গতকাল ছিল বিশ্ব খাদ্য সুরক্ষা দিবস। প্রতিবছর ৭ জুন পালিত হয় এই দিনটি। এই দিনটায় খাদ্যের কারণে ছড়িয়ে পড়া রোগ নির্ণয় এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয় নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হয়। খাদ্য সংক্রান্ত রোগ যে কোনও বয়সে ব্যক্তির শরীরে প্রভাব ফেলে থাকে। বিশেষত যে দেশের আয় নিম্ন এবং পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুর মধ্যে খাদ্যসংক্রান্ত রোগের প্রকোপ দেখা দেয় সেই দেশে এই দিনটি গুরুত্ব সহকারে পালন করা দরকার। খাদ্য সামগ্রী উপভোগের পূর্বে ফসল উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং বিতরণ পর্যন্ত খাদ্যশৃঙ্খলার প্রতিটি স্তরেই প্রয়োজন খাদ্যের সুরক্ষার। যাতে খাদ্যের পুষ্টিগুণ বজায় রেখে স্বচ্ছ সুরক্ষিত খাদ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছয়।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরার দুর্দশা নিয়ে “ত্রিপুরা ফাইলস” প্রকাশ তৃণমূল কংগ্রেসের
দূষিত ও ব্যাকটেরিয়া যুক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে নানা অসুস্থতা তো দেখা যায়ই, বিষক্রিয়ায় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। তাই খাদ্য নির্বাচন গ্রহণ বা ক্রয় করার পূর্বে কিছু সাধারণ বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এখনও প্রায়শই শোনা যাচ্ছে বাজারের শাক-সবজির মধ্যে পেস্টিসাইড আছে, নানারকম রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে যার ফলে খাদ্যের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। এটা শুধু শাক-সবজি ফল নয়, মাছ-মাংস সবকিছুর ক্ষেত্রেই হচ্ছে। তাই যতটা সম্ভব এই রাসায়নিক সার বর্জিত খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এর পরিবর্তে জৈব রাসায়নিক খাদ্য বা অরগ্যানিক খাবার খেতে হবে। অরগ্যানিক ফুড নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে পদ্ধতিগত ভাবে কেমিক্যাল, পেস্টিসাইড কিছুই থাকে না।
ঘরোয়াভাবে শাক-সবজি কিনে এনে একগামলা ফুটন্ত গরম জলের মধ্যে সব সবজি ফেলে রেখে খানিকক্ষণ পরে তুলে নেওয়া হয়। একে ব্লাঞ্চিং বলা হয়। এছাড়া ভাপিয়েও নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে বেশিরভাগ ক্ষতিকারক উপাদানগুলো বেরিয়ে যায় কারণ শুধু কেমিক্যাল নয়, বাজারের শাক-সবজিতে রংও মেশানো থাকে। ব্লাঞ্চিং পদ্ধতিতে সেইসব আর্টিফিশিয়াল কালারগুলো বেরিয়ে যায় এবং ভারী উপাদান যেগুলো রয়ে যায় তা উচ্চতাপমাত্রায় রান্না করার ফলে নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রোজেন ফুড কম খান।
আরও পড়ুন-কয়লা সঙ্কটের দায় কেন্দ্রেরই, মত বিশেষজ্ঞদের
ফলের ক্ষেত্রে স্টিকার মারা থাকলে সেগুলো খাঁটি বলে ধরে নেওয়া হয়। এতেও নকল থাকে। ছোট বাঁকা শসা কেউ খেতে চায় না। কিন্তু ওই শসাগুলোই আসলে দেশি শসা। লাল টকটকে তরমুজে রং ইঞ্জেক্ট করা হয় তাই তরমুজ ফ্যাকাশে হলেই সেটা অকৃত্রিম। বেশি তাজা চকচকে ফল সবজি সবটাই কার্বাইডে পাকানো হয়। তাই উপর থেকে দেখতে তাজা মনে হয়।
মধুর অনেক নামীদামি ব্র্যান্ড রয়েছে। কিন্তু যদি পরীক্ষা করে দেখা যায় সেই মধু খাঁটি কি না তাহলে সেটা ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। কারণ খাঁটি মধু কোনওদিন ঠান্ডায় জমে যাবে না। ঠান্ডা হোক বা গরম, সবসময় মধু তরল থাকবে। মধু জমে গেলে ধরে নিতে হবে তার মধ্যে চিনি আছে।
খাটালের দুধের চেয়ে প্যাকেট দুধ অনেক বেশি সুরক্ষিত কারণ ওই দুধ পাস্তুরাইজড করা থাকে। উচ্চতাপে পাস্তুরাইজেশন পদ্ধতিতে দুধের মধ্যের মাইক্রোবস এবং ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও নষ্ট করে দেওয়া হয়। খাটালের দুধে অনেক সময় জল মেশানো থাকে। আবার খুব গাঢ় দুধে ফ্যাট মেশানো থাকে। এর কোনওটাই খাওয়া ঠিক নয়। তাই প্যাকেটজাত দুধ অনেক বেশি সুরক্ষিত। শুধু প্যাকেট দুধ কেনার আগে দেখে নিতে হবে আইএসআই মার্ক আছে কি না। কিছু দুধে ফর্টিফিকেশন করা থাকে অর্থাৎ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নেই যা দুধের পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে, সেগুলোকে অ্যাড করা হয়। এর ফলে দুধের গুণমান বেড়ে যায়। সেগুলোও দেখে নেওয়া দরকার। এখন টেট্রা প্যাকে সয়াবিনের দুধ পাওয়া যায়, সেটাও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন-বেঙ্গালুরুতে ধৃত
