টানাটানি চারিদিকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা স্বামীজিকে তাঁদের দলের লোক বলে প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। বিবেকানন্দের মূর্তি প্রয়োজন ও সুযোগমতো প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা ঘোষণা করতে ব্যস্ত যে, বিবেকানন্দের গৈরিক বস্ত্রের সঙ্গে তাঁদের গৈরিকীকরণ যজ্ঞের গভীর যোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের আবেগকে উসকে তোলার জন্য বিবেকানন্দের ছদ্ম-মুখোশে মুখ ঢাকতে চাওয়া ও বিবেকানন্দের ছদ্মঢাল সামনে রাখার কার্যক্রম ইদানীং সর্বত্র চোখে পড়ে। বিবেকানন্দের আদর্শের সঙ্গে প্রকৃত সম্পর্কবিহীন এই রাজনৈতিক কৌশল নিতান্তই ভোটপন্থী চাতুর্য।

মনে করিয়ে দিতে চাই, বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) প্রয়াণের পর তাঁর বাণী ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দেওয়া হিন্দুত্ববাদীদের নয়, দেশব্রতী কর্মযোগীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। কারণ, দেশের জন্য আত্মত্যাগে বিবেকানন্দ তাঁদেরকে উদ্দীপিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিবেকানন্দের কর্মযোগ তাঁদের আকর্ষণ করেছিল, বিবেকানন্দের কবিতা সম্বলিত বীরবাণী নামের পুস্তিকাটিও তাঁদের টেনেছিল। শুধু বাংলা নয়, ভারতের অন্যান্য অংশে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তাঁর বিশেষ প্রভাব পড়েছিল। বালগঙ্গাধর তিলক, শ্রীঅরবিন্দ, মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন, এই চারজন ভারতীয় ইতিহাসকে উত্তোলিত করেছিলেন। এঁদের উপর স্বামীজির প্রভাব ছিল যথেষ্ট। স্বামীজির দেহান্তের পরে যখন দক্ষিণ ভারতে প্রচার চলছে যে, পাশ্চাত্যে গিয়ে এই সন্ন্যাসী নিষিদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করেছেন, তখন তিলকের মতো মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ দরাজ হৃদয়ে বলছেন, স্বামীজি হলেন দ্বিতীয় শঙ্করাচার্য। শ্রীঅরবিন্দ বলেছেন, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রভাব ছিল বলেই জাতীয় আন্দোলন সম্ভবপর হয়েছিল। হরিজন আন্দোলনের উপর স্বামীজির প্রভাবের কথা গান্ধীর সকল জীবনীকার স্বীকার করেছেন।

বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) ইংরেজি ও বাংলা ভাষার রচনাগুলি ধ্বনি-ঝঙ্কারময়, বিশ্বাসের প্রত্যয়ে দীপ্ত। ঔপনিবেশিক ভারতে এই আত্মপ্রত্যয় প্রদায়ী বাণীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই প্রত্যয়কে বিবেকানন্দ ‘আত্মশ্রদ্ধা’ বলে মনে করতেন। তাঁর এই আত্মশ্রদ্ধা আত্মমর্যাদাবোধ সঞ্জাত। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ধর্মবোধ আর আত্মগর্বী হিন্দুত্ববাদ দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোভাব— দু’টির মধ্যে গুণগত ও মাত্রাগত পার্থক্য আছে। আত্মমর্যাদাবোধ অপরের মর্যাদার হানি ঘটায় না, আত্মগর্ব অপরের মর্যাদার হানি ঘটাতে তৎপর। ধর্মীয় আত্মগর্ব আর রাষ্ট্রীয় আত্মগর্ব দুই-ই অপরকে গ্রাস করতে চায়। অপরকে গিলে খাওয়ার এই চেষ্টা ক্ষমতাতন্ত্রের প্রকৃতি। বিবেকানন্দ অপরের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন— তিনি মূর্খ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসীকে নিজের ভাই বলতে দ্বিধা করেননি। সেজন্য ধর্মের নামে গচ্ছিত অর্থ ব্যয় করতেও বিবেকানন্দ কুণ্ঠিত ছিলেন না। তাঁর গুরুভাই স্বামী অখণ্ডানন্দ দুর্ভিক্ষের সময় তীব্র ভাষায় ভারতের নানা মঠের প্রধানদের কাছে নিবেদন করেছিলেন, যেন ধর্মীয় আচারের জন্য গচ্ছিত অর্থ জনগণের সেবায় বণ্টন করে দেওয়া হয়।
শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের বৈশিষ্ট্য হিসাবে যে সমন্বয়ী চিন্তাধারার কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন তারই সূত্রে ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে তিনি একাত্মতা বোধ করতেন। অগ্নিবর্ণ ও চণ্ডাশোকের মতো অপশাসক ইসলাম ধর্মাবলম্বী ভারতীয় শাসকদের মধ্যে কেউ থাকতেই পারেন, তাই বলে আকবরের মাহাত্ম্য খর্ব হয়ে যায় না। বিবেকানন্দের প্রয়াণের পর থেকে এমনকী আজও তাঁর চিন্তাধারাকে ধর্মীয় স্বার্থান্বেষীরা নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে চাইছেন। বিবেকানন্দ কোনও ‘দেবতা’ বা ‘অবতার’ নন। তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত একথাটা বলতেন। দেশ-কাল-সমাজের কার্য-কারণ সূত্রে গড়ে ওঠা মানবতাবাদী স্বাদেশিক সন্ন্যাসী। তাঁকে উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারক হিসাবে মূর্তিবন্দি করার রাজনীতি, যেটা বর্তমান ভারতে চলছে, সেটা আর যাই হোক, বিবেকানন্দের কাঙ্ক্ষিত ভারতের রাষ্ট্রনীতি হতে পারে না।

