“Why do old men wake so early? Is it to have one longer day?” এমনটাই ভাবত বুড়ো সানতিয়াগো, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-র পৃথিবীবিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’-তে। কিউবার নোনা সমুদ্র আর সূর্যের যুগলবন্দি ততদিনে তুমুল বলিরেখার ছাপ রেখে গেছে একসময়ের তুখোড় সমুদ্রশিকারি সানতিয়াগোর সারা মুখে, ঘাড়ে, হাতে। কিন্তু দিন ফুরায়, শক্তি নিভে আসে। টানা চুরাশি দিন সানতিয়াগোর জালে মাছ পড়েনি, এখন সে অপয়া বুড়ো, তার আদরের শিক্ষানবিশ সঙ্গী ম্যানোলিনও বাপ-মায়ের আদেশে ছেড়ে যায় সানতিয়াগোকে, এখন ও আর কী শেখাবে? নিজেই তো মাছ ধরা ভুলে গেছে বুড়োটা! চরম ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে সানতিয়াগোর ঘুমভাঙা সকাল জুড়ে— বুড়োর ঘুম এত সাত তাড়াতাড়ি ভেঙে হবেটা কী? অথর্বর মতো বসে বসে আর-একটা লম্বা দিন দেখা ছাড়া আর আছেটাই বা কী?
আরও পড়ুন-শিউলি-গন্ধ মাখা শারদ-সাহিত্য
বয়স। বার্ধক্য। অক্ষমতা। এই তিনটে শব্দ চিরকাল আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে একে অন্যকে। আর বার্ধক্য যেন এমন একটা দুনিয়া, যার টিকিট একবার কেটে ফেললেই নিয়ম মেনে ফিকে করে দিতে হয় জীবনের সব রং, চাইতে হয় কম, চলতে হয় পা মেপে। নির্মম বাস্তব চিরকালই মানুষের দাম মেপে এসেছে চুলচেরা হিসেবের খাতায়, সম্পদের ব্যবহার করলে যত, হিসেব ফেরাতে পারলে কি? ফলে বয়স্কদের নিয়ে অসহনীয়তার শেষ নেই। মোদ্দা বক্তব্যটা সেই একটাই— আর কীই বা দেওয়ার আছে, যার বিনিময়ে পৃথিবীর মূলধন খরচ করা যায় প্রবীণদের জন্য? সমস্যাটা ক্রমশ জটিলতর আকার নিচ্ছে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে, যেখানে জনসংখ্যা প্রচুর, কিন্তু মানবসম্পদ সীমিত। সমীক্ষার হিসেব বলছে, শুধু ২০০১ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যেই ষাটোর্ধ্ব নাগরিকের সংখ্যা ৭.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৭ শতাংশে, ২০৩১ সালের মধ্যে সংখ্যাটা হতে চলেছে প্রায় ১২.১ শতাংশ, ২০৫১ সালে গিয়ে যা সম্ভবত ১৬.৬ শতাংশের হিসেব ছুঁয়ে ফেলবে। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ১৪ থেকে ২০ কোটি বরিষ্ঠ নাগরিক থাকবেন গোটা দেশে, যার মধ্যে মাত্র ৫০ শতাংশ বড়জোর আর্থিকভাবে স্বনির্ভর। তবে, আর্থিক স্বনির্ভরতার চাইতেও বহু ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁদের নিজস্ব পরিষেবা নিজেরাই সরবরাহ করে নেওয়ার ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা।
আরও পড়ুন-সন্দেশ-এর সেরা ভূতের গপপো
এই প্রশ্নের ওপরে ক্রমশ উপরিচাপ তৈরি করে চলেছে এই মুহূর্তে আমাদের দেশের পেশাগত পরিবেশ বদলের প্রবণতা। উপার্জনক্ষম তরুণ তুর্কিদের একটা বড় অংশ অন্য যে-কোনও বৃত্তির চেয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছে আইটি সেক্টরের ওপরে। সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে অ্যাকাডেমিক ও বৃত্তিগত বিভিন্ন কারণে বিদেশে স্থায়ী বসবাসকারীদের সংখ্যাও। পেশার ক্রমবর্ধমান চাপ, অধিকাংশ কর্মপরিসরে সুস্থ ওয়ার্কিং আওয়ার-এর অভাব, দীর্ঘক্ষণ মাত্রাতিরিক্ত প্রফেশনাল চাপ সামলানোর পর সাংসারিক বিচ্ছিন্নতা এবং অবশ্যই বিদেশে থিতু হওয়ার অবধারিত ফল হিসেবে পারিবারিক অনুপস্থিতি— সব মিলিয়ে বহুলাংশেই প্রবীণ দম্পতিদের মধ্যে অনেকেই ভুগছেন স্রেফ লোকবলের অভাবে, একাকী প্রবীণদের অবস্থাটা আরও কঠিন। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতি মেনে চললে হাতের পাঁচ কিছু বয়স্ক আশ্রয়স্থল যে মেলে না, তা নয়, কিন্তু প্রথমত এই চড়া খরচ সামলানোর ক্ষমতা সবার নেই, আর দ্বিতীয়ত, নিজের পরিচিত পরিসর ছেড়ে অন্যের নিয়ন্ত্রিত একটি বিপ্রতীপ সিস্টেমে ঢোকার আগ্রহ একটা বয়সের পর অনেকেই হারিয়ে ফেলেন, যতক্ষণ না তুমুল প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন-ইডির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ, ধৃত আপ সাংসদের
নিউক্লিয়ার পরিবারের প্রবীণদের প্রাথমিক দায়িত্বটুকু নেওয়ার মতো ভরসাসঙ্গীর অভাব যে কী মাত্রাছাড়া অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে, শহর কলকাতার তথাকথিত বড়ো হাসপাতালগুলোয় গেলেই সেই ছবিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ক্যানসারের মতো জটিল রোগের ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকী বহু জীবনদায়ী চিকিৎসাপদ্ধতির ক্ষেত্রেও বর্তমানে বহু জায়গায় একটি বিশেষ প্রোটোকল মেনে চলা হয়, রোগীর চিকিৎসা চলাকালীন রোগীর সঙ্গে একজন ‘কেয়ারগিভার’-এর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। কোনও কারণে রোগীকে ভরতি হতে হলে যাঁকে থাকতেই হবে সঙ্গে, যাঁর অনুপস্থিতিতে কোনওরকম ট্রিটমেন্ট-এর মধ্যে দিয়ে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হবে না। মুশকিলটা বাধে এখানেই। বহু পরিবারে এমন কোনও সদস্যই নেই, যিনি প্রবীণ রোগীটির ‘কেয়ারগিভার’ হয়ে অষ্টপ্রহর সঙ্গে থাকতে পারেন। অতঃপর, মুশকিল আসান ‘প্রফেশনাল কেয়ারগিভার’, অর্থমূল্যের বিনিময়ে এবং দিনচুক্তির হিসেবে যাঁরা রোগীর সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে সামলাবেন বাড়ি থেকে চিকিৎসাক্ষেত্র পর্যন্ত যে-কোনও দরকার। এই বিকল্প দিকটি নিঃসন্দেহে বিপদে কার্যকর, কিন্তু একজন প্রবীণ ও শারীরিকভাবে অন্যের ওপরে মুখাপেক্ষী মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণ অচেনা অথচ পেশাদার এক ‘কেয়ারগিভার’-এর ওপরে কতটা নিশ্চিন্তিতে নির্ভরশীল হওয়া সম্ভব সেটা প্রশ্নাতীত তো নয়ই, উপরন্তু রোগীর পুরোনো চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত তথ্যও সম্পূর্ণত জানা এঁদের পক্ষে সম্ভবই নয়, যেখানে বাধা তৈরি হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালের পথের কাঁটা বিজেপির রাজনৈতিক চাপ, মন্ত্রীদের মিথ্যাচার, বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের
অর্থ, স্বনির্ভরতা আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সুচিন্তিত পরিকল্পনার অভাবে যে গভীর অন্ধকার তৈরি হয়েছে বরিষ্ঠ প্রজন্মের চারপাশে, তার মেঘ কাটিয়ে আলো খোঁজার বিশেষ উৎসাহ কোনও তরফেই খুব একটা আছে, তাও নয়। স্রেফ নীতিনির্ধারকদের প্রায় নিষ্ফল কাগুজে ফরমান দিয়ে ছবিটায় খুব বেশি বদল আনা সম্ভবও নয়, যতদিন না ‘সিনিয়র সিটিজেন’ শব্দবন্ধের ভেতরে লুকিয়ে থাকা চাপা অনুকম্পার ব্যবধান আমরা সরাতে না পারছি।