মাছ-মাংস দু’দিনের বেশি ফ্রিজে রেখে খাওয়া ঠিক নয়। এতে পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। এমনকী রান্না করা খাবারও। ফ্রিজে সবসময় খাবার ঢাকা দিয়ে রাখতে হবে। কারণ ফ্রিজের মধ্যে কিছু কোল্ড রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়া থাকে, খোলা খাবার রাখলে নষ্ট করিয়ে দিতে পারে। পুরো পচিয়ে না দিলেও, তার খাদ্যগুণ নষ্ট করে দেয়। মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করার সময়ও ঢাকা দেওয়া বাটি বসানো উচিত। খোলা বাটির খাবারে ইউভি রে সরাসরি পড়ে, যা ক্ষতিকর, এর থেকে সেল জেনারেশন হতে পারে যা ক্যানসারাস। আমাদের ট্রাডিশনাল যে পদ্ধতি গ্যাসে গরম করা বা ইনডাকশনেও রান্না করা যেতে পারে। সবসময় যতটা সম্ভব ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে। ঢাকা না দিলে খাবারের মধ্যে জলীয় বা ওয়াটার সলিউবল ভিটামিনগুলো উড়ে যায়।
আরও পড়ুন-বিমানের মতো নিয়ম এবার রেলেও, বেশি লাগেজ নিলেই গুনতে হবে জরিমানা
খাদ্যসুরক্ষার মধ্যে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল প্রিজারভেটিভ। প্রিজারভেটিভ দু’রকমের হয়— ক্লাস ওয়ান এবং ক্লাস টু। প্রিজারভেটিভ ওয়ান হল ঘরোয়া যেসব আমরা ব্যবহার করি প্রিজার্ভ করার জন্য যেমন নুন, চিনি, ভিনিগার ইত্যাদি আর প্যাকেটজাত দ্রব্যে ব্যবহৃত হয় প্রিজারভেটিভ ক্লাস টু। এগুলোয় সোডিয়াম থাকে। ক্যানড ফুডে সুগার সিরাপ থাকে। এছাড়া অনেক কালার ব্যবহার করা হয়। যাঁদের হাঁপানি বা অ্যালার্জির প্রবণতা রয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে এই ধরনের প্যাকেটজাত দ্রব্য খাওয়া উচিত নয়। প্যাকেটজাত দ্রব্যটির লেভেলিং ঠিক আছে কি না এবং প্রিজারভেটিভ ক্লাস টু লেখা আছে কি না দেখে নিতে হবে। কিছু ওষুধ কালার কোটিং করা থাকে। সেগুলো ক্ষতিকর। সবচেয়ে জরুরি ফুডের মধ্যে এডিআই বা অ্যাকসেপ্টেবল ডেলি ইনটেক লেখা রয়েছে কি না দেখে নিতে হবে। অথবা কনটেন্ট পারমিটেড ন্যাচরাল কালার বা কনটেন্ট পারমিটেড সিন্থেটিক ফুড কালার বা কনটেন্ট পারমিটেড ন্যাচারাল অর সিন্থেটিক ফুড কালার এই জাতীয় কিছু লেখা রয়েছে কি না। লেবেলে এফএও, এফসি বা এডিআই লেখা আছে কি না দেখে নিতে হবে।
আরও পড়ুন-গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কর্মশালা
যে সব ইনস্ট্যান্ট প্যাকেট ফুড আছে তা বেশি না খাওয়াই ভাল। কোল্ড ড্রিঙ্কস, আইসক্রিম, চিপস খাওয়ার আগে অবশ্যই এক্সপায়ারি ডেট দেখে নিতে হবে। কারণ এগুলো নষ্ট হলে আমরা বুঝতে পারি না কোনটা খারাপ হয়েছে। ফাংশনাল কিছু খাবার আমাদের জন্য উপকারী যেমন, প্লেন ওটস বা মুইসলি , গ্র্যানুলা, কিনোয়া, প্যাকেটের দই, প্যাকেটজাত ডাল। তবে প্যাকেটের দই যদি খুব টক হয়, ধরে নিতে হবে খারাপ হয়েছে, ডেট বাকি থাকলেও।
আরও পড়ুন-ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া রুখতে প্রচার
প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে খুব প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে। জল, কোল্ড ড্রিঙ্কস সব প্লাস্টিকের বোতলে ব্যবহার করা হচ্ছে। থার্মোকলের থালা-বাটি গ্লাস ব্যবহৃত হয়। এর বদলে কাগজের থালা-বাটি বা সুপারির খোলের থালা বাটি ব্যবহার করা উচিত কারণ এগুলো বায়োডিগ্রেডেবল। প্লাস্টিক কনটেনারের পরিবর্তে ফয়েল প্যাক ব্যবহার করা উচিত। চায়ের ক্ষেত্রে কাগজের কাপ বা ভাঁড় ব্যবহার করা উচিত। সবজি ফলনে যেন জৈব সার ব্যবহার করা হয়, ভেড়িতে মাছ চাষের জন্য এমন কিছু খাওয়ানো না হয় যাতে সেই মাছ খেলে ক্ষতি হয়। প্যাকড ফুড হলে প্যাকেজিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, লেভেলিং এবং এক্সপায়ারি ডেট দেখে নিতে হবে। এইভাবে খাদ্যসুরক্ষা বিষয় সম্পর্কে সচেতন হতে পারব।