আরও পড়ুন- বিবেকানন্দের ১৬১তম জন্মবার্ষিকী: স্বামীজিই আদর্শ, তাঁর দেখানো পথেই চলা

স্বামী বিবেকানন্দ মানেই কি ভারত মহাসাগরের বুকে একাকী পাথরখণ্ডে বসে অসমসাহসী ধ্যান? বা ১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ সালের ‘সিস্টার্স অ্যান্ড ব্রাদার্স অব আমেরিকা’? তার পর টানা মিনিট দুয়েকের করতালি? এই সবই হিমশৈলের চূড়াটুকু, প্রদীপের দপ করে জ্বলে ওঠা। সাধারণ মানসে বিবেকানন্দের যে জনপ্রিয় ইমেজটুকু ধরা আছে, তাতে এই চোখ-ধাঁধানো খণ্ডচিত্রগুলির আড়ালে পাঠ-প্রত্যাশী হয়ে বেঁচে থাকে মানুষটির জীবনচর্যা, তাঁর প্রদীপ হয়ে ওঠার পিছনের সুগভীর দর্শনের নিশ্ছিদ্র নির্মাণ ও তীক্ষ্ণ যুক্তিবাদ।

১৮৯৭ সালে প্রথমবার বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন যখন বিবেকানন্দ, তাঁর তৎকালীন বক্তৃতামালায় বেদান্তের আদর্শে তিনি গড়ে তুলছেন ভারতের এক নবীন ধারণা— আবেগের বশে নয়, খুব সচেতন ভাবে। কীভাবে গঠিত হবে নতুন দেশ? জাতীয় জীবনের মূল সুর ধর্মে অর্পিত করে তারই ভিত্তিতে তিনি গড়ে তুলছেন কিছু ‘ন্যাশনাল আর্কেটাইপ’। এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শিরায় রক্ত ছুটিয়েছিল বিবেকানন্দের এই ‘আর্কেটাইপ’— ভারতের ‘ভারতীয়ত্ব’ ফুটে উঠেছিল তাঁরই প্রবর্তিত নির্দিষ্ট সেবাকার্যে। স্বাস্থ্যদান, অন্নদান, বিদ্যাদান ও অধ্যাত্ম সম্পদদানে প্রথমে বলীয়ান হবে ভারত; ক্রমশ সে নিজেকেও ছাড়িয়ে অদ্বৈতের একত্বে বাঁধবে সারা পৃথিবীকেই, তৈরি হবে ক্ষুদ্রতার সমস্ত সীমা-পেরোনো মানুষের এক বসত, ‘দ্য সিটি অব ম্যানকাইন্ড’। সন্ন্যাসীর উদাসীন ভক্তিভাব নয়, বরং এক কর্মীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রজ্ঞা ফুটে ওঠে তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায়, লেখায়। আধুনিক সময়ে, ‘স্ক্রল’ করে এগিয়ে যাওয়ার যুগে, যখন ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর ধারণাকেও পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা একদিকে, আর অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা আর রাজনীতির খেলায় টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে দেশ ও মানুষ। এটা আর যাই হোক, বিবেকানন্দের স্বপ্নের ভারত নয়।

স্বামীজির (Swami Vivekananda) ছবি নিয়ে দলীয় স্লোগান আর পতাকা হাতে একখানা মালা গলায় চাপিয়ে দিলেই কি ভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শিত হল? ১৮৯৮-এর দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী। ক্ষীরভবানী মন্দির, কাশ্মীর। স্বামী বিবেকানন্দ এক দরিদ্র কাশ্মীরি মুসলিম নৌকা মাঝির ছোট্ট মেয়েটির চোখে মা-রূপী ঈশ্বরকে অনুধাবন করলেন। সেই পিতার অনুমতি নিয়ে বিবেকানন্দ তাঁর কন্যার পূজা করলেন, পদযুগল স্পর্শ-সহ। বর্তমানে বেলুড় মঠের কুমারী পুজোর শিকড় এই ঘটনার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। যারা ধর্মকে মূলধন করে মানুষে-মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, কাশ্মীরিদের আবেগে-স্বার্থে-মানবাধিকারে আঘাত করে, হাথরস, উন্নাও, বদায়ুঁর কলঙ্ককে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, দরিদ্রবিরোধী পদক্ষেপ করে, তারাও কী করে এই মহাত্মার উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের স্পর্ধা দেখায়?

Latest article